পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশাল বাজেট, বিপুল আয়োজন। কোনো কিছুরই কমতি বা ঘাটতি ছিল না। কিন্তু যাদের জন্য এত সব, সেই ভোটারদেরই কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। গত রোববার উপজেলা পরিষদের প্রথম পর্বের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রই ছিল ফাঁকা। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কার্যত অলস সময় কাটিয়েছেন। পত্রিকান্তরে জয়পুরহাটের সদর উপজেলার জয়পুরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটচিত্র তুলে ধরা হয়েছে এভাবে : ‘কেন্দ্রের বিভিন্ন ভোটকক্ষে বসে আছেন নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ২২ জন কর্মকর্তা। কেন্দ্রে রয়েছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৪ জন সদস্যও। ভোট নেয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। ভোট গ্রহণের সময়ও শুরু হয়েছে। অপেক্ষা শুধু ভোটারের। কিন্তু ভোটারেরই দেখা নেই। প্রথম দেড় ঘণ্টায় এলেন ৩ জন ভোটার। সারাদিনে ভোট পড়ল ৬৭টি।’ পত্রিকাটির তথ্যমতে, নারী ভোটারদের ওই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৫১১। ভোট পড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অন্য একটি ভোট কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১৫০টি। এই উপজেলার সকল কেন্দ্রের ভোটচিত্র মূলত এরকমই। জয়পুরহাটের অন্য ৪টি উপজেলাসহ ওইদিন দেশের আর যে সব উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে সেসব উপজেলায়ও ভোট প্রদানের হার খুবই কম। ইসির তরফে দাবি করা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। ইসির এই দাবির সঙ্গে পর্যবেক্ষকরা একমত নন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এ দাবির ব্যতিক্রমটাই নির্দেশ করে।
এটা কারো অজানা নেই উপজেলা নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো অংশ নিচ্ছে না। গত রোববারের উপজেলা নির্বাচন, অনুষ্ঠিত হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ ও তার বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এ নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি, ব্যালট পেপার ছিনতাই, সংঘাত-সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ইত্যাদি সব কিছুই হয়েছে। ২৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে তার এতটুকু ব্যাতিক্রম হয়নি। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনেই নয়, বহুল প্রতাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও গতকাল যা কিছু ঘটেছে, তাতে দেশের সচেতন মানুষ রীতিমত স্থম্ভিত হয়ে পড়েছে। এ নির্বাচনেও রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি, সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধার, শক্তি প্রয়োগ, হানাহানিসহ নানা ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন আর ডাকসু নির্বাচন কার্যত এক বরাবর হয়ে গেছে। সর্বমহল থেকে আশা করা হয়েছিল, ডাকসু নির্বাচন যেন ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো না হয়। কিন্তু সে আশাবাদ সত্য হয়নি। গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি অনিবার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। গণতন্ত্র আছে অথচ নির্বাচন নেই, নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ও অধিকার নেই, এটা কল্পনা করা যায় না। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার উদগ্রবাসনা চরিতার্থ করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই আজ ব্যর্থ ও অকার্যকর করে ফেলেছেন। গণতন্ত্রের ভবিষতকে করে ফেলেছেন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। নির্বাচনের প্রতি, ভোটের প্রতি গণমানুষের নুন্যতম আস্থা আর অবশিষ্ট নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন এবং আলোচ্য উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ও ভোট প্রদানের হার থেকে এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকদের অভিমত, জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব অন্যান্য নির্বাচনেও পড়ে। বাস্তবতা এই অভিমতের সত্যতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, সে ব্যাপারে এখন আর কারো কোনো সন্দেহ নেই। অভিযোগ ছিল, ভোটের দিনের আগের রাতেই ভোট হয়ে যায়। রাতে সিল মেরে ভোটের বাক্স পূর্ণ করা হয়। ফলে অধিকাংশ ভোটারই ভোট দিতে পারেনি। তারা ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার সত্যতা প্রকান্তরে সিইসিও স্বীকার করে নিয়েছেন। তার সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে এই স্বীকারোক্তি উঠে এসেছে। ভোটারবিহীন নির্বাচন দেশের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। এদেশেই ১৯৫৪ সালে ও ১৯৭০ সালে সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দুটি নির্বাচন ইতিহাসের গতিধারা বদলে দিয়েছে। পরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু এবং ব্যাপক গণঅংশগ্রহণমূলক হয়েছে। এরপর থেকে ভোটারবিহীন নির্বাচনের ধারা সৃষ্টি হয়েছে। রাতে ভোটের বেনজীর নজির স্থাপিত হয়েছে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। এর দায় বর্তমান সিইসি কে এম নূরুল হুদাসহ অন্য কমিশনারদের বহন করতে হবে। তাদের মধ্যে একজন কমিশনার ব্যতিক্রম। কিন্তুু তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়নি সঙ্গতকারণেই। ভোটারবিহীন নির্বাচনের এই ধারা সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা কখনোই পূরণ হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থা ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিভিন্ন দল ও ভোটাদের স্বত:র্স্ফূত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যে সম্ভব নয়, সেটা এখন দিবালোকের মতই স্পষ্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।