পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রক্তদান একটি মানবিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক অঙ্গীকার। যিনি যে পেশায়ই থাকুন না কেন সমাজের জন্যে তার কিছু না কিছু করার আছে। ১ ব্যাগ রক্তদানের মাধ্যমেও তিনি পালন করতে পারেন সামাজিক অঙ্গীকার। রক্তদান করা কল্যাণমূলক কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাজ। মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা: সৎ কাজের বিনিময় বা প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতিত আর কী হতে পারে? (সুরা আর রহমান আয়াত-৬০)। পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। পাশাপাশি পৃথিবীতে যত প্রাণি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল মানুষ। দুর্বল ও অসহায় মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে শুধুমাত্র নিজের শক্তিতে নয়, অন্য মানুষের সহযোগিতায়। এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ সামাজিক প্রাণি। সে বেঁচে থাকে তারই মতো মানুষের শুভবোধের কারণে। রক্তদান সেই শুভবোধেরই এক বহিঃপ্রকাশ।
একবার অন্তত ভাবুন, আপনার রক্তে বেঁচে উঠছে একটি অসহায় শিশু, একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ। সে মুহূর্তে আপনার যে মানসিক তৃপ্তি, তাকে কখনোই অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়। রক্তদান স্বাস্থের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এই ঘাটতি পূরণ করে। আর প্রাকৃতিক নিয়মেই যেহেতু প্রতি ৪ মাস পর পর আমাদের শরীরের রেড সেল বদলায়, তাই বছরে ৩ বার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই রক্তদান করলে দেহ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে এটি ভুল ধারণা। যুক্তরাজ্যের এক মেডিকেল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদাতারা জটিল বা দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকে। রক্তদাতার হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কম।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এম হাফিজুল ইসলাম তাঁর এক বক্তব্যে বলেছেন, আমি প্রথম রক্ত দেই ষাট এর দশকে- তখন আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার এক রুমমেটের বোনের অপারেশন হয়েছিলো। রক্তের যোগাড় কীভাবে হবে এই ভেবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলো। আমি তাকে রক্ত দিলাম। শুনে পুরো হলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আমাদের হলের হাউজ টিউটর দৌড়ে এলেন, আমি সুস্থ আছি কি না। মাথা নেড়ে তিনি বলতে লাগলেন, রক্ত দেয়ার আগে মা-বাবার অনুমতি নেয়া উচিত। অর্থাৎ রক্তদান সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সে সময় ছিলো। রক্ত দিলে কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না, এ কথা তখন কেউ বুঝতো না। তিনি আরো জানিয়েছেন, আমরা পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, যারা নিয়মিত রক্ত দেন তারা অনেক সুস্থ থাকেন, দীর্ঘজীবী হন। শুধু তা-ই নয় মানসিকভাবেও তারা সুখী জীবনের অধিকারী হন। আমি ৬৩ বার রক্ত দিয়েছি এটি কোনো গর্বের বিষয় নয়, বরং আমি মনে করি এর মাধ্যমে ৬৩ জন মানুষের খেদমত করতে পেরেছি আমার দেহের সামান্য অংশ দিয়ে। আর এই দেয়ায় আমার তো কোনো ক্ষতি হয়ই নি, বরং সুস্থ, সুখী ও পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছি। ষাটোর্ধ্ব বছর বয়সে এসেও আমার ডায়াবেটিস নেই। বøাড প্রেসার কিংবা হার্টের কোনো সমস্যা নেই। দিনে ১৭/১৮ ঘণ্টা কাজ করেও আমি ক্লান্তি অনুভব করি না। আমার বিশ্বাস, নিয়মিত রক্তদানের ফলে সুুস্থতার এই নেয়ামত আমি অর্জন করেছি।
বলা বাহুল্য, শুধু রক্ত হলেই হবে না, জীবনের জন্য চাই বিশুদ্ধ রক্ত। স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের পরীক্ষিত রক্তই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। বাংলাদেশে রক্তের বিশাল চাহিদার মধ্যে ন্যূনতম পরিমাণ রক্ত আসে স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের মাধ্যমে। বেশিরভাগ রক্তই আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতা ও আত্মীয়-স¦জনের কাছ থেকে। আর পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের অধিকাংশই সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস-বি বা এইডস্-এ আক্রান্ত। ফলে এই দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালিত হয়ে রক্ত গ্রহীতা প্রায়শই আক্রান্ত হন দূরারোগ্য ব্যাধিতে। দূষিত রক্তের অভিশাপ থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজন নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের, প্রয়োজন সচেতন মানুষের স্বেচ্ছা রক্তদান। ইউরোপে প্রতি হাজারে ৬০-৮০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্বুদ্ধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদানকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
রক্তদানে আপনার অংশগ্রহণ হতে পারে এরূপ: ১. নিজে আজীবন রক্তদাতা হোন । ১৮-৬০ বছর বয়সী যে কেউ ন্যূনতম ওজন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলে রক্ত দিতে পারেন। ২. আপনার জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে রক্তদান করতে পারেন। ৩. জীবনের যেকোনো শুভদিন বা শুভ ঘটনাকে রক্তদানের মাধ্যমে আনন্দময় করে তুলুন। ৪. শারীরিকভাবে সক্ষম না হলে নিজে দিতে না পারলেও পরিচিতদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করুন। ৫. নিজ এলাকায় বা প্রতিষ্ঠানে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প আয়োজনে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করুন। পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ করুন।
একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই: গল্পে একজন বৃদ্ধ সমুদ্রের বেলাভূমি দিয়ে হাঁটছেন আর কিছুক্ষণ পরপর আপন মনে বালুর ওপর ঝুঁকে কিছু একটা তুলে সমুদ্রে ছুঁড়ে মারছেন। এ অবস্থা দেখে এক যুবক কৌতূহলী হলো। কাছে এসে সে দেখলো বৃদ্ধ আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসা স্টার ফিসগুলোর একটি/দুটিকে এভাবে বালি থেকে তুলে সমুদ্রে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। দেখে সে বিস্মিত হলো। বৃদ্ধের বোকামি দেখে মজাও পেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘সমুদ্রের একটা ঢেউয়ের সাথে লাখ লাখ স্টারফিস ভেসে এসে বালিতে আটকে যায়। কিন্তু আপনি তো এভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের কয়েকটি মাত্র বাঁচাতে পারেন। বাকিদের কী হবে?’ শুনে বৃদ্ধ বললেন, ‘দেখ, সবাইকে আমি বাঁচাতে পারবো না। আমার সাধ্য এটুকুই। কিন্তু তারপরও যে কয়েটিকে আমি বাঁচাতে পেরেছি তাদের কাছে এটিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার সাহায্যটুকুই তার জীবন এবং মরনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির কারণ। অতএব এর গুরুত্ব অনেক বেশি।’ এ গল্পটির শিক্ষা ছিলো যে পৃথিবীর সব লোকের সব সমস্যা সমাধান করার সাধ্য হয়তো আমাদের নেই। তারপরও যতটুকু সাধ্য আছে তা নিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে মানবতার কল্যাণে। তাহলেই সে ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক হবে। আর সে কাজটাই রক্তদাতারা করেছেন নিজ রক্তের বিনিময়ে লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়ে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।