পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আবারো ক্ষমতায় এসে ভারতকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করতে চান। বিগত নির্বাচনে ভারতের বনেদি রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু গত সাড়ে ৪ বছরের বিজেপি শাসন ভারত এগিয়েছে না পিছিয়েছে তা সম্ভবত ভারতের সচেতন জনগন তথা ভোটাররাই ভাল জানবেন। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় পরাজয় থেকে সহজেই বুঝা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতায় ফিরে আসা খুব সহজ হবে না। তবে বিজেপি নেতারা তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগানোর পুরনো কৌশলই বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম বিদ্বেষ থেকে গো রক্ষা আন্দোলনের নামে মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা জাগ্রত করা, নাগরিকত্ব তালিকার নামে বাংলাভাষি মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সাথে বৈরীতা ও যুদ্ধংদেহি অবস্থা সৃষ্টি ও মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে যুদ্ধের হিস্টিরিয়া তৈরীর প্রয়াসকে ভারতের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও ক’টনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই জনগনের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধি অন্ধ স্বাজাত্যবোধ জাগিয়ে তোলতে শর্টকার্ট পন্থা অনুসরণ করতে গিয়ে তা কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের ১৮সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরের উরিতে জঙ্গি হামলায় বেশ কিছু ভারতীয় সৈন্য হতাহত হওয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা ২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরিচালনা করে। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে সেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে সফল বলে দাবী করা হলেও বাস্তবে দাবীর স্বপক্ষে তেমন কোনো তথ্য প্রমান হাজির করা যায়নি। তবে উরির ঘটনার পর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘটনা নিয়ে বলিউডে উরি দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামে একটি বাণিজ্যিক মুভি নির্মিত হয়। এই ছবি বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করে। ভারতের বিরোধীরা ভারতীয় বীরত্ব কেবল বোম্বের ফিল্মেই সীমাবদ্ধ বলে খোঁচা দিতে অভ্যস্থ। উরি জঙ্গি হামলায় ২০জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিল। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিক কাশ্মীরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ভারত, এর নাম দেয়া হয় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী মন্তব্য পাওয়া যায়, প্রথমত: ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সাফল্য নিয়ে ভারত যে দাবী করেছে পাকিস্তান তার পুরোপুরি অস্বীকার করে। অন্যদিতে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমন চেষ্টা প্রতিহত করতে গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর দু সদস্য নিহত এবং প্রতিপক্ষ ভারতের অন্তত ৮ সেনা হত্যার দাবী করে পাকিস্তান। সীমান্তযুদ্ধে ভারতীয় ৮ সেনা হত্যার ঘটনা অস্বীকার করলেও ভারতের ৩৭ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের এক সদস্যকে অস্ত্রসহ আটকের খবর সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের কাছে স্বীকার করে ভারতীয় সুত্র। আড়াই বছরের ব্যাবধানে উরির পর পুলওয়ামা কান্ডের পর প্রায় একই প্রকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে। ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জইশ-ই-মুহম্মদ গ্রুপের জঙ্গি হামলায় ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর ৪৪ সদস্য নিহত হওয়ার পর আবারো পাকিস্তানের সাথে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী হয়। বিশেষত: বিজেপি-আরএসএস অ্যাক্টিভিস্ট এবং একশ্রেনীর মিডিয়ার ক্যাম্পেইন এক ধরনের যুদ্ধের হিস্টিরিয়া তৈরী করে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে একাট্টা রাজনৈতিক নেতারা বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে পুলওয়ামা কান্ডে ভারতীয় জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ তুলেছেন।
উরি হামলার পর প্রতিশোধ অথবা প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য আত্মম্ভরি ভারতীয় বাহিনী সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আশ্রয় নিয়েছিল। তবে সে অভিযানের অথেনটিক মিডিয়া কভারেজ বা দাবীর সপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমান না থাকায় তা এক ধরনের পাল্টাপাল্টি দাবীর মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। তবে এই সার্জিক্যাল অপারেশনকে জাতির সামনে গৌরবময়ভাবে উপস্থাপনের মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্প ব্যর্থ হয়নি। সার্জিক্যাল অপারেশনের কমান্ডার রনবির সিংকে একজন জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বোম্বাইয়ে নির্মিত ফিল্ম ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বেশ কার্যকর ভ’মিকা রেখেছে। এবার পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর ২৬ ফেব্রুয়ারী রাতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিক কাশ্মীরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অতর্কিত হামলায় জইশ-ই-মুহম্মদের ঘাঁটি ধ্বংস করাসহ অন্তত ৩০০জন জঙ্গি হত্যার দাবী করেছিল ভারতের একশ্রেনীর মিডিয়া। তবে দৃশ্যত দেখা গেল, পাকিস্তানে কোনো জঙ্গি ঘাঁটি বা কথিত জঙ্গি নিহতের দাবী ধোপে না টিকলেও একদিনের পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় ভারতের দু'টি জঙ্গি বিমান ও একটি জঙ্গি হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে যায়। সবচেয়ে অথেনটিক ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় মিগ-২১ বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান অক্ষত অবস্থায় অস্ত্রসহ পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়া। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাবেক এয়ার ভাইস মার্শালের পুত্র উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানীদের হাতে আটক হওয়ার পর সবকিছু ছাপিয়ে এটাই কেন্দ্রীয় আলোচ্য বস্তুতে পরিনত হয়। তার নিরাপদে দেশে ফেরার জন্য পুজা আর্চনা ও প্রার্থনা করা হয়, পাকিস্তানের প্রতি তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। পুলওয়ামা ঘটনার পর তাৎক্ষনিকভাবেই পাকিস্তানকে দোষারোপ করার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তথ্য প্রমান ছাড়া এ ধরনের দোষারোপ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি জানিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি ভারত। তারা বালাকোটে প্রি-অ্যাম্পটিভ এয়ার স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরের ঘটনা ইতিমধ্যে ইতিহাস। তবে এমন একতরফা বিমান হামলার পরও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পার্লামেন্টে দেয়া ভাষনে শান্তির সদিচ্ছা বার্তা হিসেবে পরের দিনই উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে সসম্মানে ভারতে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষনা দেন। তিনি এই সিদ্ধান্তকে একটি শুছেচ্ছা ও শান্তির সদিচ্ছার বার্তা হিসেবে বর্ননা করে বলেন, ভারতীয়রা তাঁর এই সিদ্ধান্তকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল করবেন। বালাকোট বিমান হামলার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে গত ১লা মার্চ রাতে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ঘটনা ভারতজুড়ে এক প্রকার উৎসবমুখর আবহ তৈরী করে। অভিননন্দন বর্তমান এখন ভারতে বীরত্বের আইকন। অভিনন্দনকে ছেড়ে দিয়ে শান্তির বার্তা দেয়ায় ভারতে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে বলে নানা সুত্রে খবর বেরিয়েছে। পক্ষান্তরে বালাকোটে বিমান হামলায় সাফল্যের দাবীকে ঘিরে মোদি মহলের লেজেগুবুরে অবস্থা। প্রথমে ৩ শতাধিক জঙ্গি হত্যার দাবী করলেও পাকিস্তানী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্টে এই দাবীর কোনো সত্যতা মিলেনি। অবশেষে ইজ্জত বাঁচাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আহলুওয়ালিয়া বলেছেন, ২৫০ জঙ্গি মারার কথা সরকারের কেউ বলেননি, কোনো প্রাণহানিও ঘটেনি। কারণ জঙ্গি ঘাটির সামনে ফাঁকা জায়গায় বোমা ফেলে পাকিস্তানকে শুধু বার্তা দেয়া হয়েছিল। তবে আহলুওয়ালিয়ার এই দাবীকে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করছে না। এতে তাদের কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নাই। তারা তো পুলওয়ামা কান্ড এবং পাকিস্তানের বিমান হামলার ঘটনাকে ভোটের রাজনীতিতে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। অতএব পানি অনেক ঘোলা হয়ে যাওয়ার পরও গত সোমবার বিজেপির শীর্ষ নেতা অমিত শাহ দাবী করেছেন বালাকোটে বিমান হামলায় ২৫০ পাকিস্তানী জঙ্গি নিহত হয়েছে। সেই সাথে এসব ভিত্তিহীন দাবীকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদির বুকের ছাতি নাকি ক্রমেই স্ফীত হয়ে চলেছে। ভোটের রাজনীতিতে বালাকোট বিমান হামলার ঘটনাকে কাজে লাগাতে তারা সর্বৈব প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বিজেপি নেতারা সামরিক পোশাক পরে বাইক রেলি করছেন, অস্ত্রহাতে ছবি তুলে পোষ্টার সাঁটিয়ে একটি পাকিস্তান বিদ্বেষ ও মুসলিম বিদ্বেষী হিস্টিরিয়া ছড়িয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছেন। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়া উইং কমান্ডার পাইলট অভিনন্দন বর্তমান দেশে ফিরে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম তিলকে তাল করছে।
ভারতের রাজনীতি পুরো উপমহাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও শান্তি-স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। চীন-ভারতের ভ’-রাজনৈতিক অবস্থান ও বিশ্ব রাজনীতির নতুন অর্থনৈতিক মেরুকরণের কারণে ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্ব রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠা স্বাভাবিক। অথচ বিশ্ব অর্থনীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতীয় উপমহাদেশ অন্যতম সংকটময় উপত্যকা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সারাবিশ্বের অতিদরিদ্র ও অপুষ্টির শিকার অর্ধেকের বেশী মানুষের বসবাস এই এলাকায়। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার পেছনে এসব দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভানুমতির খেলা বড় ভ’মিকা পালন করছে। আলোচনা-বিতর্ক ও মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে উপমহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হলেও দেশের স্বাধীনতার সুফল দরিদ্র মানুষের কাছে পৌছে দিতে, তাদের নিরাপদ স্বদেশ, বাসস্থান ও উন্নততর জীবনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে যে আভ্যন্তরীন ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ দরকার তা অর্জন করতে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসেনি। এসব লক্ষ্য অর্জনে আঞ্চলিক সমন্বয়হীনতা দূর করতে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করলেও ভারতের অনীহা ও অনিচ্ছার কারণেই তা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। কাশ্মীরের উরিতে জঙ্গি হামলা ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঘটনার জেরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনটি ভন্ডুল হয়েছিল। ইতিপূর্বে আরো বেশ কয়েকটি সার্ক সম্মেলন ভারতের কারণে ভন্ডুল অথবা অকার্যকর হয়েছিল। কাশ্মীর ইস্যু, গঙ্গার পানিবন্টনের মত আঞ্চলিক ইস্যুকে আভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে দাবী করে ভারত। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি নীতির কারণে একসময় দ্বিপাক্ষিক ইস্যু হিসেবে মানতে বাধ্য হলেও তারা কখনোই দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যা সমাধানে সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখাতে পারেনি। সার্ক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্ভাব্য মধ্যস্থাকারির ভ’মিকাকে তারা কখনোই স্বাগত জানায়নি। একই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার সত্তে¡ও বিশাল ভারতের পাশে পাকিস্তান সবসময় একটি বৈরী প্রতিক’ল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। শুরু থেকেই পাকিস্তানের উপর আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের আধিপত্যবাদী ভ’মিকার কারণেই পাকিস্তানকে পারমানবিক শক্তি অর্জনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বে আঞ্চলিক আধিপত্য ও সংঘাতের ইতিহাস থাকলেও একোবিংশ শতকে এসেও কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবন মান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে পারমানবিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি যুদ্ধংদেহি সশস্ত্র ভ’মিকার এমন নজির আর কোথাও নেই। এক সময়ের বৈরী চীন-রাশিয়ার মধ্যে সীমান্ত বিরোধসহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমঝোতা, সন্ধি ও নিরাপত্তাচুক্তি সম্ভব হলেও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তা কেন সম্ভব হচ্ছে না, এই প্রশ্নের জবাব ভারতীয় নেতাদেরই খুঁজতে হবে। সন্দেহ নেই, এ ক্ষেত্র কাশ্মীর ইস্যু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে কাশ্মীর ছিল স্বায়ত্বশাসিত এলাকা। ভারত ভাগ হওয়ার সময় কাশ্মীরিরা ভারত বা পাকিস্তান ইউনিয়নে যোগ দেয়া থেকে বিরত থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান সম্পর্কে জানান দেয়। দেশভাগের বিতর্কে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, অত:পর বৃটিশদের মধ্যস্থতায় দ্বি-জাতি ত্বত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের বাস্তবতায় কাশ্মীরের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিলনা, মূলত: এখনো নেই। মাত্র কয়েক বছর আগেও(২০১৫সাল) কাশ্মীর হাইকোর্টের একটি রায়ে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় বলে রায় দেয়। ভারতীয় সংবিধানের অপরিবর্তন যোগ্য ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে সীমিত সার্বভৌমত্বসহ বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিজেপি নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় সংবিধানের এই ধারা পরিবর্তন বা বাতিলের দাবী জানিয়ে আসছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বে শান্তি ও রাজনৈতিক সংকটের মূল পীঠস্থান হিসেবে যে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা যায় তার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সংকট। এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে সব সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে তার সবই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সৃষ্টি করা কৃত্রিম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশরের রাজনৈতিক সংকটের পেছনে এসব দেশে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষায় রিজাইম চেঞ্জ ও রিজিম রক্ষার প্রয়াস মাত্র। প্রথমত: মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধ প্রক্রিয়া ও জবরদস্তিমূলকভাবে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে এ অঞ্চলের সব আঞ্চলিক বৈরীতা ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিরোধ ও অস্থিতিশীলতার পেছনে ইসরাইলী আইডিএফ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই মূল ভ’মিকা পালন করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে এই মুহুর্তে শুধু নয়, গত ৬ দশক ধরেই কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্নকে সামনে রেখে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ-বৈরীতা ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার অন্যতম হুমকি হয়ে আছে। তবে ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের মধ্যে ভৌগোলিকভাবে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরত্ব থাকলেও ফিলিস্তিন সমস্যার পাশাপাশি এখন কাশ্মীর সমস্যার পেছনেও ইসরাইলের প্রত্যক্ষ প্রভাব এখন পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুই দশক আগে কাশ্মীরের কারগিলে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান সীমান্তযুদ্ধে যেমন ভারত ইসরাইলী সহায়তা পেয়েছিল, পুলওয়ামা হামলার পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সংকটের পেছনেও ইসরাইলের নেপথ্য ভ’মিকার কথা জানা যায়। গত ২৬ ফেব্রæয়ারী ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিন্তানের বালাকোটে বোমা হামলা করার মধ্য দিয়ে যে নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য, সিদ্ধান্ত এবং শান্তির সদিচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ সশস্ত্র অবস্থায় ধৃত ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতে ফেরত দেয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পারদ অনেকটাই নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের মত দুই পারমানবিক শক্তির মধ্যে একটি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার নেপথ্যে ইসরাইল কলকাঠি নাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক। বৃটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টে লেখা এক নিবন্ধে ফিস্ক এই মন্তব্য করেন। ভারত বা যে কোনো দেশ নিরাপত্তার জন্য সুবিধাজনক যে কোনো দেশের সাথে সামরিক চুক্তি করতেই পারে। তবে যে সমস্যা সামরিক শক্তি দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়, সেখানে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম যুদ্ধবাজ নেতাদের কিছু স্বস্তির খোরাক দিলেও তা শেষ পর্যন্ত দেশগুলোর দরিদ্র মানুষের ট্যাক্সের টাকার বেহিসাবি অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ভারতের বিশাল বাণিজ্য ও লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকের কর্মসংস্থানের অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকায় ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের গোপনীয়তার মোড়কে আবর্তিত হচ্ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সম্পর্ক আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের বিশাল আমদানী বাজেটের ৪০ শতাংশই আমদানী করা হয়েছে ইসরাইল থেকে। ভারতে হিন্দুত্ববাদি বিজেপির ক্ষমতায় আসা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, কাশ্মীর ইস্যু এবং হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরিবেশ এ সময়েই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পুনরায় ক্ষমতায় আসা যখন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তখন হিন্দুত্ববাদি সাম্প্রদায়িকতা এবং পাকিস্তান বিরোধি যুদ্ধের উন্মাদনা ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগাতে চাইছেন বলে মনে করছেন ভারতের বিরোধি রাজনৈতিক নেতারা। এ ক্ষেত্রে তারা দেশের মানুষকে যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা থেকেও যেন সরে এসেছে। ভোটের মাঠের বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খোদ বিজেপি নেতারাও প্রকাশ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত বিজেপি পার্লামেন্টারিয়ান রাজকুমার সাইনী সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ৯০ সংসদ সদস্যই পরাজিত হবেন। ভারতের রাজনীতিতে যারাই ক্ষমতা গ্রহণ করুণ, তাদের প্রজ্ঞা,দূরদৃষ্টি ও সদিচ্ছার উপর এ অঞ্চলের শতকোটি মানুষের ভাগ্য ও নিরাপত্তা অনেকাংশেই নির্ভর করে। ভারত-পাকিস্তানের নেতারা উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা, যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সামগ্রিক কল্যান, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক শান্তির লক্ষ্যে আলোচনার টেবিলে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।