Inqilab Logo

বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রক্ষক যখন ভক্ষক

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মানুষের হিংস্রতা এতবেশি প্রকট আকার ধারণ করছে, যার জন্য মানুষ আর পশুতে কোনো ভেদাভেদ থাকছে না। পশুর মধ্যেও এত হিংস্রতা নেই, যতটা মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এ ধরণের সংবাদ শোনার পর বিশ্বাস হয় না যে আমরা মানুষ। মানুষের মধ্যে পশুর মত এমন হিংস্রতা সত্যি মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ আর পশু এক নয়। মানুষের বোধশক্তি আছে, যেটা কিনা পশুর নেই। কাজটা করলে ভালো হবে, আর কোনটা করলে খারাপ হবে এই বোধটুকু প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকে, যেটা কিনা পশুর মধ্যে থাকে না। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এতবেশি হিংস্র আর বর্বর হয়ে গেছে, তার মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধটুকুও লোপ পেয়েছে। ওই মানুষগুলাকে পশুর সাথে তুলনা করা ছাড়া আর কি বলা যায়?
বলার, লেখার বা প্রতিবাদের ভাষা নেই! মানুষ কি করে মানুষের গায়ে আগুন ধরাতে পারে! প্রকৃত মানুষ হলে তো একটা কুকুরের গায়েও গরম পানি ঢালতে হাত কেঁপে ওঠার কথা। ফেনীর সোনাগাজীর বেদনাদায়ক খবরে সকলেরই নির্বাক হওয়ার মতো অবস্থা। কোথায় আমার বোনের, সন্তানের নিরাপত্তা? আমরা কি অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি? যারা মেয়েটির গায়ে এভাবে আগুন দিলো, এরা কি আদৌ মানুষ? নাকি মানুষরূপী পশু! এ কেমন বর্বরতা, মানবতা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে আজ!
শিক্ষকদের ভোলা উচিত নয়, পিতা মাতার পর একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকদের উপরই সবচাইতে বেশি ভরসা করে। এরপরও সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীর সাথে এমন লজ্জাজনক আচরণ কোনো শিক্ষক কিভাবে করতে পারেন? শিক্ষকতা হচ্ছে এক মহান ও মর্যাদাকর পেশা। অথচ কতিপয় শিক্ষক এই মহান পেশার মর্যাদাকে কী অবলীলায় ভূলুণ্ঠিত করে চলেছেন।
সোনাগাজীর এই মেয়েটি যখন শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে থানায় অভিযোগ দিয়েছিল, প্রশাসনের উচিত ছিল তথন থেকেই মেয়েটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এই ঘটনা রচনা হতো না। তাকে এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হতো না। তার আত্মীয়রা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বসে জানান, অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলা পূর্ব থেকেই নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। এর বিরুদ্ধে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দেখা যায়, সবসময়ই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনা চেপে যায়। রক্ষকেরাও যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে, তখন আত্মসম্মানের কথা ভেবে বেশীরভাগ ভূক্তভোগিরা চুপ থাকেন। শিক্ষক হয়ে যখন এরকম ঘৃণ্য কাজ করেন, তখন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। একজন শিক্ষক কেবল মেধাবী ও উচ্চ ডিগ্রিধারী হবেন না; তার নৈতিক মান ও নীতিবোধও উঁচু হওয়া উচিত। উদ্বেগের বিষয়, আমাদের শিক্ষাঙ্গনে নীতি ও নৈতিকতাবোধ বিবর্জিত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় ছাত্রী কিংবা নারী শিক্ষকেরা যৌন হয়রানির শিকার হলেও মুখ বুজে সহ্য করেন। যখন কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করেন বা প্রতিকার চান, তখনই সেটি গণমাধ্যমে আসে। প্রতিকারের দাবি ওঠে।
ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা শিক্ষকদের নামের তালিকা লিখতে গেলে বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন প্রাইমারি, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকও। কতিপয় শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সেসব দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে তা প্রকাশের ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন অনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন।
ইতোপূর্বে চাকরিপ্রার্থী তরুণীকে মুঠোফোনে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে নোয়াখালী সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নোয়াখালীর তরুণ সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে স্কুল, কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, উন্নয়নকর্মী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার নাগরিকগণ। সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া চার দুর্বৃত্তই ছিল বোরকা পরা। ফলে রাফি কাউকেই চিনতে পারেনি। তবে একজন নারীকণ্ঠে রাফির সঙ্গে কথা বলেছে। বাকি তিনজন কোনো কথা বলেনি।
যারা নিজেরাই মানুষ হতে পারেননি, তারা কীভাবে মানুষ গড়ার কারিগর হবেন। শিক্ষকতা পেশাকে কলঙ্কিত করা নৈতিকতাবিবর্জিত এসব শিক্ষকের কারণে কত মেয়ের জীবন যে নষ্ট হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। অনেকে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শব্দত্রয় একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। শিক্ষাগ্রহণ করতে হলে শিক্ষক বা ওস্তাদের প্রয়োজন। নৈতিক মূল্যেবোধসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। এজন্যই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রকৃত আদর্শবান ও নৈতিকতাধারী শিক্ষকের বিকল্প নেই। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতোটা আদর্শবান ও ভালো, তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কিনা।
আদর্শ, সৎচরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংসের সকল পথ-ঘাট, অলি-গলি খুলে রেখে নৈতিকভাবে সুস্থ ও সৎ মানুষ পাওয়া যাবে না। অভিভাবকদেরও নৈতিক দায়িত্ব প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বয়োপ্রাপ্তির নিকটবর্তী হয়ে গেলে নিজ মেয়েদেরকে ‘সহশিক্ষা’ পরিত্যাগ করে বালিকা স্কুলে শিক্ষাদান করানো। দেশে ছেলে-মেয়েদের জন্য কম হলেও যতটুকু পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, কেউ কেউ তাকেও উপেক্ষা করে মিশ্র শিক্ষাঙ্গনে সন্তানদের পাঠানোর ‘জল খেতে গিয়ে ঘটি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাই অধিক ঘটছে’। সর্বধর্মে যাকে অশ্লীল বলে অভিহিত করেছে, ওরা তাকে ‘প্রেম-ভালোবাসা’ বলে উপভোগ করছে। ইউরোপ-আমেরিকার তথাকথিত দেশের স্কুলগুলোর ১৩ থেকে ১৬ বছরের শতকরা প্রায় ৪০ জনের মতো ছাত্রী গর্ভবতী হয়ে থাকে।
সহশিক্ষার সুযোগে ক্লাসমেট এমনকি পিতৃতূল্য কতিপয় শিক্ষক নামধারী ‘পরিমল’ মার্কা নরপশু ছাত্রীদের ধোকাবাজি ও গুপ্ত প্রেম-ভালবাসার ফাঁদে ফেলে দৈহিক সুখ লুটার সুযোগে থাকে। শিক্ষকনামধারী কিছু লম্পট, চরিত্রহীন, নরপশু দ্বারাই আজ বিভিন্নভাবে নিগৃহিত হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। কোনো শিক্ষাঙ্গণেই যাতে এ ধরনের অনৈতিক ও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। ফেনীর সোনাগাজীর ঘটনাটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে খতিয়ে দেখা জরুরি। এ ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, তা তদন্ত করে বের করতে হবে। রাফির গায়ে আগুন দিয়ে যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রæততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রক্ষক

১২ এপ্রিল, ২০১৯
১২ মার্চ, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ