Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ রেলওয়ের পিছিয়ে পড়া এবং কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সভ্যতার সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নাকি রেলপথ ধরে আসে। এটা ঔপনিবেশিক আমলের একটা প্রবাদ বাক্য। ইউরোপে অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল প্রথমত: সামুদ্রিক বাণিজ্যপোত আবিষ্কার এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শ্রমিক, কাঁচামাল সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দিয়ে সম্পদ বাড়ানোর প্রথম ও প্রধান অবলম্বন ছিল সামুদ্রিক নৌপথ ও জাহাজের উপর। একবিংশ শতকে আজকের দিনে তথ্যপ্রযুক্তির ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, ডিজিটালাইজেশন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির গেøাবালাইজেশনের যুগে এসেও নৌপথ-নৌ-বন্দর যে কোনো জাতির অর্থনীতি ও ব্যবসায় বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রেলওয়ের গুরুত্ব। দেশে দেশে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা, গণপরিবহণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থল বাণিজ্যের জন্য রেল যোগাযোগের গুরুত্ব মোটেই কমেনি। প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগ, ব্যবসাবাণিজ্য ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থা মূলত নদনদী ও নৌপরিবহন নির্ভর। স্থলপথ, সড়ক-মহাসড়ক নির্মান ও সড়ক পরিবহনের উন্নয়নের বাস্তবতা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। সে তুলনায় রেলপথ রেলপরিবহনের উন্নয়নকে অনেক বেশী প্রাচীন ও সমৃদ্ধ বলা যায়। আমরা প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন রেল যোগাযোগের উত্তরাধিকার বহন করছি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সুফল সারা বঙ্গ-ভারতে ছড়িয়ে দিতে এবং ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপের কলকারখানার জন্য শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও সমুদ্র পথে জাহাজিকরণ করার সুবিধার্থে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অত্যন্ত অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ ভাটি-বাংলায় রেলপথ নির্মানের মধ্য দিয়ে আধুনিক স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থার গোঁড়াপত্তন ঘটে। ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে রানাঘাট হয়ে দর্শনা ও কুষ্টিয়া পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলপথ চালু হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানীর উদ্যোগে পরবর্তি ৫০ বছরে এ দেশে রেলপথ যে বিস্তার ও উন্নয়ন লাভ করে এর পরের শত বছরেও তার সমান উন্নয়ন হয়নি বলা যায়। আর স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রেলওয়ে হয়ে উঠে সবচেয়ে অবহেলিত, স্থবির ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ। অথচ স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এবং পাটশিল্প প্রধান খুলনা-রাজশাহীতে নগরায়ন এবং শিল্প বিকাশের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে এ সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়েকে আধুনিক যুগোপযোগী ও অধিকতর সক্ষম করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের শাসকরা সে উদ্যোগ নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। উপরন্তু পুরনো রেলইঞ্জিন ও রেলকোচগুলোকে ব্যবহারোপযোগী রাখতে যথাযথ ওভারহোলিং বা সংস্কার করতে বা নতুন রেলইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহ করে ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও শহরমুখী মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের উপযোগি করে তোলার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ সময়ে সক্রিয় অনেক পুরনো রেলপথক ও রেলজাংশনগুলোর উন্নয়নের চাহিদা অগ্রাহ্য করে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে সড়কপথ নির্মান, উন্নয়ন ও সড়ক পরিবহণ খাতে। সড়কপথ ও সড়ক পরিবহনের অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের নামে জনগণের রাজস্ব থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়ক নির্মান, লেন বাড়ানো, নতুন নতুন সেতু, উড়ালসেতু ও হাজার হাজার কালভার্ট নির্মানের পেছনে যেভাবে যথেচ্ছ অর্থব্যয় করা হয়েছে তার সিকিভাগও যদি রেলের উন্নয়নে ব্যয় করা হতো তাহলে হয়তো আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বেশী বেগবান হতো। লক্ষকোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের এক বড় অংশই খরচ হয়েছে সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট নির্মান উন্নয়ন, সংস্কার ও সড়ক পরিবহন খাতে। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হয়েও দশকের পর দশক ধরে সেতু ও সড়ক নির্মানে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী ব্যয়ে নি¤œমানের অবকাঠামো নির্মান করেছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের রাজস্ব ও বৈদেশিক ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে, অন্যদিকে সারাদেশে অপরিকল্পিত রাস্তা, কালভার্ট ও সেতু নির্মান করে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি গ্রাস করা হয়েছে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগতভাবে দেশের বিশাল এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে।

সড়ক পথ ও সড়ক পরিবহণের উন্নয়ন অপ্রয়োজীয় বিষয় নয়। নৌপথ ও রেলপথের গুরুত্ব ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাহ্য করে কেন তা করতে হল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সড়কপথ সড়ক উন্নয়ন ও সড়ক পরিবহন আমদানির নামে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে, পক্ষান্তরে সড়ক পরিবহনের উপর সাধারণ মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়া এবং সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কাছে দেশের মানুষ কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে। ভাড়া নৈরাজ্য ও মনোপলি সৃষ্টি করে এই সিন্ডিকেট প্রতিদিন মানুষের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। সড়ক পরিবহণের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও যানজট নাগরিক জীবনে এক ভীতিকর অভিশপ্ত অবস্থা সৃষ্টি করেছে। সড়ক পরিবহণের মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেটেড সমিতি, ইউনিয়ন ও তাদের প্রভাবশালী গডফাদারদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সড়ক-মহাসড়কে গাড়ী চালকদের হাতে কার্যত মানুষ মারার লাইসেন্স তুলে দেয়া হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে কমপেক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত এবং এর কয়েকগুণ মানুষ আহত-পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। বছরে হাজার হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং রাজধানী শহরে প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মঘন্টা যানজটে বিনষ্ট হওয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষতির সঠিক অংক নিরূপণ করা কঠিন। রেলপথ- নৌপথ উন্নয়নের মাধ্যমে সড়কপথের উপর চাপ ও নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারলে এত এত প্রাণহানি,পঙ্গুত্ব ও সড়কপথের এসব বিড়ম্বনা অনেকটা কমিয়ে আনা অসম্ভব ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উন্নয়ন পরিকল্পনার নীতি নির্ধারকরা সে পথে হাঁটেন নি। রেলপথ-নৌপথের উন্নয়নকে অগ্রাহ্য করে তারা সড়কপথের উন্নয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বহুমাত্রিক দুর্নীতি, লুটপাট, জনভোগান্তি, বিড়ম্বনা ও জিম্মিদশাকেই যেন অবিশ্যম্ভাবি করে তুলেছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহণ ও আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নৌপথ ও রেলপথ অনেক বেশী সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। উজানে যৌথ নদনদীর উপর একের পর এক ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহারের কারণে পানিপ্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে পলি জমে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্য হারিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ায় অনেক রুটে নৌপরিবহন ব্যবস্থা অবলোপনের মাধ্যমে সড়ক পরিবহনকেই বিকল্পহীন করে তোলা হয়েছে। চীন,ভারতসহ দক্ষিন এশিয়ার দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে অগ্রসরমান দেশগুলো তাদের রেলপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে জোর দিলেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। দশকের পর দশক ধরে শত বছরের পুরনো রেলপথ, পুরনো লোকোমোটিভ ও লক্ক্কড়ঝক্কড় কোচগুলো বদলে যুগোপযোগি করে তোলার কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দেখা যায়নি। রেলের যাত্রি বাড়লেও রেলপথ, রেলের বগি-ইঞ্জিন, জনবল ও পুরনো অবকাঠামো, স্টেশন, ক্রসিং ও জাংশনগুলো ক্রমে সংকোচিত হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এমন নজির আছে কিনা আমাদের তা জানা নেই। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত ও চীন যখন তাদের উন্নয়নের বাহন হিসেবে তাদের পুরনো রেলপথগুলোর সাথে হাজার হাজার কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মান করেছেম সেই পুরনো ইঞ্জিনগুলো বদলে বিদ্যুত গতির ম্যাগলেভ ও বুলেট ট্রেনে রূপান্তরিত করে ট্রেনের গতি ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে, তখন আমাদের রেলমন্ত্রীরা বছরের পর বছর ধরে শুধু রাজনৈতিক লিপ সার্ভিস দিয়ে চলেছে। ট্রেনের বাজেট বাড়ছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক হলেও ট্রেনের গতি আগের চেয়ে কমছে। কয়েক বছর আগে এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০ বছর আগে যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের গতি ছিল ঘন্টায় ৬০-৭২ কিলোমিটার, সেখানে বর্তমানে তার গতি ৫০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। যাতায়াতের সময় আগের চেয়ে এক ঘন্টার বেশী বেড়েছে। অন্যদিকে ভারত ও চীনে রেলের গতি প্রতিবছরই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে।

আমাদের রেলওয়ের ইতিহাস পর্যাল্চোনা করলে দেখা যায়, বৃটিশরা লন্ডনে বিশ্বের প্রথম রেলপথ চালুর ২৫ বছরের মধ্যেই ভারতে রেলপথকে অন্যতম প্রধান পরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ১৮৬২ সালে প্রথম ইন্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানীর মাধ্যমে সূচিত বাংলাদেশের রেলপথ ১৯১৯ সাল নাগাদ ১৮০৬. ১৬ কিলোমিটারে দাঁড়ায় এবং ১৯৪৭ সালে উত্তরাধিকার সুত্রে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ের দৈর্ঘ ছিল ২৬০৬.৫৯ কিলোমিটার। পাকিস্তানের ২৩ বছরে বেঙ্গল রেলপথের দৈর্ঘ প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার বেড়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে রেলপথ ছিল ২৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার। এর তিন দশক পর ২০০০ সালের ১লা জুলাই তারিখে দেশের রেলপথের দৈর্ঘ দাঁড়ায় ২৭৬৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ একাত্তর সালে উত্তরাধিকারসুত্রে পাওয়া রেলপথ কমেছে প্রায় ৯১ কিলোমিটার। সাম্পতিক দশকে যমুনাসহ একাধিক রেলসেতু নির্মানের মধ্য দিয়ে রেলপথের দৈর্ঘ কয়েকশ কিলোমিটার বাড়ার কথা থাকলেও পুরনো অনেক লাইন অকেজো হয়ে পড়ায় এই প্রবৃদ্ধি তেমন দৃশ্যমান নয়। তবে ষাটের দশকে যেখানে যাত্রি ও পণ্য পরিবহণে রেলপথের অংশিদারিত্ব ছিল যথাক্রমে শতকরা ৫০ ও ৪০ ভাগ, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতা সামনে রেখেও রেলপথে যাত্রি ও পণ্য পরিবহনের হার যথাক্রমে ১২ ও ৭ ভাগে নেমে এসেছে বলে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। চীন ও ভারতের বাস্তবতা সম্পুর্ণ বিপরীত। সেখানে সড়ক উন্নয়নের চেয়ে রেলপথ ও রেলইঞ্জিনের গতি ও পরিষেবা বৃদ্ধি¦ই ছিল তাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও যোগাব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পরিকল্পনা। রেলপথের উন্নয়নের দৌড়ে গণচীনের অগ্রগতি সারাবিশ্বে বিষ্ময় সৃষ্টি করেছে। তারা এখন বিশ্বে সবচেয়ে দ্রæততম এবং বিস্তৃত রেলওয়ে চালু করেছে। ইউরোপ-আমেরিকাকে অনেক পেছনে ফেলে ঘন্টায় প্রায় ৪০০ কিলোমিটার গতির বুলেট ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে চীন। এই প্রতিযোগিতায় ভারতের নয়াদিল্লী থেকে ভুপাল পর্যন্ত শতাব্দী এক্সপ্রেস হাইস্পীড ট্রেনের গতি ১৫০ কিলোমিটার। এ গতিও বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম আন্তনগর ট্রেনের গতির চেয়ে ৩গুন বেশি। সময়ের সাথেখ পাল্লা দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বে রেলের গতি এবং রেলপথের দৈর্ঘ বেড়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিরল ব্যতিক্রম। সম্ভবত বৃটিশ আমলের ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানী আমলের গতির চেয়ে বর্তমান বাংলাদেশ রেলওয়ের গতি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পরিষেবা কমেছে। যেখানে মানুষ ত্রæত শহরমুখী হচ্ছে, অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি শিল্পের অবদান বেড়ে চলেছে, নদীগুলো নাব্য হারানোর কারনে নৌপরিবহন ক্রমে সংকোচিত হয়ে পড়েছে এবং সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা, যানজট এবং খরচ বেড়ে চলার বাস্তবতায় বাংলাদেশে রেলপথের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিব ব্যাপার। সেখানে রেলব্যবস্থার উন্নয়নের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রাখার একটি বিষ্ময়কর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আত্মঘাতি প্রবণতার নেপথ্যে একটি চক্র সক্রিয় আছে। যারা সড়ক পথে বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পরিবহনে বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, যারা এ খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বছরে শত শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। যারা বাংলঅদেশকে নি¤œমানের ভারতীয় গাড়ির ডাম্পিং স্টেশন বানিয়ে রাখতে চান। গাড়ি আমদানির ডিলারশিপ থেকে বছরে শত শত কোটি টাকা আয়ের পথ অবারিত রাখতে তারা সচেষ্ট থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ রেলের উন্নয়ন ঘটলে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে ওঠা দেশি-বিদেশি চক্রের এই সিন্ডিকেটের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় কি বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে উন্নয়ন বঞ্চিত হচ্ছে?

চীন থেকে পণ্য বোঝাই একটি ট্রেন ১২ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লন্ডনে গিয়েছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে। সেই ট্রেনটি ফিরতি যাত্রায় লন্ডন থেকে চীনের আমদানী করা পণ্য বোঝাই করে চীনের ইউয়ো বন্দরে ফিরে আসে মার্চ মাসে। রাশিয়ার ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলপথকে এ যাবৎ বিশ্বের দীর্ঘতম রেলপথ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। ট্রান্সএশিয়ান রেলপথ ও চীনের সূচির সিল্করুটের নতুন রেললাইন সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিতে শুরু করেছে। ট্রান্সএশিয়ান রেলপথ পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের একজন সৌখিন পর্যটক অথবা ব্যবসায়ী এক টিকেটে এশিয়ার অন্তত ১০টি দেশ ভ্রমনের সুযোগ পাবেন। তবে প্রতিযোগিতামূলক আন্তজার্তিক বাণিজ্যে ট্রান্সএশিয়ান রেলপথের সাথে যুক্ত দেশগুলোকে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের আমদানী-রফতানী বাণিজ্যের সিংহভাগই চীন ও ভারতের সাথে। বলতে গেলে ট্রান্স এশিয়ান রেলপথের সাথে যুক্ত হতে পারলে আন্তর্জাতিক স্থল বাণিজ্যে বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। ভারতের কলকাতা থেকে দোহাজারি,রামু-কক্সবাজার-মিয়ানমারের ঘুনদুম হয়ে চীনের বাণিজ্য নগরীগুলো সাথে যুক্ত হওয়ার এই সযোগ কি বাংলাদেশ হাতছাড়া করছে? ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ তথা সিল্করুটের বিশাল অংশ ইতিমধ্যেই রেলপথের দ্বারা সংযুক্ত হলেও এই রুটে ভ’-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়েতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ একটি মিসিং লিঙ্ক হিসেবে চিহ্নত হচ্ছে। ট্রান্স এশিয়ান রেলপথের পুরনো রুটটি দোহাজারি, রামু-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের ঘুনদুম পর্যন্ত যুক্ত হওয়ার যে পরিকল্পনা আছে তা শত বছরের পুরনো ঔপনিবেশিক আমলের পরিকল্পনা। বৃটিশরা মিয়ানমার দখল করার পর তাকে ভারত-বাংলাদেশের সাথে রেলপথের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল মিয়ানমার থেকে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করে কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্য। ১৮৯০ সালে প্রথ এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ হলেও যুদ্ধসহ নানাবিধ কারণে তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিদায়ের পর গত ৭০ বছরেও বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথের বাস্তবায়ন কেন সম্ভব হয়নি তা খুবই বিষ্ময়কর ব্যাপার। বাংলাদেশের রেলওয়ে এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা সহজেই আঁচ করা যায়। এ দেশের রেলযোগাযোগ উন্নত হলে অনেকেরই আঙুল ফুলে কলাগাচ হওয়ার মুনাফাবাজির রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তা নাহলে ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও দশকের পর দশক ধরে তা বাস্তবায়ন হয়না কেন। এমনকি শত বছরেও দেশের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের সাথে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার সাথে রেলসংযোগ হয়না কেন। কেউ কি বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে বাঁধাগ্রস্ত করতে চায়? কেউ কি বাংলাদেশ কে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়? তবে বাংলাদেশে রেলপথের অনগ্রসরতার কারণে সড়ক পরিবহনের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি দেশকে ভারতীয় নি¤œমানের গাড়ির ডাম্পিং স্টেশনে পরিনত করেছে। দশকের পর দশক ধরে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার ভারতীয় গাড়ি আমদানী ও কমিশন বাণিজ্য অব্যাহত রাখতেই দেশের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না ওঠার আর কোনো কারণ নেই। গত সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, খোদ বিআরটিসি কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভারত থেকে নি¤œমানের বাস-ট্রাক আমদানী করছে। মে মাসে ভারতের টাটা কোম্পানী থেকে আমদানি করা ১০০ বাসের মধ্যে গাবতলি ডিপোতে বরাদ্দ দেয়া ৮টি গাড়ীর সবগুলোতে আমদানির এক মাসের মেধ্য ছাদে ফুটো দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে ভারতের নি¤œমানের অটোমোবাইলের ডাম্পিং স্টেশনে পরিনত করা হয়েছে। এখন আঞ্চলিক ও দেশিয় বাস্তবতায় দেশের রেলপথ ও রেলপরিষেবাকে আধুনিক ও উন্নত করার কথা ভাবা হচ্ছে, তখন একটি মহল বাংলাদেশকে ভারতীয় রেলের পরিত্যক্ত ইঞ্জিনের ডাম্পিং স্টেশনে পরিনত করতে চাচ্ছে। রেলের ইঞ্জিন সংকট দূর করার কথা বলে ভারতীয় রেলের পরিত্যক্ত ইঞ্জিন ভাড়ায় আনার কথা বলছেন রেলের সংশ্লিষ্ট একটি মহল। তবে গত রবিবার মধ্যরাতে ঢাকা-সিলেট রেলপথে কুলাউড়া বরমচাল রেলস্টেশনের বড়ছড়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ রেলদুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে অন্তত ৪ জনের মৃত্যু এবং ২ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় সিলেটের সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ২০ ঘন্টা বন্ধ থাকে। এই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে না পারলে রেলওয়ের সংকট সমাধান ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ রেলওয়ে


আরও
আরও পড়ুন