শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মধ্যযুগে লোকসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। এসব লোকসাহিত্যে আমরা বাংলা বারমাসের সুন্দর বর্ণনা পাই। এগুলোকে বলা হয় বারমাসি কাব্য বা গান। সে সময়কার উল্লেখযোগ্য বারমাসি হলো মৈমনসিংহ গীতিকার কমলার বারমাসি, মহুয়ার বারমাসি, কঙ্ক ও লীলার বারমাসি, মলুয়ার বারমাসি, ভেলুয়া সুন্দরীর বারমাসি। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যেও বারমাসি দেখা যায়। যেমন বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রামাই পন্ডিতের শূণ্যপুরাণ, লোচন দাসের বৈষ্ণব পদাবলী, গোবিন্দ চক্রবর্তীর বৈষ্ণব পদাবলী, বলরাম দাসের বৈষ্ণব পদাবলী, শাহ মুহম্মদ সগীরের উইসুফ জুলিখা, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল, শেখ ফয়জুল্লার গোরক্ষ বিজয়, বাহরাম খানের লাইলী-মজনু, দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রনী, আলাওলের পদ্মাবতী, মালে মোহাম্মদের ছয়ফুল মুল্লুক বদিউজ্জামান, দ্বিজ রাম দেবের অভায়মঙ্গল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি। এখানে আমরা এসব কাব্যে বাংলা মাসের যে চিত্র আমরা দেখি তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।
বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ দুই মাস গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী ঝড় বৈশাখ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ঝড় জীর্ণ পুরাতনকে বিদায় করে প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে। এ কারণেই পরবর্তীতে বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হয়েছে। লোককবিরাও বৈশাখ মাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলা দুটি মাসকে পবিত্র মাস ধরা হয়। তার একটি হলো বৈশাখ মাস অন্যটি কার্তিক মাস। বৈশাখ মাস নিয়ে অন্নদামঙ্গল কাব্যে ভারতচন্দ্র বলেছেন:
‘বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়।
নানা ফুল গন্ধে মন্দর গন্ধ বহ বয়।।’
জৈষ্ঠ্য মাস সকল মাসের মধ্যে দিনের দৈর্ঘ্যরে দিক দিয়ে বড়। এ মাসে আম-জাম পাঁকে। তাই সকল কাব্যেই আমের কথা বলা হয়েছে। কঙ্ক ও লীলার বারমাসিতে বলা হয়েছে:
‘জৈষ্ঠ্য মাসে জেষ্ঠ্যরে সকল মাসের বড়।
ফলে ফুলে তরু লতা দেখিতে সুন্দর।।
আম পাকে জাম পাকে পাকে নানান ফল।
মন সাথে ডালে বসি বিহঙ্গ সকল।’
আষাঢ় ও শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। আকাশে থাকে বৃষ্টির ঘনঘটা। চারিদিকের বিল-ঝিল পানিতে টইটুম্বর থাকে। মলুয়ার বারমাসিতে এসময় নিয়ে বলা হয়েছে:
‘আইল আষাঢ় মাস মেঘের বয় ধারা।
সোয়ামীর চান্দ মুখ না যায় পাশরা।।
মেঘ ডাকে গুরু গুরু দেওয়ায় ডাকে রইয়া।
সোয়ামীর কথা ভাবি খালি ঘরে শুইয়া।।
শাওন মাসেতে লোকে পূজে মনসা।
এই মাসে আইব সোয়ামী মনে বড় আশা।’
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস শরৎকাল। এসময় বৃষ্টির ধারা কমে আসে। ভাদ্র মাসে তাল পাকে। তাই এসময় তালের গুরুত্ব বেশি। দেওয়ান ভাবনার বারমাসিতে এসময়ের কথা যেভাবে বলা হয়েছে:
‘ভাদ্র মাসেতে দূতী গাছে পাকন তাল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া দূতীরে (সুনাইর) গেল যৈবন কাল।।
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস হলো হেমন্ত। কার্তিক মাসে ধান পুষ্ট হয় ও অগ্রহায়ণ মাসে ধান পাকে। ভেলুয়া সুন্দরীর বারমাসিতে এ দু’মাসের কথা এসেছে এভাবে:
‘কার্ত্তিক না মাসেতে হায়রে ধানে হইল ক্ষীর।
তোমার লাগিয়ারে বন্ধু আমার মন নহে থির।।
অগ্রান মাসেতে ধান উডিল পাকিয়া।
কঁডে গেলা তুমিরে বন্ধু মোরে একেলা রাখিয়া।’
পৌষ ও মাঘ শীতকাল। প্রচন্ড শীতের কারণে মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। গোরক্ষ বিজয় কাব্যে সেখ ফয়জুল্লাহ বলেন:
‘পৌষ মাসেত প্রভূ পাষাণে কমল।
বিনি কাষ্ঠে তিহরী জ্বালাহ আনল।
মাঘ মাসেত গুরু হিম খরশান।
ক্ষেমাইর চাকরি করি রাখহ পরাণ।’
ফাল্গুন ও চৈত্র মাস বসন্তকাল। সকল ঋতুর মধ্যে সবার প্রিয় ঋতু এটি। এ দু’মাস সম্পর্কে কঙ্ক ও লীলার বারমাসিতে আছে:
‘দারুণ ফাল্গুন মাস গাছে নানান-ফুল
মালঞ্চ ভরিয়া ফুটে মালতী বকুল।।
দারুণ চৈত্রের হাওয়া দূর হইতে আসে।
আমার বধু এমন কালে রৈয়াছে বিদেশে।’
এভাবেই সেকালের কবিরা বাংলা বারমাসের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন তাদের কাব্যে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।