Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুল ইসলাম অনূদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

মু সা ফি র ন জ রু ল | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০১৯, ১২:৩৮ এএম

সংক্ষেপে ওমরের বাণী হচ্ছেÑ এইক্ষণকালীন জীবনে :

“নগদ যা পাও হাত পেতে নাও,
বাকীর খাতায় শূন্য থাক।”
এই নিখিল শান্তির মধ্যে ওমর মানুষের জন্য কোন মিথ্যে শান্তনা বা আশ্বাসের বাণী বহণ করে আনেননি। জগৎ জীবনকে আসার জেনেও তিনি একে আনন্দ স্বরূপে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তিনি প্রকৃতির পটভূমিতে সুরা ও সঙ্গী নিয়ে মশগুল হতে চেয়েছেন :
“আবার যখন মিলবে হেথায় শারাব সাকির আঞ্জামে
হে বন্ধুদল, একটি ফোটা অশ্রæ ফেলো মোর নামে।
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকির পাশ,
পেয়ালা একটি উল্টে দিও স্মরণ করে খৈয়ামে।”
(কাজী নজরুল ইসলাম - ১৯১)
অতএব, ওমর জীবনকে বিফল হতে দিতে নারাজ। জীবনের যদি কোন অর্থই না থাকে তবে সেই নিরর্থক জীবনকে অনর্থক বিফল হতে দেয়ায় কি লাভ ? তারচেয়ে জীবনকে ভোগ করাই শ্রেয়। ত্যাগে নয়, ভোগেই জীবনের সার্থকতা। এটাই ওমরের জীবন দর্শন। সুতরাং ওমরের রুবাইসমূহ তাঁর জীবনমুখী মনোভাবের পরিচায়ক একথা সত্য।
ওমর খৈয়াম উঁচুদরের বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁর মধ্যে তাই বিন্যস্ত হয়েছে উচ্চ মাপের আধুনিকতা। যেখানে মানবগুরু আধুনিকতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছেন। ‘মানুষে আল্লাহ ভজি’ এবং ‘সেই নিরাকার কেন আকাশে’; শুধু মানুষ কেন কুল মখলুকাতে কত জীবজন্তু, প্রাণী, তাদের কথাও ভাবতে হবে প্রকৃতি বাহার চন্দ্র সূর্য এবং পাতাল পরিধি একাকার। খসরু, রুস্তম, হাতিম তাঈ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উল্লেখ করে ওমর খৈয়াম মানব গুরুত্বের কথাও আহŸানের সুরে প্রতিধ্বনিত করেছেন। এই প্রতিধ্বনি আধুনিকতার স্মারক হয়ে উঠেছে যেন, যখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাকে ‘মডার্ন’বলেছে। ওমরকে দেখে মনে হয় কোনও বিংশ শতাব্দীর কবিও বুঝি এত ‘মর্ডান’ হতে পারেন না।’ যখন তিনি উপমা দেন একজন আধুনিক কবির ধরণে যে, ‘মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট’ তখন আর কোন ও সংশয় থাকেনা।” (আওলাদ হোসেন, ওমর খৈয়াম ঃ মর্মবাণী ও জীবন রহস্য, পড়শী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা -১৩)।
ওমর খৈয়ামের কাব্য থেকে তাঁর মন ও মানসের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে তাঁর দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কিত গ্রন্থি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ তাঁর রুবাইয়াতে বহু কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও পÐিত তাদের চিত্তসত্ত¡ার প্রতিফলন উপলব্ধি করেছেন। আসলে ওমর ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র। যে সমুদ্রের জল নানা জনে নানান প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। ওমর খৈয়ামের প্রতিটি রুবাই এর মধ্যে কোন না কোন দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। কাব্যরসতো আছেই।
“আজ আছে তোর হাতের কাছে আগামী কাল হাতের বার,
কালের কথা হিসাব করে, বাড়াসনে তুই দুঃখ আর
স্বর্গ ক্ষরা ক্ষণিক জীবন করিসনে তার অপব্যয়।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)
এখানে কবি ওমরের দর্শন চার্বাক পন্থী বলে মনে হয়। আসলে ওমরের দর্শন চার্বাক পন্থীদের মত নয়। মানুষ হিসেবে এ রূপ রসগন্ধ ভরা পৃথিবীতে এসে ওমর ধন্য। সত্য শিব সুন্দরের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এ আনন্দ মেলায় কাঁটার মত একটা বেদনা অহরহ বিদ্ধ করছে জীবন ক্ষণস্থীয়ী, যেতে না চাইলেও যেতে হবে। এ জীবনের সমাপ্তি মৃত্যু। পরজন্মে তিনি বিশ্বাসী নন।
“হায়রে হৃদয় ব্যথার যে তোর ঝরিছে নিতুই রক্তধার
অন্তু যে নেই তোর এ ভাগ্য বিপর্যয়ের যন্ত্রনার।
মায়ায় ভুলে এই সে কায়ায় আনলি কেনরে অবোধ,
আখেরে যে ছেড়ে যেতে হবেই এ আশ্রয় আবার।
(কাজী নজরুল ইসলাম)
সুতরাং যতো দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত আর জ্যোতিষ চর্চা ওমর করে থাকুন না কেন অদৃষ্টের অপরিবর্তনীয় লিপি আর অবধারিত শেষ পরিণাম মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্থির অনড়। কারণ বাহ্যিক জীবনের অনেক রহস্যের মুক্তি ঘটলে জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি তত্তে¡র ব্যাখ্যা আজও আমাদের অজ্ঞাত।
দার্শনিক ওমর তাঁর কবিতার ভাষায় এই রহস্যের কারণ খুঁজেছেন। ব্যর্থ হয়েছেন বার বার। তাই তার কাছে মনে হয়েছে স্রষ্টা সৃষ্টি সব কিছুই মিথ্যা। আবার খানিক পরেই স্বীকার করেছেন সব কিছুরই অস্তিত্ব আছে। যদিও তিনি সঠিক কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেননি। তবুও জীবন ব্যর্থ নয়-মিথ্যা নয়। এর সর্ব সার্থকতা প্রেমেÑদানে ও গ্রহণে, প্রেমই আনন্দ, আনন্দই প্রেম-
“মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,
একটি হৃদয় খুশি করা তাহার চেয়ে মহত্বের।
প্রেমের শিকল পরিয়ে যদি বাঁধতে পার একটি প্রাণ
হাজার বন্দী মুক্ত করার চেয়েও অধিক পূণ্য এর।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)
এখানে ওমর খৈয়াম একজন রোমান্টিক কবি। তাঁর কাব্য দর্শনের ছোঁয়ায় আরো উজ্জ্বল। পরিশেষে আমাদের একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ওমর একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন এবং কবি ওমর এবং দার্শনিক ওমর মিলিতভাবে রচনা করেছেন রুবাইসমূহ। তাঁর কাব্যপাঠান্তে এটাও স্পষ্ট যে, ওমর খৈয়াম এ মধুময় পৃথিবীকে ভালবেসেছেন। ভালবেসেছেন ভাগ্যের হাতের ক্রীড়ানক পৃথিবীর সকল প্রাণী জগৎকে। জয়ধ্বনি করেছেন, যৌবনের প্রশান্তি গেয়েছেন, স্রষ্টার নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন, অবধারিত মৃত্যুকে করেছেন স্বীকার। ধরার ধূলোয় বসে ধরনীর জয়গান গেছেন। ওমর খৈয়ামের সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মিল সেখানেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নজরুল ইসলাম


আরও
আরও পড়ুন