Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চকবাজার ট্র্যাজেডি

| প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

পুরান ঢাকায় নিমতলি ট্রাজেডির পর এবার চকবাজারে সংঘটিত হল আগের চেয়েও ভয়াবহ রোমহর্ষক ট্র্যাজেডি। শত শত মানুষ আগুনে ঝলসে অসহায় মৃত্যুর শিকার হওয়ার এই করুণ দৃশ্য সহ্য করার মত নয়। অগ্নিকান্ডের পর অসংখ্য নরনারীর গগন বিদারী আহাজারি, চোখের সামনে প্রিয়জনের শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার এ বিভৎস্য নারকীয় দৃশ্য আর কতবার দেখতে হবে নগরবাসিকে। পুরনো ঢাকার গলি-ঘুপচির বাইরেও গত ১০ বছরে আমরা তাজরিন গার্মেন্টস ও রানাপ্লাজা ট্রাজেডিতে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা দেখেছি। একেকটি দুর্ঘটনায় জানমালের অপুরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পর আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করতে দেখি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের হম্বিতম্বি-প্রতিশ্রুতির বহর দেখি। কিন্তু সে সব তদন্ত রিপোর্ট বা সরকারের প্রতিশ্রুতির কোনো বাস্তবায়ন ঘটে না। ২০১০ সালের ৩রা জুন তারিখ রাতে নিমতলিতে কেমিকেল গুদামের আগুণে পুড়ে শতাধিক (১২৪জন) মানুষ নিহত হওয়ার পর যথারীতি একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ঘটনার ভয়াবহতায় পুরো জাতি দিশেহারা হয়ে যায়। সরকার ৫ জুন একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছিল। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজো আলোর মুখ দেখেনি। পুরনো ঢাকা থেকে কেমিকেল গুদাম সরিয়ে ফেলার জরুরী নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন মহল থেকে কেমিকেল গুদামগুলি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি যে সব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হলে চকবাজারে এমন ভয়াবহ ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি হয়তো ঘটত না।
নিমতলিতে অগ্নিকান্ডের সময় অগ্নি নির্বাপণ কর্মীরা জীবন বাজি রেখেও হতাতহের সংখ্যা কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল, অপ্রশ্বস্ত রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী প্রবেশ করতে না পারা,কাছাকাছি প্রয়োজনীয় পানির যোগান না থাকা এবং পাশাপাশি অসংখ্য উচ্চমাত্রার দাহ্য কেমিকেলের গুদামের অবস্থানের কারণে অতি দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। প্রায় ১০ বছর পর চকবাজারেও একই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। নিমতলি ট্রাজেডির সময় থেকে ক্ষমতা বা প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটেনি। সেই আওয়ামী লীগ সরকার, সেই মেয়র, রাজধানীকে সমস্যামুক্ত করার সেই রাজনৈতিক অঙ্গিকার, কোনো কিছুই বদলায়নি। তাহলে আবারো এত এত মানুষ হতাহতের ঘটনা কিভাবে ঘটল? এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত চকবাজারের অগ্নিকান্ডে অন্তত ৮১জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের প্রায় অর্ধেকই পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া স্বজনরাও এদের পরিচয় শনাক্ত করতে পারবে না। সেইসাথে বেশকিছু মানুষের কোনো হদিস পাচ্ছে না স্ব্জনরা। শেষ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। এত মানুষের মৃত্যু, এত মানুষের আগুনে ঝলসে আহত হওয়ার দায় কার? এ চরম, নির্লজ্জ ব্যর্থতার কোনো ক্ষমা নেই। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে
চকবাজারের অগ্নিকান্ডে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এবং বার্ণ ইউনিটে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। মর্গে শনাক্ত করতে না পারা এবং পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাওয়ার কারণে স্বজনের হদিস না পাওয়া পরিবারের সদস্যদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ধরনের দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন সরকারের সংশ্লিষ্টদের বেশ তৎপর দেখা গেলেও আরেকটি ভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনার আড়ালে এ ঘটনার রেশ হারিয়ে যেতে বেশী সময় লাগেনা। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে এক দশকের বেশী সময় লেগেছে। এর ফলে বুড়িগঙ্গার পানি আরো দূষিত, বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছে। নিমতলিতে কেমিকেল গুদামে অগ্নিকান্ডের পর এ এলাকা থেকে কেমিকেল গুদাম সরিয়ে ফেলার জরুরী নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। বুধবার চকবাজার ট্রাজেডির পর নিমতলি এবং চকবাজারে অবৈধ কেমিকেল গুদামের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। যেখানে মানুষের জীবনের ন্যুনতম নিরাপত্তা নেই, সেখানে সরকারের উন্নয়নের দাবী জনমনে কতটা আস্থা অর্জন করবে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সব ধরনের কলকারখানা সরিয়ে নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। প্রশাসন যেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কেমিকেল গুদাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সেখানে কারখানা ও শ্রমঘনশিল্প স্থানান্তর করবে কিভাবে? পুরনো ঢাকা থেকে সব অবৈধ ও দাহ্য কেমিকেল গুদাম অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। শুধু পুরনো ঢাকাই নয়, ক্রমবর্ধনশীল ঢাকা নগরীকে বাসযোগ্য করতে বাস্তুপরিকল্পনা, বিল্ডিং কোড ও পরিবেশগত নিরাপত্তার দিকগুলোকে আরো গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। নিমতলির পর চকবাজার, এরপর এমন আর কোনো ট্রাজেডি আমরা দেখতে চাই না। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। হতাহতদের পরিবারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য ও ক্ষতিপুরণ দিতে হবে। গতানুগতিক প্রতিশ্রুতি ও তদন্ত কমিটি নয়, করনীয় বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চকবাজার ট্র্যাজেডি

৭ মার্চ, ২০১৯
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন