চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানবতার পরম বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর মিশনের আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রীতি ও সম্প্রীতি। নানা মত নানা পথে বিভক্ত মানবতাকে একই পতাকার শান্তিময় ছায়াতলে, প্রশান্তির নান্দনিক সুখময় শিবিরে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস ছিল তাঁর সমগ্র জীবনে। তাঁর চিন্তা চেতনা, নিত্য ভাবনার কোথাও তিনি মানুষকে সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘুর বিভক্তিতে বিভাজন করতে না বরং তিনি সমগ্র মানবতাকে একই পিতার সন্তান হিসেবে একই পরিবারভুক্ত বিবেচনা করতেন। ধর্ম মানুষের জন্য, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনে মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য জগতস্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ধর্ম সৃষ্টি করেছেন। ধর্ম হলো মহান রবের বিশেষ অনুগ্রহ, মহান বিধাতার মহা নির্দেশনা, আর তা বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব নবী রাসুলগণের। তাই আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব মুহাম্মদ (সা.) পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ইসলাম নামক ধর্মের মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যের মহামিলনে একত্রিত করার মহামিশনে প্রেরিত হয়েছিলেন।
জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশাকালে মানবতা বিনাশি দানবের বর্বরতায় আরব ভুখণ্ডসহ তৎকালিন পুরো জগত যখন প্রায় ধ্বংসের দারপ্রান্তে তখন মানবতাকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের মাঝে প্রীতিবন্ধন গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়, বিবাদমান সম্প্রদায়গুলোর মাঝে সখ্যতা ও সম্প্রীতিভাব গড়ে তোলার জন্য জগতের মানুষকের একত্ববাদ তথা সিরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখানোর জন্যই মুহাম্মদ (সা,) এর শুভ আগমন ঘটে। তাঁর শৈশব কৈশর যৌবন পৌঢ়কাল অধ্যয়ন পূর্বক সামগ্রিক মুল্যায়ন ও বিশ্লেষনে যা অনুমিত হয়, তা হলো তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন মানবপ্রেমি, প্রীতি ও সম্প্রীতির সেরা আদর্শ মহামানব। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) শৈশবের গন্ডিতে সর্বসাধারণের কাছে ‘আল-আমিন’ পরিচয়ে পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। অবিশ্বাসের চরম শুণ্যতার যামানায় তিনি ছিলেন সকলের পরম অস্থাভাজন। তৎকালীন যুগের কোন রাজা বাদশাহ, প্রভাব প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গও জনতার হৃদয়ের আঙ্গিনায় নুন্যতম বিশ্বাসের স্থানে পৌঁছতে পারেনি। সে সময়কার মানুষের মনে থাকতো একধরণের ভীতি, অবিশ্বাসের ঢালপালা, যা পুরো সমাজে ছেয়ে যাওয়ার কারণে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারতো না। যে হৃদয়ে অবিশ্বাসের ভীতি থাকে সে হৃদয়ে কখনো প্রীতি কাজ করে না। বিশ্বনবী (সা.) এর বিশ্বস্ততা ও পরম অস্থার নীতি জনগণকে তাঁর প্রীতিতে আবদ্ধ করে, যদ্দরুন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ তাঁর পরম গুণমুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলে ডাকে। পবিত্র কুরআন মাজিদে তাঁর এ চরিত্র মাধুর্য ‘খুলুকে আযীম’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সুরা ক্বালাম: আয়াত: ৪)। বিশ্বনবী (সা.) নিজেই তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য।’ (কানযুল উম্মাল)। খাদীজা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নি:স্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন। (সহীহ বুখারী: হাদিস নং ১/৩)।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল নবী (সা.) এর ফিতরাতগত অভ্যাস। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন কখনো ঘৃণা করতেনা, মানুষকে কাছে টানতেন কখনো দুরে সরিয়ে দিতেন না, জালিমের জুলুমে মজলুম হয়েও প্রতিশোধ নিতেন না বরং ক্ষমা করে দিতেন। তাঁর মানবপ্রীতির এ চিত্রটি তাঁর বক্তব্য ও কর্মে ফুটে উঠে। উক্ববাহ বিন আমের (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার সঙ্গে যে আত্মীয়তা ছিন্ন করেছে, তুমি তার সাথে তা বজায় রাখ, তোমাকে যে বঞ্চিত করেছে, তুমি তাকে প্রদান কর এবং যে তোমার প্রতি অন্যায়াচরণ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। (আহমাদ: ১৭৪৫২, মুস্তাদরাকে হাকেম: ৭২৮৫)। মানবতাবোধের উত্তম উদহারণ রাসুল (সা.) এর জীবনে ভোবে দেখা যায়, এক বুড়ি না বুঝেই ইসলামের বিরোধিতা করত এবং নবী করিম (সা.) কে কষ্ট দেয়ার জন্য মসজিদে যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হল কিনা এই ভেবে দয়ার নবী (সা.) বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। তিনি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পরিচয় পেয়ে বুড়ি হতবাক হলে গেল। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।
বিশ্বনবী (সা.) এর মানুষের প্রতি, অসহায়েরে প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার চিরচেনা রূপটি বিশ্ববাসির নজরে এরকম বর্ণিত রয়েছে, ঈদের দিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি শিশু কাঁদছে। রাসুল (সা.) সে পথে যাওয়ার সময় শিশুটিকে এ অবস্থায় দেখে আবেগমাখা সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে?’ শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা নেই। ঈদের দিনে নতুন কাপড় আমার নেই। আমার সাথীরা নতুন কাপড় পরে খেলাধুলা করছে।’ দয়ার নবী শিশুটিকে নতুন কাপড় কিনে দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) কে বললেন, তোমার জন্য একটি ভাই নিয়ে এসেছি। তুমি জলদি করে তাকে গোসল দিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও। কিছু মিষ্টান্ন খাইয়ে দিয়ে শিশুদের সঙ্গে খেলতে পাঠিয়ে দাও। হজরত ফাতেমা (রা.) শিশুটিকে নতুন কাপড় পরালেন। শিশুটি মনে আনন্দের দোলা বয়ে গেল, শিশুটি পিছনের দুঃখ ভুলে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল।
বিশ্বনবী (সা.) এর সম্প্রীতির আদর্শ দুটি নমুনা আমরা দেখতে পাই, একটি হলো নবুয়াতের পুর্বেকার অপরটি হলো নবুয়াতের পরবর্তী সময়ের। ঘটনা দুটি হলো, মক্কার বিবাদমান সকল গোত্রই পবিত্র কাবাঘর পুনঃনির্মাণকে সৌভাগ্য ও মর্যদার প্রতীক মনে করতো। কাজেই তারা সকলে মিলে বিবাদ বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাবা পূণঃনির্মান কাজ সমাধা করলেন। পূর্বেই কাবাঘরের মাঝে স্থাপিত হয়েছিল জান্নাতি ‘শ্রুভ্রপাথর’ যা পাপশোষনের কারণে কালো হয়েছে যাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বলে। উক্ত পবিত্র পাথরখানা কাবাশরীফের যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে সকলপক্ষই তীব্র দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হবার উপক্রম হয়। কেননা এ প্রতিস্থাপন কর্মটি ছিল বড়ই মর্যাদার ও মহাগর্বের। তাই সকল পক্ষ চাচ্ছিলো এ গৌরব নিজেরাই অর্জন করুক। আসন্ন এ চরম কঠিন বিপদসংকুল ও সংঘাতময় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নবী (সা.) সম্প্রীতির বাতাবরণে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে একখানা চাদর এনে তার চতুষ্কোন বিবাদমান পক্ষগুলোর হাতে দিয়ে আর স্বয়ং নিজে ‘হাজরে আসওয়াদকে’ উক্ত চাদরে রেখে কাবায় গিয়ে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে মহাসংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করলেন। সকল পক্ষই সন্তুষ্ট ও পরম খুশি হলো, সম্প্রীতি ও প্রীতিতে বলিয়ান হয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে আলিঙ্গন করলো। সবাই নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করলো। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আর রাহিকুল মাখতুম, সিরাতে ইবনে হিশামের আলোক)।
ইসলাম প্রীতি ও সম্প্রীতির ধর্ম। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয়তম রাসুলকে (সা.) পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ তাওহিদবাদী মানবিক পরিবেশ কায়েমের জন্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)। মক্কা হতে মদিনায় হিজরতের পর নবী (সা.) সেখানকার ‘আওস ও খাজরাজ’ গোত্রের মাঝে সম্প্রীতির আবহে ভাতৃত্ববোধ গড়ে তুললেন। তাদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সংঘাতকে তিনি শান্তির মহামিলনে উপসংহার টানলেন। মদিনায় মুসলিম, ইহুদি, খৃষ্টান ও অপরাপর ধর্ম বিশ্বাসীদের মাঝে সহবস্থান তৈরী করেন। মদীনায় অসাম্প্রদায়িক, আদর্শ সমাজ, সুখি-সমৃদ্ধ আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তিনি ‘মদিনা সনদ’ নামক বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকরি করেন। যার ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে পুর্বতন ইয়াসরিব নগরী ‘মদীনাতুন্নবী’ নামে সম্প্রীতি ও প্রীতির আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে নতুন পরিচয় লাভ করে।
মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে অনিবার্য রক্তক্ষয়ী সংঘাতকে সম্প্রীতির মাধ্যমে সমাধান করেন। তিনি মক্কাবিজয় এর পর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে তৎকালিন বিশ্বে সম্প্রীতির যে নজির কায়েম করলেন, তা বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার। মুলতঃ এ বিষয়টি এজন্য হয়েছে যে, তিনি মানবতার নবী, সাম্যের নবী, সম্প্রীতির নবী, প্রীতির নবী, নীতির নবী, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির নবী। তিনি অনৈক্য ও দলাদলির বদলে মানুষের মাঝে ঐক্য, ভাতৃত্ব, সহবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মমত্ববোধ কায়েম করেছেন।
পরিশেষে, মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর শ্বাশত ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ সুন্নাহ যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।