পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বে যতগুলো প্রধান ধর্ম প্রচলিত রয়েছে তার অন্যতম বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অহিংসতা। বৌদ্ধ ধর্মের এই অহিংস বৈশিষ্ট্য সম্প্রতি নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে বৌদ্ধদের এই অনন্য বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে বৌদ্ধদের মধ্যে জঙ্গীবাদের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বৌদ্ধদের মধ্যে জঙ্গীবাদের উত্থানের শিকার হচ্ছে মিয়ানমারে দীর্ঘকাল ধরে বসবাসরত মুসলমানরা। এটা আশ্চর্য ও অবাস্তব হলেও এটাই বর্তমানে করুণ সত্য হয়ে দেখা দিচ্ছে মিয়ানমারের বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা তথা ভিক্ষুদের এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনাকাক্সিক্ষত পদক্ষেপের কারণে। ফলে তারা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিবেশী মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশে। এর পরিণতিতে অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত মুসলমানদের, (যারা রোহিঙ্গা হিসাবে পরিচিত) মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দিলেও এটা বাংলাদেশের জন্য একটা অতিরিক্ত বোঝা তথা সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে মিয়ানমারের এসব মুসলমান বাসিন্দা ফেরৎ নেয়ার আবেদন জানানো হলেও ঐ দেশের নেতারা বাংলাদেশের সে আবেদনে সাড়া তো দিচ্ছেই না উল্টা অভিযোগ করছে যে তারা নাকি বাংলাদেশী নাগরিক এবং তারা অন্যায়ভাবে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা আরও ঘোষণা দিয়েছে, মিয়ানমার একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র তাই এখানে কোন অ-বৌদ্ধ তথা মুসলমানের ঠাঁই হতে পারে না।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হলেও এদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু অমুসলমান তথা বৌদ্ধ বাস করে। তাছাড়া মুসলিমপ্রধান এ বাংলাদেশে বহু হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের লোক পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বাস করছে। এমন কারণে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক শান্তির দেশ হিসাবে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
মিয়ানমারের সমুদ্র-উপকূলস্থ অঞ্চলসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকূলস্থ অঞ্চলে প্রাচীনকাল হতেই আরব দেশের সাথে সমুদ্র-পথের মাধ্যমে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠায় পরবর্তীকালে ঐসব অঞ্চলের আরব বনিকদের সাথে আনা ইসলাম-প্রচারকদের প্রভাবে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ ইসলামের সুশীতল ছায়া আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের বংশধররাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। সুতরাং রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্মগ্রহণের কারণে মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। এ পরিস্থিতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে মিয়ানমারের পূর্ব দিকের বৌদ্ধ প্রধান দেশ এবং সেসব দেশেও মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলস্থ আরাকান (বর্তমান নাম রাখাইন) প্রভৃতি অঞ্চলে সমুদ্র-সংলগ্ন অঞ্চলসমূহে বসবাসরত মুসলিম অধিবাসীদের সঙ্গে।
আসলে পৃথিবীর কোন দেশেই শুধুমাত্র একটি ধর্মের বসবাস করে না। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে অন্যান্য ধর্মের অনেক লোক বাস করে। আবার খৃস্টান-প্রধান ইউরোপ ও আমেরিকায়ও বহুধর্মের লোক পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বাস করছে, যেমন মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লোক শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। সুতরাং মিয়ানমার প্রভৃতি বৌদ্ধ-প্রধান দেশে অবৌদ্ধ (যেমন মুসলিম) ধর্মের কেউ বসবাস করতে পারবে না, এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, কারণ এ ধরনের বক্তব্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ এবং জাতিসংঘের অনুমোদিত মানবাধিকার সনদের সম্পূর্ণ বিরোধী।
যারা মিয়ানমারে আরাকান অঞ্চলে মুসলমানদের বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে সে দেশ থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে দাবী করে, তারা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস পর্যন্ত জানার চেষ্টা করেনি, এটা দু:খজনক। বিখ্যাত বৌদ্ধ গবেষনা বিষয়ক ‘টেকনাফ থেকে খাইবার’ গ্রন্থ পাঠে আমরা জানতে পারি, সমগ্র উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে মাটি খুঁড়লেই যে বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়, তাতে প্রমাণিত হয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই একদা বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ। অথচ সেই ভারতে এখন বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। এর কারণ ইতিহাসের এক পর্যায়ে উগ্রপন্থী হিন্দু শাসনের আমলে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ-বিরোধী অভিযান শুরু করা হয়। হিন্দু উগ্রপন্থী শাসকের দেখা দেখি ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও অনুপ্রাণিত হয়ে ফতোয়া (ধর্মীয় বিধান) দেয় যে, বৌদ্ধকে দেখামাত্র যে তাকে হত্যা করবে, তার স্বর্গবাসের সৌভাগ্য হবে অনন্তকালের জন্য। আর কেউ যদি কোন বৌদ্ধকে দেখার পরও তাকে হত্যার চেষ্টা না করে তাকে অনন্তকাল পর্যন্ত নরকবাস করতে হবে।
এর ফলে ভারতে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা প্রাণে বাঁচতে উত্তরে তিব্বত প্রভৃতি অঞ্চলে, দক্ষিণে শ্রীলংকায় এবং পূর্বদিকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লন্ডন, কম্বোডিয়া অঞ্চলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে ভারতে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের আজ ভারতে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে যেসব দেশে বৌদ্ধরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়, সেসব দেশই এখন বৌদ্ধ প্রধান দেশ হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে এভাবে যখন বৌদ্ধ বিরোধী ও বৌদ্ধনিধন অভিযান চলছে, প্রায় সে সময়ই ইসলামের সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শ ইসলাম নিয়ে ইসলামের প্রচারকগণের সঙ্গে এদেশের জনগণের পরিচয় ঘটে। তখন এদেশে বসবাসরত নিপীড়িত বৌদ্ধদের অনেকেই হিন্দু ধর্মের তুলনায় ইসলামের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের অধিকতর সাযুজ্য রয়েছে বিবেচনায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
সুতরাং বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের কোন মৌলিক শত্রæতার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ মিয়ানমারের দেখাদেখি শ্রীলংকানরাও একশ্রেণীর বৌদ্ধ নেতা ভুলের বসবর্তী হয়ে মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে শ্রীলংকা থেকে মুসলিম-নির্মূলের আহŸান জানিয়েছেন। মুসলিম-বিরোধী তাদের এ মনোভাব শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারও পরিচায়ক।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এখানে মুসলিমদের সাথে শান্তিতে বসবাস করছেন অনেক অমুসলমান, যাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক হিন্দু, বৌদ্ধ প্রভৃতি অন্যান্য ধর্মের মানুষ, এমনকি খৃস্টানও যারা একদা-সা¤্রাজ্যবাদী হিসাবে এদেশ অন্যায় দখল করে প্রায় দু’শ’ বছর এদেশ শাসন করেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা আন্দোলন করে উপমহাদেশকে স্বাধীন করেছে।
এ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায় শুরু হয় ১৭৫৭ সালে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেন কর্তৃক এদেশ দখলের পরপরই।
প্রথম একশ’ বছর এ আন্দোলন ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মধ্যে ছিল ফকীর আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁসের কিল্লার যুদ্ধ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুধু মিয়া প্রমুখের ফরায়েজী আন্দোলন এবং বিভিন্ন কৃষক নেতার সংগ্রাম এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব। কিন্তু দু:খের বিষয়, প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের অসহযোগিতার কারণে এসব যুদ্ধ জনগণকে পরাজয় বরণ করতে হয়। সিপাহী বিপ্লবের পরাজয়ের পর তদানীন্তন নেতৃবৃন্দ নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামের দু’টি রাজনৈতিক সংগঠন নেতৃত্বে ছিল। এরমধ্যে কংগ্রেসের দাবী ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষকে একিট অখÐ দেশ হিসাবে স্বাধীনতা দিতে হবে। অপর পক্ষে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দাবী ছিল উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা সমূহকে নিয়ে একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯৪৬ সালের এই ইস্যুতেই অনুষ্ঠিত হয় এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের উপমহাদেশের মুসলিম লীগের স্বাধীকার দাবী মুসলিম জনগণের দাবী হিসাবে জয়লাভ করে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধুষিত এলাকা সমূহ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার গোপন চেষ্টা শুরু করা হয়, যার প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্ট কার্ড, এনভেলপ, মানিঅর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহার দেখে। তাছাড়া রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রাজধানী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও এয়ার ফোর্সসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ব্যবহার শুরু হয়।
ফলে প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন প্রভৃতি আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধিকার চেতনা এবং এই স্বাধিকার-চেতনা পাকিস্তান বাহিনী পশু বলে ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মরণপণ সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়।
আমরা এ লেখা শুরু করেছিলাম মিয়ানমারে মুসলিম-বিরোধী অভিযান সম্পর্কে। এ অভিযানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ পর্যন্ত প্রতিবাদ জানিয়েছে। মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দ এক মন্তব্যে বলেছেন, মুসলমানরা জাতিসংঘকে প্রায় কিনে নিয়েছে। একথা যে কত বড় অসত্য তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তাদের এ বক্তব্য সত্য হলে ফিলিস্তিন আজও ইসরাইলের দখলে থাকে কী করে? মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যা লুন্ঠন প্রভৃতি অকথ্য নির্যাতনই বা চালিয়ে যেতে পারছে কেমন করে? অথচ আমরা তো অতিরিক্ত কিছু চাই না। আমরা চাই বাংলাদেশসহ সকল দেশই যেন তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং মুসলিমসহ বিশ্বের কোন জাতিই জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।