Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘স্মৃতির মেঘলা ভোর’ ও কবি আল মাহমুদ

মু হা ম্ম দ কা মা ল হো সে ন | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।গ্ধ মৃত্যু এক অবধারিত সত্য, অনিবার্য বাস্তব। জগতের কোনো প্রাণী, কোনো কিছুই মৃত্যুহীন অবিনশ্বর নয়। সকলকে মৃত্যুর অমিয় পেয়ালার স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই যেন মৃত্যুর অমোঘ সত্যের সঙ্গে কবির ইচ্ছেবাণী একাকার হয়ে মিশে গেছে একই মোহনায়। কবি আল মাহমুদ ও মৃত্যু- শব্দগুলোতে পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য সখ্যতা ও মিতালি গড়ে উঠেছে। ‘স্মৃতির মেঘলা ভোরে’ নামক একটি কবিতায় ঠিক এভাবেই কাব্যিক ভাষায় নিজের ইচ্ছের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবি। ওই কবিতায় তিনি বলতে চেয়েছেন - কোনো এক শুক্রবারের ভোরবেলা মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে ডাক দিলে তিনি খুশি মনেই তার ডাকে সারা দেবেন। আনন্দের সঙ্গেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ আর নেই। তিনি এখন স্মৃতির নিকট অতীতের দূূর নক্ষত্রের একটি নাম। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান (ইন্নালিল­াহি... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। কবির মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছেন পারিবারিক বন্ধু এবং কবি আল মাহমুদের একান্ত সহকারী আবিদ আজম। তিনি জানান, ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি আল মাহমুদ। তাকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তিনি অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল হাইয়ের তত্ত¡াবধানে ছিলেন। অবস্থা আরও গুরুতর হলে শুক্রবার তাকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেয়া হয়। পরে রাত ১১টা ৫ মিনিটে তিনি মারা যান। ১৭ ফেব্রুয়ারি রোববার জোহরের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা শেষে তাকে মৌড়াইল পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মা-বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন বাংলা সাহিত্যের এই সময়ের অন্যতম অপরাজেয় শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন থেকে ভুগছিলেন। বাংলা একাডেমি ও জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথমে কবির মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাঁর অসংখ্য ভক্ত, অনুরাগীরা। ঢাকায় দুই দফা জানাজা শেষে শনিবার রাতে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পৈতৃক ভিটায়, মৌড়াইল গ্রামের মোল­াবাড়িতে। কবির পারিবারিক বন্ধু আবিদ আজম জানান, রোববার সকালে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আল মাহমুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পরে বেলা ১১টায় নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুল মাঠে কবির কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। সেখানে কবির স্মরণে তার কবিতা পাঠ করা হয়। জানাজার সময় কবির ছেলে মীর মাহমুদ মনির, কবির একান্ত সচিব আবিদ আজমসহ অনেকে বক্তব্য দেন। মীর মাহমুদ মনির বলেন, ‘আমার বাবা শুধু একজন কবি নন, একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তিনি নদ, নদী ও প্রকৃতি নিয়ে লেখার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), ইসলাম, ক্ষুদিরাম, তিতুমীরসহ অনেক বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আমার বাবার ভালো গুণ ছিল, তিনি অল্পতেই সন্তুষ্ট হতেন।’ আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তাঁর বাবা মীর আবদুর রব ও মা রওশন আরা মীর। তাঁর দাদা আবদুল ওহাব মোল­া ব্রিটিশ-ভারত শাসনামলে হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন কবি আল মাহমুদ। দাফনের আগে ওই স্কুলের মাঠে আল মাহমুদের জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং ভক্ত অনুরাগীরা।
আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও প্রধান কবি। তিনি একধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক। কবিতার পাশাপাশি বাংলা গল্পের এক আশ্চর্য রূপকার তিনি। আল মাহমুদ আবহমান বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ কারিগর। তার সৃষ্টির পরিধি এতো বিশাল ও ব্যাপক যে তাকে একজন যুগশ্রেষ্ঠ কবি বা লেখক হিসেবে চিহ্নিত করলেও অতিরঞ্জিত হবে না। বাংলা কবিতা যাদের হাত ধরে আধুনিকতার চরম শিখরে ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছেছে, আল মাহমুদ তাদেরও অন্যতম। আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই গ্রামীণ বাংলার জনজীবন, রূপ বৈচিত্র্য-আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, ভাটি ও চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহ ও কামকে পরম আন্তরিকতার শৈল্পিত ছোঁয়ায় অনবদ্য চাতুর্যময়তায় তুলে এনেছেন তার কবিতায়। আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি কথাসাহিত্যে তাঁর মৌলিক শৈলীর স্বাক্ষর অব্যাহত রেখেছেন। কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। তার কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে স্থান করে দেয়। একে একে কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্য তিনি প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। সোনালী কাবিন কিংবা মায়াবী পর্দা দোলে ওঠে থেকে যে আল মাহমুদের যাত্রা, সেটা বখতিয়ারের ঘোড়া, প্রহরান্তে পাশ ফেরা, কাবিলের বোন ইত্যাদি হয়ে বার বার তাঁর সম্পর্কে জানান দিচ্ছে যে, তিনি কতটা দূরগামী রেসের ঘোড়া। এ কারণেই ঢাকা এবং কলকাতা মিলিয়ে অখন্ড বাংলা সাহিত্যের বিবেচনায় কবিতার প্রসঙ্গ এলেই পঞ্চাশের কবিদের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় আল মাহমুদকে। তাঁর ‘গাঙের ঢেউ›-এর মতো ‘বলো কন্যা কবুল কবুল› লাইনটি থেকে ‘ঘুমের মধ্যে জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠি› ধরনের পংক্তিগুলো বাংলা কবিতায় আজও মিথ হয়ে আছে। যারা তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ যেভাবে বেড়ে ওঠি পড়েছেন, তারা জানেন, কবিতা ও কাব্যচর্চার মতোই জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাতেও আল মাহমুদ একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। বোহেমিয়ান-সৃষ্টিছাড়া তারুণ্য-যৌবন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রোমান্টিক উন্মাতালতা, গণতন্ত্র ও শুভতার সংগ্রাম এবং সর্বপরি আস্তিক-দার্শনিকতার মাধ্যমে একটি বিশ্বাসী আবহে পৌঁছার প্রয়াসে আত্মার মুক্তির অন্বেষণ আল মাহমুদের জীবন ও কবিতার অভিমুখকে একটি যৌক্তিক পথরেখায় নিয়ে এসেছে। এই মনোদার্শনিক গতিপথ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকার কারণে তিনি গোড়া থেকেই বলতে পারেন যে, ঢাকা হবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, কবিতা ও কীর্তির কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র; বৈশ্বিক রাজধানী। এবং তাঁর কবিতায় ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের প্রকৃতি, প্রেম, সংগ্রাম, সংক্ষোভ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, জীবনবোধ সুললিত কাব্যভাষায় উচ্চারিত হয়। তাবৎ বাংলাদেশ ও এর মানবমন্ডলীকে ঘিরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় প্রপঞ্চকে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বিশ্বাসের নিরিখে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জারিত করে চিরায়ত বাংলার মানবকণ্ঠে কথা বলার ইতিহাসই আল মাহমুদের জীবনেতিহাস। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আল মাহমুদ মূলত বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণযোপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং একের পর এক সাফল্য লাভ করেন। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকা আগেমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র/পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।
কবি আল মাহমুদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ সময়ে নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কার ও সম্মাননাসমূহ হলো: বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দিন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১)। অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। কবির উলে­খযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, অষ গধযসঁফ ওহ ঊহমষরংয, দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোর সমগ্র, কবির আত্নবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, পাখির কাছে ফুলের কাছে, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫), ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য। এছাড়াও তিনি বহু কাব্যগ্রন্থ ও কথাসাহিত্যের নানান জায়গায় উলে­খযোগ্য স্বাক্ষর রেখেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন