পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সিলেট থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ভানুগাছের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাত্র ১২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ১৯৯৬ সালে এ উদ্যানের উৎপত্তি। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর হতেই বনবিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা- কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু লোকের সহায়তায় উদ্যানের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বেদখলকৃত উদ্যানের মূল্যবান গাছ-গাছড়া কেটে আবাদ করে লেবু, আনারসসহ অন্যান্য রকমের ফল-ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এতে সংকুচিত হচ্ছে উদ্যানের ভূমি আর সম্প্রসারিত হচ্ছে দখলের পরিসর। অবাধে মূল্যবান গাছপালা কাটা ও বনভূমি আবাদের ফলে উদ্যানের বিচরণরত বন্য প্রাণী, পাখি, সাপের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে মারাত্মকভাবে।
উদ্যানের দখলকৃত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ডরমিটরি সংলগ্ন পূর্ব অংশে ১৫ একর জমি দখল করে গেল বছর রৈচু ও আনারস বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকে ডরমিটরি এলাকার পশ্চিম পার্শ্বে হীড বাংলাদেশ অফিস সংলগ্ন জাতীয় উদ্যানের আরও প্রায় ১৫ হেক্টর ভূমি দখলে নিয়ে অন্য একটি গ্রæপ লেবু বাগান করে ভূমি গ্রাস করছে। সরেজমিন পরিদর্শনে আরো দেখা যায়, বেদখলকৃত উদ্যানে বিভিন্ন জায়গায় টিনসেট ঘর তৈরি করে লোকজন বসানো হয়েছে দখলকৃত এলাকার দাবী মজবুত করতে। পরিতাপের বিষয়, বন বিভাগের এবং উদ্যানের কর্মচারিরা নাকি নগদ অর্থের বিনিময়ে অবৈধ এসব কাজে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
যারা প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন তারা ভাল করেই জানেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,লতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার কোন কোন পাহাড়ী অঞ্চলে বৃক্ষসমূহ সব ঋতুতেই থাকে সতেজ। চিরহরিৎ অরণ্যের বৃক্ষসমূহের পাতা ঝরে পড়ে না, বিবর্ণ হয় না। দানবাকৃতির বিশাল এসব গাছ ঠান্ডায় কাবু হয় না। সারা বছর নাম জানা নানা ফল ও ফুলে থাকে ভরপুর এসব অরণ্য। এর মূল কারণ চিরহরিৎ অরণ্য ভৌগোলিক কারণে উষ্ণমন্ডলীর অঞ্চলে অবস্থিত। গ্রীষ্মকালীন এসব অরণ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সারাবছরই পাখীরা অরণ্যের চারদিক কলকাকলীতে মুখর করে রাখে। গাছের উঁচু ডালে মহানন্দে দোল খায় হরেক রকম বানর। উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় ফুলে-ফুলে নাচানাচি করে বেড়ায় সহ¯্র রঙের ছটাযুক্ত বিচিত্র সব প্রজাপতি। ফুল আর প্রজাপতির বর্ণবৈচিত্র্যে চিরহরিৎ অরণ্যে সারা বছরই যেন বসন্ত খেলা করে। অজ¯্র প্রজাতির সাপ-ব্যাঙ থেকে শুরু করে বনে দেখতে পাওয়া যায় জানা-অজানা লক্ষ-লক্ষ জীব-জন্তু ও কীট-পতঙ্গ।
চিরহরিৎ এ অরণ্যের নিবিড়-গহীন জঙ্গলে যে হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণী রয়েছে তার বেশীর ভাগের নামই আজ পর্যন্ত মানুষ জানে না বা জানতে পারেনি। সেজন্যই বিচিত্র এসব চিরসবুজ অরণ্যে ধরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং বর্ণাঢ্য বুনো জীবনকে। পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ এলাকা জুড়ে চিরহরিৎ অরণ্যের বিস্তৃতি হলেও সারাদুনিয়ার প্রায় অর্ধেক প্রজাতির প্রাণী আর উদ্ভিদের খোঁজ পাওয়া যায় এসব অরণ্যে। প্রবল শীতের সময় শীত প্রধান এলাকাগুলো থেকে লাখ লাখ অতিথি পাখির আগমন ঘটে, আফ্রিকা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার চিরহরিৎ অরণ্যে। আফ্রিকার অরণ্যের ভিতরে অধিকাংশ স্থানের তাপমাত্রা এত বেশী যে তা মরুভূমির রূপ নিয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিরহরিৎ অরণ্যের অবস্থানগুলো অনেক ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া। সেদিক থেকে চিরহরিৎ অরণ্যের আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করা যায় দক্ষিণ আমেরিকার অরণ্যেকে।
আমাজান নদীকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এ রেইন ফরেষ্ট-সত্যিকারের এক চিরহরিৎ অরণ্য। চার হাজার মাইল বিস্তৃত নদী আমাজানের জঙ্গল পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাস, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ক্রমবিকাশের ধারায় তৈরী হয়েছে। দীর্ঘতম এ চিরহরিৎ অরণ্যের জীব-জন্তুসমূহ, হাজার হাজার বছর ধরে রেইন ফরেষ্টে বাস করে আসছে। আছে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এসব মানুষ শিকার করে, মাছ ধরে এবং বনের টাটকা ফল-মূল খায়। চিরহরিৎ অরণ্যে থাকতে থাকতে এসব মানুষ এখন অরণ্যেরই এক অংশে পরিণত হয়েছে। এদিকে চিরহরিৎ অরণ্য দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ অরণ্যসমূহ ধ্বংসের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য কিংবা পরিবেশের যে সর্বনাশা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা মানুষের হিসাব-নিকাশ ও বোধ-বুদ্ধির বাইরে, এ অপূরণীয় ক্ষতি হয়ত মানুষের জন্য একটু দেরিতে হবে। কিন্তু অরণ্য ধ্বংসের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপুল বৈচিত্র্যের অধিকারী বাসিন্দারা। এসব বাসিন্দার মধ্যে আছে লেমুর শ্লথ, শিম্পাঞ্জী, গরিলা, শিকারী বাজ, চিতা, বোয়া, সাপ, হাতি, প্যাঙ্গোলিন, গ্রে-প্যারট, বাঘ ইত্যাদি।
এ প্রাণীকূল মানুষের কোন কাজে আসুক বা না আসুক অন্ততঃ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের ভূমিকা অনন্য সাধারণ। কিন্তু মানুষ সভ্যতার নামে যে ধ্বংসাত্মক কাজ শুরুকরেছে তা ইতোমধ্যে বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। চিরহরিৎ অরণ্যের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষিপ্রগতির প্রাণী ছিল চিতা। ছিল বলা হচ্ছে এ জন্যই যে, চিতা এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রাণী। ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনার আমাজনের চিরহরিৎ অরণ্যের চিতার কথা বাদ দিয়ে আমাদের দেশের সুন্দরবনের চিতার কথাই ধরা যাক। এক সময় সুন্দরবনে অসংখ্য চিতা ছিল, এখন সুন্দরবনের চিতা বিলুপ্ত-শুধু কয়েকটা বোধহয় কাগজে-কলমে কিংবা চিড়িয়াখানায় আছে। চামড়ার জন্য মানুষ এসব চিতাকে ধ্বংস করে চলেছে। চিতা বাঘের চামড়া অত্যন্ত মূল্যবান শৌখিন বিলাসদ্রব্য। মানুষের বিলাসিতার কারণে সভ্যতার যুপকাষ্ঠে বলি হয়েছে এ চিতা। সারা বিশ্বের বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় পান্ডার পরেই সম্ভবত চিতার উল্লেখ আছে। সুদৃশ্য চামড়ার কারণে চিতার মতো বিপন্ন চিরহরিৎ অরণ্যের এমারেন্ড গ্রীন ট্রি বোয়া অর্থাৎ সোজা বাংলায় অজগর, অজগরের চামড়া সুদৃশ্য হাত ব্যাগ, মানি ব্যাগ ও প্যাকেজের বাঁধাই কাজে খুব মূল্যবান পণ্য হিসাবে গণ্য। মানুষের এ লোভের অনলে পুড়ে জীবন দিয়েছে লাখ লাখ অজগর। ধ্বংস হয়েছে অজগর বসবাসের মতো সুরক্ষিত বনাঞ্চল। বিঘিœত হয়েছে অজগরের প্রজনন। স্বাভাবিকভাবে অজগর এখন বিপন্নতার মুখোমুখি ভয়াবহ ভাবে।
চিরহরিৎ অরণ্যে শিকারী পাখি সমূহের দৌরাত্ম্য ছিল একসময়, এখন নেই। এখন মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় তাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছে নিজস্ব আবাস। সোনালী বাজ, শিকারী ঈগল ইত্যাকার পাখিগুলো মূলত রেইন ফরেস্টের উঁচু বৃক্ষের মাথায় বসবাস করে। মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে কেটে নিয়ে যাচ্ছে উঁচু বৃক্ষ। ফলে কমে যাচ্ছে বাজ, বিল, শকুন, ঈগল ইত্যাদি পাখি। সোনালী বাজ আজ প্রায় বিরল, মিউজিয়ামের সোনালী বাজ দেখেই তৃপ্ত থাকতে হবে আগামী প্রজন্মের পাখিপ্রেমিকদের। চিরহরিৎ অরণ্যের সব চেয়ে জমকালো বাসিন্দা বাঘও আজ বিপন্ন প্রায়। মানুষ অনুধাবন করতে শুরুকরে শেষ মুহুর্তে, বাঘকে না বাঁচালে আর গর্ব করার কিছু থাকছে না তখনই তারা ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করে দিল। ফলে গড়ে উঠল কিছু হাস্যকর অভয়ারণ্য, যার মধ্যে স্বাধীনচেতা বাঘকে প্রতিপালন করা অসম্ভব। এজন্যই দেখা যায় সুন্দরবনের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে খাঁচায় রাখলে হয় সে মারা যাচ্ছে অনাহারে, কিংবা বদ্ধ পরিবেশের কারণে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার গর্ব এ সুন্দরবন নামের চিরহরিৎ অরণ্যে, যা আজ লোভী মানুষের কুঠারাঘাতের শিকার, দিনকে দিন উজাড় হচ্ছে বনভূমি, রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা ঘুরে বেড়াবার জায়গা পাবে কোথায়? মানুষের যে জায়গার বড় বেশী প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী চিরহরিৎ অরণ্যের বিপন্নতা রক্ষার জন্য যেমন আন্দোলন শুরু হয়েছে, তেমনি চিরহরিৎ অরণ্যের বাসিন্দাদের আদিম ও স্বাভাবিক অনুকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে অভয়ারণ্য। কাগজ-কলমের অভয়ারণ্য নয়, বাস্তবিক অভয়ারণ্য। উন্নত দেশের মানুষ যে আন্দোলন শুরু করেছে তা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন, বিপন্ন প্রাণীকূলকে রক্ষার আন্দোলন। আমাদেরও উচিত এ পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলা। তাহলে সুন্দরবনের মতো দক্ষিণ এশিয়ার চিরহরিৎ অরণ্য যেমন রক্ষা পাবে তেমনি রক্ষা পাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বর্ণাঢ্য বৈচিত্রময় চিরহরিৎ অরণ্যের বাসিন্দা।
পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর পরিবেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্বের চিরহরিৎ অরণ্যেগুলো আজ ভয়ঙ্কর বিপন্নতার মুখোমুখি। বসতি স্থাপনকারীরা বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলছে। তারা সঙ্কীর্ণ নিজস্ব স্বার্থে খামার বাড়ি তৈরী করে দখল করছে বনভূমি। কৃত্রিম হ্রদ তৈরী করছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য, হিতে বিপরীত হয়ে মারা পড়ছে গাছপালা। মূল্যবান ধাতুর খোঁজে খনিতে খোড়াঁখুড়ি, তেল উত্তোলনের ড্রিলিং রিগ, পরিবহনের জন্য রাস্তাঘাট বসবাসের জন্য আবাসস্থল ইত্যাদির কারণে বৈচিত্র্যময় চিরহরিৎ অরণ্যগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মানুষ নিজের প্রয়োজনে, সভ্যতার উন্নয়নের জন্য প্রতি মিনিটে আশি একর চিরহরিৎ অরণ্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করছে। যদি এ নষ্ট করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী ক’সালে চিরহরিৎ অরণ্য তার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি এবং আবশ্যক জীবনসহ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
পাদটীকা ঃ সিলেট শহরের পূর্বপ্রান্তে টিলাগড়ে বনবিভাগ একটি ইকো পার্ক সৃজন করেছে। এ পার্কে রয়েছে বেশ কিছু বন্য প্রাণী তার মধ্যে বানরের সংখ্যাই বেশি। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ইকো পার্কের এসব বানর খ্যাদ্যাভাবে দারুণ কষ্ট পাচ্ছে। তাদের অসহায় অবস্থা প্রত্যক্ষদর্শীদের দারুণ পীড়া দিচ্ছে। এদের বাঁচিয়ে না রাখলে ইকো পার্কের সৌন্দর্য্য বিনষ্ট হবে, বিপযস্ত হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে জরুরি ভিত্তিতে আবেদন, ইকো পার্কের এসব বানরকে খাদ্য সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা যেন করা হয়।
লেখক :সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।