পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অন্যান্য নাগরিকের মতো সামাজিক নিরাপত্তা, সম্পদ সুরক্ষা ও যথাযথ মর্যাদা নিয়েই বসবাস করছে। সকল ধর্মের মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রীতিময়, সৌহার্দ্যপূর্ণ। সমাজে তারা মিলেমিশে বসবাস করে। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। দেখা হলে সালাম, আদাব, নমস্কার ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। সমতার সাথে নিজেদের কার্যাদি সমাধা করে। দেশের সরকার, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবখানেই সংখ্যালঘুরা সামানে সমান সুযোগ পাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংখালঘুরা প্রধান্য পাচ্ছে। এদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও সরকারি কর্মচারির প্রায় ২৫% সংখ্যালঘুরা। এছাড়া বেসরকারি অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। মুসলমানরা তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন উজ্জ্বল নমুনা বিশ্বের আর কোন দেশে খোঁজে পাওয়া বিরল। বিশ্বের অনেক দেশের জন্য ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উদাহরণ হতে পারে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
একটি রাষ্ট্রে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেই পারে। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ধর্মনিষ্ঠার সাথে সাথে পারস্পরিক সদ্ভাব, উদারতা প্রতিষ্ঠা করে বসবাস করাই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। প্রত্যেক নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা, সম্পদের সুরক্ষা তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যালঘুদের সাথে তাদের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে নির্বিঘেœ বসবাস করে। মুসলমানরা যেভাবে ঈদ উৎসব পালন করে তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও পুজা, বড়দিন ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব সমানতালে পালন করে। মুসলমানরা যেভাবে মসজিদে উপাসনা করে তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের উপাসনালয়ে উপাসনা করে। এতে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র বাধা দেয় না।
এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করে এসেছে। সকল ধর্মের মানুষ একসাথে কৃষি কাজ করে, জেলেরা একসাথে মাছ ধরে, তাঁতিরা একসাথে তাঁত বুনে, ব্যবসায়ীরা একসাথে ব্যবসা করে, একই হোটেলে বসে একসাথে গল্প করে, চা-নাস্তা করে, গাড়ির পাশের সিটে বসে দূর-দূরান্ত সফর করে, একই অফিসে এক সাথে চাকরি করে, একই টেবিলে বসে আহার করে, কেউ কারো সাথে সংঘাতে জড়ায় না। কেউ কাউকে উৎখাত করতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুরাই রক্ত দেয়নি; সংখ্যালঘুদের অনেকেই রক্ত দিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই মিলে শত্রæর মোকাবেলা করেছে।
এবস বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। মুসলমানরা এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানরা প্রবল ও সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যালঘু দুর্বলকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে না। বিশ্বের যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নীপিড়নের কথা শোনা যায় না। কারণ, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য নয়। ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম। মানবতার ধর্ম। অন্যায়ভাবে কাউকে আঘাত করা, কারো বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, উচ্ছেদ করে দেওয়া, কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বেঘাত সৃষ্টি করা ইসলামের শিক্ষা নয়।
ইসলামের শিক্ষা হচ্ছেÑ সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। এই পৃথিবী সবারই বাসস্থান। এখানে সবাই মিলেমিশে থাকতে হবে। প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এগুলো মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার। এসব অধিকারে হস্তক্ষেপ কারার সুযোগ পৃথিবীর কারো নেই। মানবতার ধর্ম ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা সকল নাগরিকের ন্যায্য অধিকার প্রদান করে মিলেমিশে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে।
ইসলামের নবী মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হননি। তিনি পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন গোটা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে। তিনি পৃথিবীতে মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। উদারতা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের অপুর্ব নজীর স্থাপন করেছেন। তিনি অমুসলিমদের সাথে সদাচরণ ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেছেনÑ ‘সাবধান! যদি কোন মুসলিম কোন অমুসলিম নাগরিকের ওপর নীপিড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, ক্ষমতার বাইরে তাকে কষ্ট দেয়, তার কোন বস্তু জোরপূর্বক কেড়ে নেয় আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করবো।’ (আবু দাউদ)
অমুসলিমদের নিরাপত্তা বিধান করাই ইসলামের শিক্ষা। হযরত আলী (রা.) অমুসলিমদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ঘোষণা করেছিলেনÑ ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধন-সম্পদ আমাদের ধন-সম্পদের মতো।’ অথচ, তৎকালীন সময়ে অমুসলিমরা ছিল মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রæ। অমুসলীমদের অত্যাচারে সাহাবায়ে কেরামগণকে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি স্বয়ং রাসূল (সা.)-কে রক্তে রঞ্জিত করা হয়েছে। জুলুম, নির্যাতন, নীপিড়নের এমন কোন পন্থা বাকি থাকেনি যা তারা প্রয়োগ করেনি। এখানেই শেষ নয়; প্রিয়নবী (সা.)-কে বারবার হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। তথাপি, প্রতিশোধের পরিবর্তে শত্রæদের প্রতি ক্ষমা ও মহানুভবতার অসংখ্য অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাসূল (সা.) ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুসলমানরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের আদর্শে আদর্শবান। তারা মানবতার নবী বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত। সুতরাং তারা অন্যায়ভাবে কাউকে আঘাত করে না, কারো বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় না, কাউকে উচ্ছেদ করে দেয় না, কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বেঘাত সৃষ্টি করে না, কারো ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয় না। সকল নাগরিকের নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার প্রদান করে। সমাজে মিলেমিশে বসবাস করে।
মুসলমানরা ভদ্র, শান্তিপ্রিয়। এরা সাম্প্রদায়িক নয়। তিক্তসত্য হলোÑ মুসলমানরা পৃথিবীর যেখানেই সংখ্যালঘু সেখানেই নির্যাতন, নীপিড়ন, উচ্ছেদ অভিযান, বর্বরতা, পৈশাচিকতা। বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরন করে দেশ থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আসামের ৪০ লক্ষ মুসলমানের নাগরিকত্ব হরন করা হয়েছে। চীন, শ্রীলংকায় মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার সচিত্র সংবাদ পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে। ভারতে মুসলমানরা সংখ্যলঘু হওয়ার কারণে উগ্রবাদী হিন্দুদের আক্রমণে বাড়ি-ঘর, পথ-ঘাট, মসজিদ, মাদরাসা কোনো কিছুতেই তারা নিরাপদ নয়। এসব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। একটি কথা বলারও সময় নেই। অথচ, বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত জুলুম, নির্যাতন, তকমা, অপবাদ।
সম্প্রতি প্রিয় সাহা নামক জনৈক হিন্দু মহিলা দেশবাসীকে অবাক করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে উসকানিমুলক ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়ে নিজেকে দেশদ্রোহিতার পরিচয় দিয়েছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান তথা শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমীক একজন নাগরিকও প্রিয় সাহার এ মন্তব্য মেনে নিতে পারেনি।
তিনি গত ১৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ করেছেনÑ ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ৩ কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরই মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। এখনও ১ কোটি ৮০ লাখ আছে। যার মধ্যে ১৭ লাখ শিশু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে। দয়াকরে আমাদেরকে সাহায্য করুন।’ তিনি আরো বলেছেন, এসব কাজ নাকি করেছে বাংলাদেশে অবস্থানরত মুসলমানরা। ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার এ বক্তব্যে দেশ-বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে। বিশ্ববাসী কি অন্ধ হয়ে গেল? বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিখুঁজ হয়ে গেলÑ কেউ জানলো না! অথচ তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার এই যুগে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যখন যা ঘটছে সবকিছুই তাৎক্ষণিক জানা যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেনÑ ‘মতলববাজ একটি কুচক্রিমহল দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুনাম-সুখ্যাতি বিনষ্ট করে দেশকে অস্থিতিশীল ও জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করে বিদেশী শক্তির আগ্রাসন সৃষ্টির গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।’ সম্প্রতি ‘ইসকন’ নামক একটি সংগঠনের উদ্যোগে চট্টগ্রামের ৩০টি স্কুলে ৩০ হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে খাবার বিতরণের নামে প্রসাদ খাওয়ানো হয়েছে এবং ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ মন্ত্র পাঠ করতে বাধ্য করা হয়েছে। যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং গুরুতর অন্যায়। এই সংগঠনের লোকেরা ২০১৬ সালের ২ আগস্ট সিলেটের কাজলশাহ জামে মসজিদে নামাজরত মুসল্লিাদের উপর শসস্ত্র হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে ১০ জন মুসল্লি আহত হয়ে ছিলেন। এ সংগঠনটি বার বার বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
যারা দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যারা বহির্বিশ্বে দেশের বিরুদ্ধে আজগুবি নালিশ করে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিতে উসকানি দেয়, শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশকে কলুষিত করতে চায় এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে- যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ দেশের বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্রমূলক কূটচালের সাহস করতে না পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।