Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ঢাকার অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে যা করতে হবে

আবু আফজাল মোহা. সালেহ | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

জানা যায়, ১৬১০ সালে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আর এখন তো অগ্নিকান্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গার্মেন্ট কারখানা থেকে হাসপাতাল, কলকারখানা থেকে পার্ক- কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছে না আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। ছোট আকারের অগ্নিকান্ড এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বড় আকারের অগ্নিদুর্ঘটনাও ঘটছে। নিমতলি ট্রেজেডি থেকে চকবাজার- বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাজরিনসহ, সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মাঝারি/বিপদজনক ঘটনার আতংক থাকলই। কিন্তু এমনটা কেনো হচ্ছে পুনঃপুন? আমাদের সক্ষমতার অভাব না সচেতনতার অভাব? নাকি নগরপরিকল্পনায় ঘাটতি? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবগুলোই কারণ। বলা যেতে পারে, পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং সরু রাস্তা। এখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ভয়াবহতা তাড়াতাড়ি বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ২০ ফেব্রুয়ারির অগ্নিকান্ড বা চকবাজার ট্রেজেডি কিন্তু আমাদের সতর্ক বার্তা দিয়ে গেল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আমরা যদি সচেতন না হই বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে। 

সংঘটিত অগ্নিকান্ড থেকে আমরা কী শিক্ষা নিচ্ছি? মনে হয় কিছুই না! তদন্ত কমিটি হয় প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু আমরা কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে দেখি না! সরকার অনেক সময় ইচ্ছে করলেও বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণে এগিয়ে যেতে পারে না! অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বেশ কিছু কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ঢাকা বা চট্টগ্রামে অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি। গ্যাসের চুলা, খোলাচুলা, বৈদ্যুতিক শর্টকার্ট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোর্ত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশেপাশে ও মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতা ইত্যাদি কারণে উদ্ধারকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সংঘটিত অগ্নিকান্ড থেকে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতন হলেই অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত বা ক্ষয়ক্ষতির হার কমে যেত। অগ্নিপ্রতিরোধ সামগ্রীর মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনো সামগ্রী বদলানো হয় না। আবার ভালোমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করলেও দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। কিছু অর্থ কম করার জন্য আমরা অনেকসময় নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করি।
আমাদেরকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সচেতন হতে হবে। এ জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। ‘মাইন্ড সেট আপ’ ঠিক করতে হবে। নগরপরিকল্পনায় ব্যাপক চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। বিল্ডিং কোডের ব্যাপারে কোনো আপোষ করা যাবে না। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দোকান অনুমোদন দেওয়া যাবে না। হাসপাতাল বা বিভিন্ন বিল্ডিংসমূহে সচল অগ্নিপ্রতিরোধক সামগ্রী স্থাপন/রাখার ব্যাপারে অধিক কঠোর হতে হবে। বস্তিগুলোতে অনেক সময় নাশকতার জন্যও কেউ কেউ অগ্নিসংযোগ করে থাকে বলে অভিযোগ হয়। এ বিষয়েও তদারকি করতে হবে।
হতাহতের ঘটনার পর দুটো কাজ আমরা খুব দ্রুত করি। এক হচ্ছে তদন্ত কমিটি গঠন এবং দ্বিতীয়ত হতাহতের জন্য সহায়তা। কিন্তু কিছুদিন পরে ভুলে যাই। অনেক তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আসল কারণ বের হয় না! আর ভালো তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনেকক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না বিভিন্ন কারণে। সবাইকে ত্যাগ স্বীকার করে ভালো কাজ এগিয়ে নিতে আমরা ব্যর্থ। কিছুদিন পর হারিয়ে যায় ভয়াবহতার কথা। এভাবেই চলছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে আলাদা ইউনিট প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করেন। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট হিসাবে সেটি পরিচালিত হলে ভালো হবে। এতে কারণ শনাক্ত করতে কম সময় লাগবে এবং কারণগুলোর যথার্থতা বৃদ্ধি পাবে।
একটি জরিপের তথ্য দেখা যায়, দেশের ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল অগ্নিকান্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নেই অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা। ভয়াবহ চিত্র। যেগুলোতে আছে সেগুলোও নিয়মিত চেক আপ করা হয় না। বৈদ্যুতিক সামগ্রীও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বেশিরভাগ ভবনে। আমাদের উচিৎ এ দুটো ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করে নতুন সামগ্রী স্থাপন করা।
গত বছর দেশে যত অগ্নিকান্ড ঘটেছে তার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। তাদের তথ্য বলছে, গত বছর দেশে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ১৮ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে ২,৪৫৩টি ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ছুড়ে ফেলা জ্বলন্ত সিগারেট থেকে যা অগ্নিকান্ডের সব কারণের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। সেই হিসাবে মোট অগ্নিকান্ডের মধ্যে ১৩.৫৫ শতাংশই ঘটেছে ধূমপান থেকে। গত বছরের সব অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট থেকে। এর পরই বেশি আগুন লেগেছে চুলা থেকে। সর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর চুলা থেকে আগুন লেগেছে ২৩.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে।
এখনো সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি কীভাবে চকবাজারের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে ওহেদ ম্যানশন নামের ভবনটির গ্রাউন্ডফ্লোরে বিভিন্ন রকমের দোকান রয়েছে, প্রথম তলায় প্লাস্টিকের পণ্য, প্রসাধনী এবং সুগন্ধি মজুদ করা ছিল। এজন্য ভয়াবহতার হার দ্রুত বেড়ে গেছে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর পাঁচতলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত হয় ১২৪ জন। সে ঘটনার ক্ষেত্রেও দাহ্য পদার্থের উপস্থিতির জন্য হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। মূলত রাসায়নিক গোডাউনের আগুনেই ওই দিনের অগ্নিকান্ডটি ঘটে। গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। তাহলে বড় দুটো অগ্নিকান্ডের ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দাহ্যপদার্থের দোকান স্থাপন করা যাবে না বা এরকম কলকারখানা স্থাপন করা যাবে না।
দেশে প্রতিবছর যত অগ্নিকান্ড হয় সেগুলোর ৪০ থেকে ৫০ ভাগেরই কারণ শর্ট সার্কিট। মূলসড়ক থেকে শুরু করে বাসা বাড়ি কিংবা আধুনিক শপিংমল বেশিরভাগ জায়গাতেই বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা অনেকটাই উপেক্ষিত। আর এ কারণেই ঘটছে প্রাণ ও সম্পদহানির ঘটনা বলছে ফায়ার সার্ভিস। শুধু বাসাবাড়িতে নয় এর আগে বহুবার মার্কেট বা শপিং মলেও ঘটে আগুনের ঘটনা। এসব ঘটনার মূল কারণও ছিলো শর্ট সার্কিট। দমকল বাহিনীর এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন, দেশে যত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে এর বড় একটি অংশই ঘটে শর্ট সার্কিটের কারণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। উন্নতমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা ওয়্যারিংয়ের কাজ স¤পন্ন করা হলে শর্টসার্কিটজনিত দুর্ঘটনার হার নিঃসন্দেহে হ্রাস পাবে।
আমাদের দেশের বস্তিগুলো যেনো বিষফোঁড়া। এখানে নানারকম অনৈতিক কার্যকলাপ হয়। অগ্নিকান্ডের ক্ষেত্রেও এগিয়ে বস্তি।প্রায় ছোটোখাটো অগ্নিকান্ড হয় বস্তিগুলোতে। বস্তিতে অগ্নিকান্ডের বড় কারণ অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অনিরাপদ সংযোগ। বস্তির অধিকাংশ বাড়িতেই অবৈধ বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। এদিকে বস্তির ঘরগুলো কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি। এর ফলে একটি ঘরে আগুন লাগলে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। কারখানার ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও অবহেলার কারণে এ অগ্নিকান্ড ঘটেছে। যেমন তাজরিন অগ্নিকান্ডের জন্য এ কারণ দায়ী করা হয়।
অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে ভয়াবহ তথ্য আছে আমাদের। অতি সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘ইলেকট্রনিক সেফটি এন্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব)’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। তাদের জরিপের মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে অগ্নিকান্ডে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু ২০১৮ সালেই দেশে ছোট বড় মিলিয়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার ৬৪২টি। এতে প্রাণহানি হয়েছে ১৩০ জনের, আহত হয়েছে ৬৬৪ জন। গ্যাসের চুলা ব্যবহারে আমরা অনেকসময় উদাসীন থাকি। ভালোভাবে গ্যাসের চুলা বন্ধ করতে হবে। গ্যাস লাইনে ত্রুটি বা ছিদ্র থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক সময় উত্তপ্ত তেল থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে। আতশবাজি বা পটকা থেকেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অনেকসময় নিন্মমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করলে সে তার দিয়ে বেশি ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে শর্টসার্কিট হয়। রাজধানীতে মূল সমস্যা পানির সংকট। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো এখন আর নেই বললেই চলে। বড় কোনও পুকুর নেই, ঝিল নেই। এমনকি যেসব বাড়িতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে সেই বাড়িতেও পানির রিজার্ভের কোনও চেম্বার পাওয়া যায় না। জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
তাহলে অগ্নিকান্ডের কারণগুলো দেখা যাচ্ছে এরকম- অসাবধানতা, দুর্বল বৈদ্যুতিক সংযোগ, বৈদ্যুতিক ভোল্টেজের ওঠানামা, মেশিনারিজের ঘর্ষণ, বিড়ি-সিগারেট, চুলার আগুন ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, ভবন নির্মাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার, নিয়মিত তদারকি এবং সচেতনতার মাধ্যমে রোধ করা যেতে পারে দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিতে হবে। আগুনের ব্যাপারে সচেতন করতে ব্যাপক আকারে প্রচার করতে হবে। স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত প্রচার চালাতে হবে। জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ ব্যপারে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারের সাথে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। যার যার ক্ষেত্র থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে হাহাকারের হার কমে যাবে নিঃসন্দেহে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অগ্নিকান্ড


আরও
আরও পড়ুন