চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। ইসলাম সর্বদা ভিন্ন ধর্মের ব্যাপারে উদার ও সহানুভূতিশীল। ইসলাম এমন একটি ধর্ম ,যে ধর্ম মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ সকল ধর্মের লোকদের বা অনুসারীদের নিরাপত্তা ও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে বা নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে । ইসলাম ধর্ম কখনও ভিন্ন ধর্মের লোকদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হবে না।’ (বাকারা : ২৫৬)।
ইসলাম ধর্ম মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায় । অতএব, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যে ধর্মের অনুসারী হোক না কেন, মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত। এজন্য ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) একজন ইহুদির লাশের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আর আমি অবশ্যই আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।’ (সুরা ইসরা : ৭০)। একবার রাসুল (সা.) এর পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দাঁড়ালেন। সহাবায়ে কেরাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তো একজন ইহুদির লাশ, আপনি কেন দাঁড়াচ্ছেন?’ নবীজি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘এটা কী একটা মানুষের লাশ নয়?’ (বোখারি : ১২৫০)।
এমনকি ইসলাম এমন একটি মহান ধর্ম, যে ধর্ম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গালি দিতেও নিষেধ করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আর তোমরা তাদের প্রতিমাগুলোকে গালি দিও না, ফলে না জেনে তারাও আল্লাহকে গালি দেবে।’ (আনয়াম : ১০৮) বিশ্বনবী অমুসলিমদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন । এই বিষয়ে রাসুলের প্রিয় সাহাবি আনাছ (রা.) থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়, তিনি বলেন, এক ইহুদি নবী (সা.) কে যবের রুটি ও চর্বিযুক্ত খাদ্যের দাওয়াত দিল, নবীজি (সা.) তার দাওয়াত কবুল করেছিলেন। (মুসনাদে আহমদ : ১৩২২৪)।
ইসলাম ধর্ম মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচার কায়েম করতে নিদের্শ দেয়। যেমন : একদিন ওমর ইবনুল আজিযের কাছে এক অমুসলিম এসে আব্বাস ইবনুল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে তার জমি দখলের বিচার দায়ের করল। আব্বাসকে জিজ্ঞেস করা হলো, এ ব্যাপারে তুমি কী বলো। সে বলল, আমার পিতা ওয়ালিদ জমিটি আমার ভাগে দিয়েছেন এবং তার ওপর আমার কাছে একটি দলিল আছে। অমুসলিমকে জিজ্ঞেসা করা হলো, এবার তোমার বক্তব্য কী? সে বলল, আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা চাই। তখন আমিরুল মুমিনিন বললেন, হে আব্বাস! আল্লাহর কিতাব তোমার দলিলের চেয়ে উত্তম। তোমার জমিটি এ ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দাও। তখন আব্বাস জমিটি ফিরিয়ে দিল। (বিদায়া ও আন-নিহায়া : ৯/২১৩)।
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব। (সুনানে আবু দাউদ : ৩০৫২)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। (সহিহ বোখারি : ৩১৬৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। ’ (সুনানে নাসাঈ : ৪৭৪৭)।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা:) বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে বা যুদ্ধের পর কোনো মন্দির-গীর্জা-উপাসনালয় ভেঙে ফেলবে না। (মুসান্নাফ আবি শায়বা : ৩৩৮০৪)। হযরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) বলেন, রাসুলের যুগে আমার মা আমার কাছে এলেন, তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। তখন আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা এসেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মবিমুখ (অমুসলিম)। আমি কি তাঁর আত্মীয়তা রক্ষা করব? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করো। (বুখারি, হাদিস : ২৬২০)। এরকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত বা দলিল কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট ভাবে জানা যায় ।
সুতরাং, ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার কোনো স্থান নেই। বরং ইসলাম ধর্ম সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার কায়েম কে সমর্থন করে, যা ইসলামের ইতিহাসে জলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তবে ইসলাম ধর্মে অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে মুসলিমদের নিষেধ করা হয়েছে । যখন মক্কার মুশরিকরা নবিজির কাছে প্রস্তাবনা পেশ করল যে, ‘এসো আমরা একবছর আমাদের মূর্তিগুলোর পূজা করি, আর পরের বছর আল্লাহর ইবাদত করি।’ নবিজি (সা.) দৃঢ়তার সাথে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন আল্লাহ তায়ালা সুরা কাফিরুন নাযিল করেন।
বলুন, হে কাফিররা! আমি ইবাদত করি না, তোমরা যার ইবাদত কর। তোমরাও তার ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি। আমি ইবাদতকারী নই, যার ইবাদত তোমরা কর। তোমরা তার ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের দীন তোমাদের জন্যে, আমার দীন আমার জন্যে। (সুরা কাফিরুন)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে যেই জাতির সাদৃশ্য বা সাযুজ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ, আসসুনান : ৪০৩১)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, তোমরা কাফির-মুশরিকদের উপসনালয়ে তাদের উৎসবের দিনগুলোতে প্রবেশ করো না। কারণ সেই সময় তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে থাকে।’ (আবদুর রাযযাক, আলমুসান্নাফ : ১৬০৯)। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তোমরা গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সাহায্য করো না।’ (সুরা মায়িদা ৫ : ২)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় অন্যায়।’ (সুরা লুকমান ৩১ : ১৩)।
পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও হাদিস দ্বারা ভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে । এটা অন্যান্য ধর্মের জন্যও প্রযোজ্য। কেননা, অন্য ধর্ম তাদের অনুসারীদের কাছে সত্য এবং বিশ্বাসের জায়গা কিংবা আবেগের জায়গা, সেই হিসেবে ঐ ধর্ম কখনই ইসলাম ধর্মের অথবা অন্য কোনো ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাকে সমর্থন করে না বা করতে পারে না । তদ্রুপ ইসলাম ধর্মেও মুসলিমদের অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে শুধু বিশ্বাস, আবেগ ও ধর্মের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে, অন্য কিছুর জন্য নয়।
কিন্ত ইসলাম ধর্মে মুসলিমদের অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মুসলিমদের অন্য ধর্মের লোকজন তাদের ধর্মীয় কার্যাবলি সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে আদেশ করা হয়েছে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আদেশ করা হয়েছে । যদি কেউ নিজেকে প্রকৃত মুসলিম বলে দাবি করে তাহলে তাকে অবশ্যই অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে তৎপর থাকতে হবে।
অবশেষে বলা যায়, ইসলাম কখনই সাম্প্রদায়িক হামলা এবং অন্য ধর্মের লোকদের প্রতি অবিচার করা কে সমর্থন করে না । সুতরাং যে বা যারা বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সহ অন্যান্য ধর্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়, তাদের কঠোর আইন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত । যাতে আমার এই সোনার বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ও বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান স্বাধীন ভাবে সম্পন্ন করতে পারে এবং একই সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।