Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি রুখতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের বর্ণবাদি সাম্প্রদায়িক টুয়িট বার্তা নিয়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে তখন চারজন নারী কংগ্রেসম্যানকে উদ্দেশ্য করে দেয়া ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রতিনিধি পরিষদ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এমনকি তারা অভিসংসন প্রস্তাব গ্রহণের কথাও বিবেচনা করছে। ঠিক এমন সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে নির্যাতনের শিকার অথবা সাক্ষি হিসেবে আমন্ত্রিত ২৭জন প্রতিনিধির অভিজ্ঞতা ও অভিযোগের কথা শোনেন। ট্রাম্পের এই বৈঠকটিকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের মত অভাজনদের মনে সহজেই দানা বাঁধতে পারে। সারাবিশ্ব থেকে তথাকথিত নির্যাতনের শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে এই সাক্ষাৎকার পর্বটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হলেও মাত্র ১৭টি দেশ থেকে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে সেখানে উপস্থিত হয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। তবে সেখানে আমন্ত্রিত সকলেই যে বিতর্কিত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গেছেন এমনটি হয়তো নয়। যেমন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে বন্দুক হামলায় স্ত্রীকে হারিয়ে নিজে বেঁচে যাওয়া এবং হত্যাকারিদের ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণাকারি ফরিদ আহমেদ, অথবা উইঘুর মুসলমানদের পক্ষ থেকে যাওয়া নারী প্রতিনিধি জাওহার ইলহাম, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মহিব উল্যাহ এবং মিয়ানমারের কাচিন স্টেট থেকে যাওয়া কাচিন ব্যাপ্টিস্ট চার্চের প্রেসিডেন্ট ডা: কালাম স্যামসনের বক্তব্য যৌক্তিক ও মানবিক বলেই মনে হয়েছে। ১৭ জুলাই ওভাল হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে অনুষ্ঠিত এই বিশেষ সাক্ষাৎকার সভার ভিডিও বাংলাদেশে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে উঠার পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। এই সাক্ষাৎকার দেখে যে কোনো সাধারণ বাংলাদেশির মনে হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন বাংলাদেশকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন এবং বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে ভুল লোকের ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচারের মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি যখন বললেন আমি বাংলাদেশের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে এসেছি, মি: প্রেসিডেন্ট স্যার আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই, আমাদের সাহায্য করতে আপনার পরিকল্পনা কি? প্রতিত্তোরে উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ট্রাম্প প্রশ্ন করে বসেন, বাংলাদেশটা যেন কোথায়? তার এই বালখিল্য আচরণকে হিপোক্রেসি অথবা বাংলাদেশকে ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় করার মানসিকতার বহি:প্রকাশ হিসেবে গণ্য হতে পারে। চীন ও ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিনীদের বেশকিছু কৌশলগত পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার চুক্তিও কার্যকর রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তা অজানা থাকার কথা নয়। এমনকি ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের কোনো একসময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের তৈরী শার্ট ও টাই পরে এসেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ সম্পর্কে তার চেনা জানা কোনো নতুন বিষয় নয়। প্রায় তিনবছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর যদি বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করতে হয়, এতে তার মানসিক অসুস্থতা(ডিমেনশিয়া) অথবা রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবই প্রমানিত হয়। ট্রাম্পের এহেন প্রশ্নে তার সহকারিকেও বিব্রত হতে দেখা গেছে। তিনি ট্রাম্পকে বললেন, মিয়ানমারের পাশের দেশটিই বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ কোথায় ট্রাম্প তা জানেননা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এহেন অবস্থান বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি ডায়াসপোরায় ব্যাপক আলোচ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পের এই বালখিল্যতাকে ছাড়িয়ে ওভাল অফিসের সংখ্যালঘু প্রতিনিধি সমাবেশে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক নারী প্রিয়া সাহা। তিনি ট্রাম্পের কাছে কাঁেদা কাঁদো সুরে বলছেন, প্রেসিডেন্ট স্যার আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সেখানে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ও খৃস্টান ধর্মাবলম্বি মানুষ গুম হয়ে গেছে। এখনো সেখানে যে ১ কোটি ৮০ লাখ হিন্দু রয়েছে তাদের জমিজমা ও বাড়িঘর লুটে নিচ্ছে, আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে মুসলমান মৌলবাদিরা। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই, দয়া করে আপনি আমাদের সাহায্য করুন। যে লোক বাংলাদেশ কোথায় তাই জানেনা সে লোকটিকে যখন বলা হল সেখান থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাঁকে যথেষ্ট বিচলিত-চিন্তিত দেখা গেল। তিনি যেন তক্ষনি সেখানে সৈন্য পাঠিয়ে গুম হয়ে যাওয়া হিন্দুদের উদ্ধার করতে যাচ্ছেন, এমন ভাব দেখালেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা বক্তব্যে দেশে-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গত রবিবার দেশের বিভিন্ন আদালতে বেশ কয়েকজন প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করতে চেয়েও পারেন নি। হোয়াইট হাউজে গিয়ে একজন বললেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ গুম হয়ে গেছে, বাকি ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, জমিজমা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তিনি দেশে থাকতে পারছেন না, দেশে কোনো বিচার হয়না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন একটা কিছু করেন, যাতে তিনি দেশে থাকতে পারেন। প্রিয়া সাহা কোনো আদালতে মামলা করেছেন বা সরকারের কাছে নির্যাতনের অভিযোগ করে বিচার পাননি এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে প্রিয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে গত রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে দেয়া বক্তব্যের পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। তিনি সেখানে তৎকালীন বিরোধিদলের নেতা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে নিজের আত্মরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কবে কোটি কোটি হিন্দু নিখোঁজ হওয়ার দাবী করে বক্তব্য দিয়েছেন তার কোনো সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারেননি। তবে অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতাতের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বারাকাতের এক গবেষণায় প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৬৩২জন মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবুল বারাকাত বিভিন্ন সময়ে এমন অনেক তথ্য দিয়েছেন যা সাধারণভাবে উদ্ভট-অবাস্তব বলে মনে হয়েছে। মৌলবাদের অর্থনীতি বিষয়ক তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এক সময় অনেক মানুষের কাছে কৌতুহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য হিন্দুদের দেশত্যাগ সম্পর্কে আবুল বারাকাতকে উদ্ধৃত করে দেয়া প্রিয়া সাহার বক্তব্য বারাকাত ইতিমধ্যে প্রত্যাখান করেছেন। আবুল বারাকাতের এই দেশত্যাগ তত্ত¡ সঠিক হলে বছরে ২ লাখ ৩০ হাজার সংখ্যালঘু মানুষ দেশত্যাগ করেছে, ৫০ বছরে এ সংখ্যা দাড়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে উপস্থিত নির্যাতিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন, সেখানে সম্ভবত এমন আর একজনকেও খুঁেজ পাওয়া যাবে না, যেখানে উপস্থাপিত বক্তব্যে সত্য বা বাস্তবতার লেশমাত্র নেই।

আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রিয়া সাহার দেয়া ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৯.৭ ভাগ। এখন তা ৯ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে, যদি সংখ্যালঘু জনসংখ্যা একই হারে বাড়ত তাহলে সংখ্যাটা ৩ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি হত বলে দাবী করেছেন। সংখ্যাটা যাই হোক, গত ৭০ বছরে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে, এই তথ্য মিথ্যা নয়। একই সময়ে ভারত থেকেও লাখ লাখ মুসলমান পরিবার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এসেছে। এটি ঔপনিবেশোত্তর ভারতবর্ষের দেশভাগ ও ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের বাস্তবচিত্র। বড় বড় দাঙ্গা ও হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমানের রক্তাক্ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে তৈরী হওয়া নতুন দুই রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এই ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের একজন মুসলমান রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, ভারতে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা এবং হিন্দুদের নির্যাতনই প্রমান করে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মুসলমান হলেও সেখানকার সরকারী কর্মসংস্থানে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ২ ভাগের বেশি নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৯ শতাংশ হিন্দু ২৫ শতাংশের বেশি সরকারী চাকুরিতে নিয়োগ পেয়েছে। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর শাসন চলছে। যাই হোক, প্রিয়া সাহা যে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ ট্রাম্পের কাছে করলেন, তা যদি আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিকে দিয়ে করানো যায়, তাহলে তিনিও বলতে পারতেন বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৭ কোটি বৌদ্ধ নিখোঁজ হয়ে গেছেন। কারণ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের আগে, বাংলায় পাল রাজবংশের শাসনকাল পর্যন্ত বৌদ্ধদের প্রাধান্য ছিল। খৃস্টীয় পঞ্চম শতকে চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশমান অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ শতকে একজন চীনা বৌদ্ধ সন্নাসি উত্তর ভারত সফরে এসে নাকি বৌদ্ধদের চরম পরিনতি দেখে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অক্সফোর্ডের আর্লি হিস্টোরি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদি হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধমঠগুলি ধ্বংস করে মঠ সন্যাসিদের বিতাড়িত করেন। ভারত থেকে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মাবলম্বিদের বিতাড়নে ব্রাহ্মণ্যবাদিদের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। প্রিয়া সাহা ৭০ বছর আগের বাংলাদেশে ২৯ ভাগ হিন্দু জনসংখ্যার কড়চা তুলে ধরে ৩ কোটি ৭০ লাখের হিসাব দাঁড় করাতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ বা ভারতের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা দেড় হাজার বছর আগের সমাজচিত্রের সাথে মিলিয়ে ভারত থেকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোটি কোটি মানুষ বিতাড়িত বা নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ তুলতেই পারেন। তবে ভারত-বাংলাদেশের বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যবাদি হিন্দুদের নির্যাতনে ধর্ম অথবা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেও বর্তমানে যে সব হিন্দু বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছে তারা সম্পুর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যাচ্ছে। সেখানে ধর্মের চেয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাই মূল ভ’মিকা রাখছে। এখন হিন্দুত্ববাদিরা ভারতের মুসলমানদের টার্গেট করেছে। তবে হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের দরবারে চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা হাজির হলেও বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের দেশ ভারতের কোনো প্রতিনিধি না থাকা বিষ্ময়কর। সেখানে শুধুমাত্র গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা সাধারণ বিষয়ে পরিনত হয়েছে। সেখানে নতুন নাগরিকত্ব আইন করে কোটি কোটি মুসলমানকে রোহিঙ্গাদের মত নাগরিকত্বহীন করে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্র চলছে। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ মুসলিম পরিবার এখন ভারতের হিন্দুত্ববাদিদের সৃষ্ট কৃত্রিম নাগরিকত্ব সংকটের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বা অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হওয়ার যে কোনো ঘটনার চেয়ে এটি অনেক বড় সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নিরবতা এবং তলব করে প্রিয়া সাহাদের দিয়ে বাংলাদেশ বিরোধি বক্তব্য জাহির করা, বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করার মধ্যেই বাংলাদেশের মুসলিম বিদ্বেষী একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়।

হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সাথে বিশ্বের নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সভাটিকে মধ্যযুগের কোনো মহারাজার দরবার বলে মনে হয়েছে, যেখানে প্রজারা রাজার সামনে চেয়ারে বসার অনুমতি পান না। লোকগুলো ট্রাম্পের আসনের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে, তিনি একেকজনকে ডেকে তার পরিচয় ও আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করছেন আর বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নিজের উদাসীনতা অথবা বালখিল্যতার জানান দিচ্ছেন। একবার বলছেন, বাংলাদেশ যেন কোথায়! ইরাকের ইয়াজিদি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নাদিয়া মুরাদকে বলছেন, আপনিই তো নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কি জন্য পেয়েছিলেন বলুন তো! বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা লোক বা দেশগুলো সম্পর্কে তার কোনো পূর্ব ধারণা নেই, এমন হওয়া অসম্ভব। আর লোকগুলোকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটেবিলে বসে মত বিনিময়ের বদলে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে কেন কথা শোনা হল তা সত্যিই বিষ্ময়কর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর খবরদারি করছে, অথচ নিজ দেশেই শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা অস্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অভিবাসিদের নিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রে এখন নতুন অভিবাসন আইনে শিশুদেরকে পিতা-মাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার উদ্ভট অমানবিক আচরণ আরোপ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। সেখানে বেছে বেছে কিছু দেশের কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের আরোপিত অথবা প্রিয়া সাহার মত মনের মাধুরি মেশানো আজগুবি মিথ্যাচারের প্রশ্রয় দিয়ে কি তারা প্রকারান্তরে কোনো গোপণ এজেন্ডার পেন্ডোরার বাক্স খুলে দিলেন? এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ইরানের কথিত খৃস্টান প্রতিনিধি কোনো তথ্য-প্রমান ছাড়াই নির্যাতনের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। তবে প্রিয়া সাহার মিথ্যাচার অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। শুধু তাই নয়, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মিথ্যাচারের ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা বিক্ষুব্ধ মানুষকে তিনি আরো নতুন কিছু মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি মানুষের ক্ষোভ আরো বাড়িয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে নিজের অনুপ্রেরণা বলে দাবী করেছেন। অর্থাৎ তিনি নিজের মিথ্যাচারের বোঝা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘাঁড়ে চাপিয়ে পার পেতে চাচ্ছেন। প্রিয়ার সাহার মিথ্যা বক্তব্যের পেছনে মার্কিন দূতাবাসের দূরভিসন্ধি থাকতে পারে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়। জয় তার ফেইসবুক পোস্টে প্রিয়া সাহার এই মিথ্যাচারকে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুতের অভিসন্ধি বলে মনে করেন। প্রিয়া সাহা তার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে সেখানে যাননি। তাঁকে বিশেষ আমন্ত্রণে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কে, কেন, কিভাবে জরুরীভাবে ওয়াশিংটনে উড়িয়ে নিল এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্যপরিষদের মনোনীত অন্য প্রতিনিধিদের বাইরে রেখে প্রিয়া সাহাকে ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিল। এটি নি:সন্দেহে অনেক উপরি মহলের কাজ। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর কল্পিত নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এখানে মোদির হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছিলেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের কতিপয় নেতা। এসব অভিযোগ, মিথ্যাচার এবং হস্তক্ষেপ কামনার ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট একই সূত্রে গাঁথা। তারা বাংলাদেশে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নস্যাৎ করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার ও বিদেশি হস্তক্ষেপের পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের অবস্থান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্যের ব্যানারে আসলে তারা কি চায়? আমার বিশ্বাস একটি অসাধু চক্র নিজেদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলে দাবী করলেও এরা দেশের শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা হয়তো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেদেরকে ব্যবহার করছেন। ইতিমধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ ইতিমধ্যে প্রিয়া সাহাকে সংগঠন থেকে বরখাস্ত করেছে এবং ভারতের বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাকে লুফে নিয়েছে। এভাবে সম্ভবত বাংলাদেশ বিরোধী প্রিয়া সাহার নতুন এপিসোড শুরু হতে যাচ্ছে। এদের কর্মকান্ডে নজরদারি ও আইনগত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

[email protected]



 

Show all comments
  • হাঃমাওঃ শিব্বির আহমদ হাবিবী ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৩ এএম says : 0
    তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক এবং তার স্বামীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হোক
    Total Reply(0) Reply
  • Thither Hossain Dider ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৩ এএম says : 0
    ওকে দেশে এনে ক্রস ফায়ার করে মারতে হবে
    Total Reply(0) Reply
  • Ariful Haq ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৪ এএম says : 0
    দেশের বিরূদ্ধে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর হস্তক্ষেপ করার আবেদন নাকি দেশদ্রোহিতা নয় । তবে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের কাছে এরকম আবেদন কেউ জানালে এতক্ষনে তার ফাঁসীর আদেশ দেয়া হতো ।এর নাম নাকি জাতীয় সরকার ?
    Total Reply(0) Reply
  • Shariful Islam ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৫ এএম says : 0
    সব গুলোই বেঈমান। আর এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এর পাঠানো প্রতিনিধি হল প্রিয়া সাহা । তারা বুঝতে পারে নাই যে এবিসি টিভি লাইভে চলে আসবে। তাই ফেঁসে গেছেন। তবে তার কোন কিছু হবেও না। কারন তার পিছে অনেক হাত আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sardar Abdur Rahman ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশে সরকারী কর্মচারীদের ২৫ শতাংশ হচ্ছে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ ।। প্রিয়া সাহার অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা
    Total Reply(0) Reply
  • tarek prodhan ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৭ এএম says : 0
    প্রিয় সাহা নিজে যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান হল তার চেয়ে বড় বিষয় হলো সে মাইনরিটিদের চিরস্থায়ী ভাবে অবিশ্বস্ত বেনে দিলো ।
    Total Reply(0) Reply
  • নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশকে ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-ইয়েমেন বানাতে প্রিয়ার মত কাউকেই চাইছিল ট্রাম্প। ট্রাম্প এখন মৌলবাদি নির্মূলে বাংলাদেশে আসবে আর প্রিয়া? উনি তো আমেরিকায় তার মেয়েদের কাছে থাকার মতো কাজই করে ফেলেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Forhad Manna ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:০৯ এএম says : 0
    বাংলাদেশ সরকার যেভাবে হিন্দু বোদ্ধ খ্রিস্টানদের সাপোর্ট দেয় এবং দেশের সাধারণ মানুষ যেমন পিসফুল অন্যধর্মের প্রতি এভাবে যদি অন্যান্য এশিয়ান দেশ করত তাহলে এশিয়ায় শান্তির অভাব হতো না। হিন্দুরা যে কতো বেশি পরিমাণ অগ্রাধিকার পায় চাকরির ক্ষেত্রে তা দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান থানা অফিসগুলোতে গেলে দেখা যায়।
    Total Reply(0) Reply
  • Adib ২৪ জুলাই, ২০১৯, ২:১০ এএম says : 0
    বাহ্, আমরা এত সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী জানতাম না তো। আমিতো শুনেছিলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো যেমন বিজেপি, আরএসএস পাশের দেশের ক্ষমতায় বসে আছে। গরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে সেখানে মুসলমানদের পিটিয়ে মারা হয়, জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হয় আরো কত কি। এছাড়া আমাদের আরেক "কৃতি" প্রতিবেশী মিয়ানমারও তাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অবৈধ অধিবাসী বলে খুন, হত্যা, ধর্ষণ করে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। আমাদের প্রতিবেশীদের পদাচরণ অনুসরণ করলেই কি আমরা তবে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে বিবেচিত হতে পারতাম?
    Total Reply(0) Reply
  • Rubel Shorif ২৪ জুলাই, ২০১৯, ১০:৫৫ এএম says : 0
    সব গুলোই বেঈমান। আর এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এর পাঠানো প্রতিনিধি হল প্রিয়া সাহা । তারা বুঝতে পারে নাই যে এবিসি টিভি লাইভে চলে আসবে। তাই ফেঁসে গেছেন। তবে তার কোন কিছু হবেও না। কারন তার পিছে অনেক হাত আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Rubel Shorif ২৪ জুলাই, ২০১৯, ১০:৫৬ এএম says : 0
    বাংলাদেশ সরকার যেভাবে হিন্দু বোদ্ধ খ্রিস্টানদের সাপোর্ট দেয় এবং দেশের সাধারণ মানুষ যেমন পিসফুল অন্যধর্মের প্রতি এভাবে যদি অন্যান্য এশিয়ান দেশ করত তাহলে এশিয়ায় শান্তির অভাব হতো না। হিন্দুরা যে কতো বেশি পরিমাণ অগ্রাধিকার পায় চাকরির ক্ষেত্রে তা দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান থানা অফিসগুলোতে গেলে দেখা যায়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্প্রীতি


আরও
আরও পড়ুন