পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গরমে জান বের অইয়া যায়, পাংখা কিনমু কেমনে- এমনই ভাষ্য জামদানি তাঁতিদের। ভাগ্যের পরিহাসে জোলারা (জামদানি তাঁতিরা) দারিদ্র্যতায় ভাসে, অস্থি মজ্জা ও মেরুদন্ডহীন এমনই জামদানি শিল্পের শিল্পীরা। রেশম, সুতা, জরি এবং শিল্পীর হাতের নিপূণ ছোঁয়ার মিশ্রণে তৈরি হয় এক ধরনের কাপড়, নাম জামদানি শাড়ি। প্রাচীন মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসাবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত। জামদানি বলতে শাড়িকেই বুঝানো হয়। এছাড়াও জামদানি দিয়ে ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা, শার্ট, পাঞ্জাবি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে তৈরি করা নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। বর্তমানে শাড়ি ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়ে না।
জামদানির নামকরণে বিভিন্ন মত আছে। অনেকে মনে করেন ফার্সি শব্দ জামা অর্থ কাপড়, দানা অর্থ বুটি; জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়। আবার অনেকের মতে, ফারসিতে জাম অর্থ এক ধরনের পানীয়, দানি অর্থ পেয়ালা জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি হয়েছে।
আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থনীতি বই, পেরিপ্লাস অব দ্যা এরিথ্রিয়ান সি বইটিতে বাংলার জামদানির কথা উল্লেখ আছে। আরব, চীন, ইতালির পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের কাছে জামদানি শাড়ির অনেক কদর ছিল। ৯০০ খ্রিস্টাব্দে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান কর্তৃক লিখা ‘¯্রলি সিলাই-উত-তওয়ারিখে’ রুমি রাজ্যেও সূ² জামদানির কথা বর্ণনা করেন। তিনি রুমি রাজ্য বলতে বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং জামদানি শাড়ির প্রশংসা করেন। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক রালফ ফিটস, ঐতিহাসিক আবুল ফজল, টেলর জামদানি শাড়ির প্রশংসা করেন।
স¤্রাট জাহাঙ্গীর, স¤্রাট আওরঙ্গজেব প্রমুখ তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য জামদানি শাড়ি তৈরি করাতেন। স¤্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি করা জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সালে ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা। যা পৃথিবীর যে কোনো কাপড়ের চাইতে ব্যয়বহুল।
সময়ের পরিবর্তনে বাঙালি ইতিহাসকে সাক্ষী রাখা সেই জামদানি শাড়ি দৈনিক ১৬ ঘণ্টা ২ জন লোক শিল্পের নিপূণতায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে ৬ দিনে তৈরি করে এবং শাড়িটি বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় বসা হাটে দুই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে। পানির দামে কাপড় বিক্রি করতে হয় সাউদদের কাছে। স্ত্রী-পরিজন নিয়ে এ টাকায় চলতে হয় পুরো একটি সপ্তাহ, কিনতে হয় কাপড় তৈরির রেশম, সুতা, জরি দিতে হয় সারকিতের সাপ্তাহিক বেতন। অথচ এ শাড়িটি দশ থেকে বারো হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন শপিংমলে। উল্লেখ্য বৃহস্পতিবার বিকেলে বিসিক জামদানি শিল্প নগরীতে জামদানি শাড়ির হাট বসলেও তাঁতি ও শাড়ির সংখ্যা থাকে সীমিত। যারা আসে তারাও সাউদদের কাছে জিম্মি।
আঠারো শতকে মলমল খাস ও সরকার ই আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। দারোগা-ই-মলমল এর প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ধাপগুলো সূ²ভাবে সম্পন্ন করা। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, সারকিত, রিপুকার, কারিগরদের নিবন্ধন করে রাখা হতো। অথচ বর্তমানে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা অর্জন করা এ শিল্পের প্রকৃত শিল্পীরা যথাযোগ্য পারশ্রমিকের অভাবে এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার গ্রহণ করে। এদের নিযুক্ত গোমস্তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাঁতিদের উপর নির্যাতন করতো। তাঁতিরা কম মূল্যে কাপড় বিক্রি করতে রাজি না হলে তাদের মারধোর করতো। ঠিক গোমস্তাদের মতোই বর্তমানের সাউদরা।
গ্রীষ্মকাল টেনেটুনে পাড় হলেও, বছরের বর্ষা মৌসুমে কাপড়ের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় শিল্পীদের দৈন্য আরো বেড়ে যায়। গরিব, দুঃস্থ, শিল্পীদের অসহায়ত্বের
সুযোগ নেয় কিছু জামদানি পাইকার (সাউদ)। তারা শিল্পীদের কিছু টাকা ধার দেয় একটি মাত্র শর্তে, শর্তটি হলো- আগামী বর্ষার আগ পর্যন্ত কাপড়গুলো সাউদের কাছে নির্দিষ্ট মূল্যে (যা ন্যায্য মূল্যের অনেক কম) বিক্রি করতে হবে। সংসার, স্ত্রী-সন্তানের কথা চিন্তা করে শিল্পীরা রাজি হয়ে যায়।
অথচ বর্ষা এলেও ধারের টাকা পরিশোধ করতে পারে না। ভরি ধরে ক্রয়করা রেশমের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। এছাড়া সুতা, ভারত থেকে আমদানি করা জরি, সারকিতের দিনমজুরী, দ্রব্যমূল্যের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে, কিন্তু সে তুলনায় কাপড়ের দাম না বাড়াতে জামদানি শিল্পীরা বিপাকে পড়েছে। পরের বর্ষাতে ধারের বোঝা আরো বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ। জামদানি শাড়ি পরিধান করেন ধনী ও অভিজাত রমণীরা। বাংলাদেশের বাইরে যারা এ শাড়ি পরেন তারা শিল্পীর নিপূণতা ও সৌখিনতা পছন্দ করেন। অথচ তারা জানেন না এই শাড়ির প্রতিটি সুতার ভাঁজে রয়েছে শিল্পীর ঘাম, কষ্ট, দুঃখ, বেদনা, না পাওয়া, বিচ্ছেদের আহাজারি, আঙুল কেটে নেবার ইতিহাস। যারা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় দিন রাত পরিশ্রম করে কাপড় তৈরি করেন তাদের মা বোনদের ভাগ্যে লজ্জা নিবারণের সস্তা কাপড়টুকুও জুটে না। অভাব তাদের নিত্য সঙ্গী। অনেক শিল্পী আজ ভিটে মাটি হারা সর্বসান্ত। ১৯৭৫ সালের এক বেসরকারি জরিপ মতে, জামদানি শিল্পীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে বর্তমানে শিল্পীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াইহাজারের মতো। কতজন তাঁতি জামদানির সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারিভাবে তার কোনো হিসাব নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে জামদানি শিল্প বিলুপ্ত হতে আর মাত্র কয়েক বছর লাগবে।
অনেক তাঁতি বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যে লালিত শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সারকিত হিসাবে শিশুশ্রমিক বেছে নিয়েছে। এককালীন কিছু টাকা পরিশোধ করে এক বা দুই বছরের জন্য এই শিশুদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। কাজ শিখিয়ে তাঁত অনুযায়ী কাজ আদায় করে নেয়া হয়।
বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করা সরকারি উদ্যোগসমূহ প্রশংসনীয় হলেও তার বাস্তবায়ন চোখে পড়ার মতো নয়। জামদানি শিল্পীদের জন্যে গড়ে উঠা নোয়াপাড়াস্থ বিসিক জামদানি শিল্প নগরীর শিল্পীরা পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের অভাবে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। জামদানি শিল্প নগরীতে তাঁতিদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই অর্থাভাবে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছে না। অনেক পরিবার আজ জরাজীর্ণ। সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ড্রেনের পচা পানি দিয়ে রাস্তা ডুবে আছে। রাস্তায় ভাসছে ময়লা আর্বজনা, ডাস্টবিনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। ফলে রোগ-ব্যাধি এখানকার নৈমেত্তিক বিষয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লাভের আশায় এই নগরীর আশেপাশে গড়ে তুলেছেন ঔষধের ব্যবসা। সাতটি রোডে বিভক্ত করা এই নগরীতে খেলার কোনো মাঠ নেই। অথচ এখানে জামদানি তাঁতিদের প্রায় কয়েকশত শিশু বসবাস করে। মানুষের মৌলিক চাহিদা ৫টি, যথা- অন্ন, ব¯্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। দরিদ্র হওয়ায় তারা অন্ন এবং বস্ত্রহীন। বাসস্থান যা আছে কিন্তু তা মানুষের বসবাস অনুপযোগী। শিক্ষার আলো তাদের জীবনে আসবে কিনা তা সন্দেহ, কারণ নিজের সন্তানকে সারকিত বানাতে পারলে কিছু সংসার খরচতো বেঁচে যায়। আর্থিক অসংগতির কারণে চিকিৎসার অভাবে জামদানি শিল্প আজ মৃত প্রায়। দুবেলা ভাত যাদের পেটে পড়ে না, তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কি? তা সুধীসমাজই ভালো বলতে পারবে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত অনেক তাঁতিই এখন নিজেদের মৃত্যু কামনা করে। স্বাধীনতার পর অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, জ্ঞানীগুণিজন এই শিল্পের কাছাকাছি এসেছেন, অনেক কিছু করার আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু শিল্পের অবস্থা দিনকে দিন করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে।
তবুও জামদানি শিল্পীরা স্বপ্ন দেখে সত্য সুন্দর আলোকিত পৃথিবীর। কিন্তু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ক্ষুধার তাড়নায় নিপীড়িত অভাবের বেড়াজালে আবদ্ধ, দুঃখ-কষ্টে ছটফট করা এই তাঁতিরা দেশীয় ঐতিহ্যের স্বপ্নে বিভোর। তিন শত বছর পরেও আজ তারা স্বপ্ন দেখে জামদানি শিল্প একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। দুঃখের বিষয় তাদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মুখ দেখে না। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে অনেক পথ, অনেক অন্ধকার, অনেক ভেড়াজাল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সাউদদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ক্রেতা ও শুভানুধ্যায়ীর কথা চিন্তা করে বর্তমানে এই জামদানি হাট বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুরু করা হয়েছে, যাতে ক্রেতারা হাটে এসে জামদানি কিনতে পারে।
শিল্পীর মৌলিক চাহিদা পূরণে, দৈন্য দূরীকরণে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে শিল্পীর পাশে দাঁড়াতে হবে। তবেই জামদানি শিল্পীর পরিবারসহ শিল্পকে পুনরুদ্ধার করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলার মানচিত্র তুলে ধরা যাবে।
লেখক: জামদানি গবেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।