চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তারা সমাজে একত্রে মিলেমিশে থাকতে চাই। কিন্তু যে জিনিসটি এ সমাজ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে কলুষিত করে দেই, তা হলো ব্যভিচার তথা ধর্ষণ। এটা একটি সুখময় জীবনকে অশান্তিময় করে তুলে। মানবজীবনকে পশুত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায়। ধর্ষণের কারণে অভিশাপ নেমে আসে মানব সমাজের ওপর। ধর্ষক হয় সমাজ থেকে বহিস্কৃত। মাতাপিতার হয় কলঙ্ক। আত্মীয়-স্বজনরা হয় বৈরী। জাতির জন্য হয় কালিমা।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কোনো পুরুষ নিজের পত্নী-ছাড়া অপর কোনো মহিলার সাথে এবং কোনো মহিলা নিজের স্বামী ব্যতীত অপর কোনো পুরুষের সাথে যৌন মিলন করলে তাকে ধর্ষণ বা ব্যভিচার বলে। র্বতমানে পত্রিকা খুললে দেখা যায় ‘নারী নির্যাতন’ নামে বড় বড় অক্ষরে ধর্ষণ ও ধর্ষক গ্রেফতারের কলঙ্কিত শিরোনাম। এ অভিশপ্ত কাজ থেকে ষোল-সতের বছরের কিশোর- কিশোরীরাও মুক্ত নয়। এমনকি তিন বছরের শিশুকন্যাকেও ধর্ষণের শিকার হতে দেখা যায়। জীবনের শুরুতেই ছেলেমেয়েরা ধর্ষক বা ধর্ষিতার তালিকায় নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে। শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্বীয় জীবনকে অন্ধকারে ঢেলে দিচ্ছে। এটার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইসলামি জ্ঞানহীনতা। অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন না। জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন না। অথচ হাদিস শরিফে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক নর-নারীর ওপর দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। ইসলামি জ্ঞানের অভাবে অধুনা মুসলিম সমাজে অপ্রীতিকর ও ধর্ষণের মতো অভিশপ্ত কর্মকান্ড ঘটে যাচ্ছে। এটার জন্য অভিভাবকগণ দায়ী থাকবে। কেয়ামতের দিন তাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হবে।
সন্তানদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব অভিভাবক তথা মাতাপিতার। এছাড়াও স্বীয় সন্তানকে ইসলামি আদর্শে আদর্শিত করা মুসলিম উম্মাহর ঈমানি দাবি। কারণ, জীবনবোধ ও মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে ইসলামি জ্ঞান। ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার উৎকর্ষতায় ইসলামি শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই, মানব সমাজ থেকে ধর্ষণ প্রতিরোধের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ইসলামি শিক্ষা অপরিহার্য।
কোরআনে ব্যভিচারের শাস্তির বিধান : ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তির বিধান রয়েছে। বিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাদেরকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা এবং অবিবাহিতকে একশত বেত্রাঘাত করার বিধান ইসলামি শরিয়তে রয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ব্যভিচারিণী নারী, ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যেক্ষ করে। (সূরা নুর : ২)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। (সূরা নুর : ১৯)
ব্যভিচারে লিপ্ত হলে ঈমান দেহ ছেড়ে পলায়ন করে : হাদিসে ব্যভিচারকে ঈমান ধ্বংসকারী অপকর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্ষক ধর্ষণাবস্থায় বেঈমান ও অভিশপ্ত মানবে পরিণত হয়। ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর ঈমানের শুভ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের অন্তর হয় কলুষিত। বিদূরিত হয় ব্যভিচারীর আত্মার পবিত্রতা। ব্যভিচার এতোই জঘন্য ও মন্দ কাজ যে, তাতে লিপ্ত হলে ঈমান ভয়ে কেঁপে ওঠে এবং ঈমান ব্যভিচারীর দেহ ছেড়ে পলায়ন করে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, কোনো বান্দা যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন ঈমান তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তার মাথার ওপর ছায়ার মত অবস্থান করে। অতঃপর যখন ব্যভিচারী ব্যভিচার থেকে মুক্ত হয়, তখন ঈমান আবার তার কাছে ফিরে আসে। (আবু দাউদ : ৪৬৯২; তিরমিজি : ২৮৩৪)
রাসুল আরও বলেন, হে আমার উম্মত! আল্লাহর কসম, কোনো পুরুষ বা নারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন আল্লাহর চেয়ে অধিক কেউ লজ্জাবোধ করে না। আল্লাহর কসম, আমি যা জানি, তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। (বোখারি : ১০৫২)
ব্যভিচার র্শিকতুল্য অপরাধ : পৃথিবীর সমুদয় গোনাহসমূহের মধ্যে র্শিক গোনাহ সবচেয়ে বড় গোনাহ। এ গোনাহ ক্ষমাযোগ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা শিরককারীকে অভিশাপ দেন। তবে শিরক গোনাহর পর বড় গোনাহ হলো ব্যভিচার। এটি অসভ্যতা ও চরিত্রহীনতার শ্রেষ্ঠ অপকর্ম। ব্যভিচার পৃথিবীর সব ধর্মে অবৈধ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যভিচারকে চিরস্থায়ীভাবে নিষেদ্ধ করেছেন। তিনি হাদিসে ব্যভিচারকে শিরক গোনাহর সাথে তুলনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, শিরকের পর কারও গর্ভাশয়ে অবৈধ বীর্য রাখার চেয়ে বড় গোনাহ আর কিছু নেই। (ইবনে কাসির)
ব্যভিচারের চেয়ে জেলখানা অনেক উত্তম : ব্যভিচার কোনো ধর্মে বৈধ নয়। সব ধর্মে এর প্রতি ঘৃণা রয়েছে। ব্যভিচারে লিপ্ত ব্যক্তিকে সকলে অভিশাপ দেই। ব্যভিচারের আহবানে সাড়া দেওয়া কারও জন্য জায়েজ নেই। এ অবৈধ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ঈমানি দায়িত্ব। প্রয়োজনে জেলখানার বন্দিজীবন বরণ করে নিতে হবে, এরপরও ব্যভিচার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। যেমন- হজরত ইউছুফ (আ.) ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে জেলখানার অন্ধকার বন্দিজীবনকে নিজের জন্য উত্তম মনে করেছেন। এমনকি এ অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করেছেন তিনি। পবিত্র কোরআনে হজতর ইউছুফ (আ.)-এর মুনাজাতটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, “হে আমার রব! যার প্রতি এ নারীরা আমাকে ডাকছে, তার চেয়েতো কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি তাদের ছলনা থেকে আমাকে রক্ষা না করো, তাহলে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বো এবং অজ্ঞ লোকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব।” (সূরা ইউছুফ : ৩৩)
ব্যভিচার দুর্ভিক্ষ ও কাপুরুষতা সৃষ্টি করে : মানবসমাজে ব্যভিচার-ধর্ষণ ব্যাপক আকার ধারণ করলে পৃথিবীতে আল্লাহর গজব নাজিল হয়। রহমতের বারিধারা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষের মাঝে কাপুরুষতা বিস্তার করে। এছাড়াও ব্যভিচারের কারণে মানবজাতি মহামারিতে আক্রান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপকতা লাভ করে, তারা দুর্ভিক্ষে পীড়িত হয়। আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদ-ঘুষের লেনদেন হয়, তারা কাপুরুষতায় আক্রান্ত হয়। (আহমদ)
আরও বলেন, যে জাতি ব্যভিচার-ধর্ষণে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে মহামারী দেখা দেই। (মুয়াত্তা মালেক : ৯৮৭)
ব্যভিচার রোধে ইসলামি অনুশাসন : অভিশপ্ত ধর্ষণ বন্ধের জন্য ইসলাম সুন্দরতম বিধান দিয়েছে। এর কার্যকর হলে মুসলিম সমাজ ধর্ষণ তথা ব্যভিচার মুক্ত হবে। কারণ, বর্তমান সমাজে ধর্ষণ বন্ধের জন্য ধর্ষককে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন আন্দোলনও করা হচ্ছে- কিন্তু এতে ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না, বরং ধর্ষণের নিত্যনতুন পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই, একমাত্র ইসলামি অনুশাসনেরই মাধ্যমে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব। ইসলামি শরিয়ত নির্দেশিত নীতিমালা গ্রহণ করলে পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাভিচারের মতো নির্লজ্জ অপরাধের ঘটনা ঘটবে না। ফলে সুখী ও সমৃদ্ধিশীল সমাজ গঠন হবে। মানবজীবনে শান্তি ফিরে আসবে। পার্থিব জীবন হবে কলঙ্কমুক্ত আর পরকালে মিলবে অনন্ত শান্তি। আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরিফে ব্যভিচার বন্ধের জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছেন। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরলাম।
১. কোনো পুরুষ অপর কোনো পরনারীর (গায়রে মাহরামা) দিকে তাকাতে পারবে না। হঠাৎ পরনারী স্বীয় চোখে পড়লে সাথে সাথে চোখের দৃষ্টি নিচু করে নিতে হবে। ২. কোনো নারী অপর কোনো পরপুরুষের (গায়রে মাহরাম) দিকে তাকাতে পারবে না। হঠাৎ কোনো পুরুষ চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চোখ নিচু করে নিতে হবে। ৩. কোনো নারী অপর পুরুষকে নিজের রূপ-সৌন্দর্য দেখাবে না। ৪. মন বা দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এমন কোনো পোশাক ও অলঙ্কার পরে ভিন্ন পুরুষের সামনে কখনও উপস্থিত হবে না। ৫. নারী-পুরুষ উভয়ে নিজ নিজ দেহ ও মন পূত-পবিত্র রাখবে। কেউ কারও সম্পর্কে কোনো প্রকার খারাপ কল্পনা করবে না। ৬. নারী-পুরুষ উভয়ে নিজ নিজ লজ্জাস্থান হেফাজত করবে। ৭. অনুমতি ছাড়া অপর কারও ঘরে প্রবেশ করবে না। ৮. অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে। ৯. নিজের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় এমন কোনো স্থানে অপর পুরুষের নিকট নারী গমন করবে না। (সূরা নুর : ১২, ১৯, ২৭, ৩০ ও ৩১)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।