Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানুষ যাকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছে

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

দেশজুড়ে ধর্মীয় অঙ্গনে আমাকে চেনেন-জানেন, আল্লাহর ফজলে এমন লোকের কোনো অভাব নেই। আমার প্রপিতামহ আজাদীপূর্ব পাক-ভারত-বাংলার মুফতিয়ে আজম শাইখুল হাদিস আল্লামা ইবারত খান (রহ.), আমার দাদাজান পীরে কামেল শাইখুল হাদিস আল্লামা আহমদ আলী খান (রহ.) ও আমার আব্বা মুফাক্কিরে ইসলাম হজরত আল্লামা আতাউর রহমান খান (রহ.) এর প্রায় দ্বিশতবর্ষব্যাপী দীনী কার্যক্রমের ফলে প্রতিটি অঞ্চলের প্রায় পাঁচ প্রজন্ম আমাদেরকে চিনতেন জানতেন ভালোবাসতেন। এই পরম্পরায় আমাকেও চেনেন। নদওয়ায় পড়াশোনা, কওমী অঙ্গনে পারিবারিকভাবে অগ্রপথিকের সেবা, আলিয়া ও সাধারণ শিক্ষার সাথে সংশ্লেষ, পীর-মাশায়েখ ও ইলমী সমাজের অংশ হওয়া, নিজের লেখালেখি, পরিবারের নেতৃত্ব, সমাজসেবা, শিক্ষা আন্দোলন, তরিকা, তাসাউওফ, ইমাম, খতিব, ওয়ায়েজ, মুহাদ্দিস, ইফতা, সংসদ, রাজনীতি ইত্যাদি কারণে এত বছরের এই জানাশোনাটি একই তালে বহমান থাকার সুযোগ পায়। এর মধ্যে পেশাদার লেখক সম্পাদক ও সাংবাদিকতা জানার আরো প্রসার ঘটায়। এ জন্য প্রায় চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে সবসময়ই শিক্ষকতা চলতে থাকলেও একাধারে ত্রিশ বছর সাংবাদিকতায় কাটে। দশ বছর সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আর বিশ বছর দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক হিসেবে জানাশোনার পরিধির পাশাপাশি চেনাজানার পরিধিও বৃদ্ধি পায়। এই অবদান দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষণজন্মা প্রতিভা বহুমুখী কৃতিত্বের অধিকারী মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর। ইনকিলাবে এসে এর প্রতিষ্ঠাতা হুজুরকে আমি বেশিদিন পাইনি। তবে তদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র আমাদের সম্পাদক মহোদয় জনাব আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন-এর সঙ্গ, সান্নিধ্য, মূল্যায়ন ও ভালোবাসা পেয়েছি।

পরিচয়ের সুবাদে দেশব্যাপী সারাবছর বিশেষ করে শীত মৌসুমে আমি সময় দিতে পারলে প্রতিদিন গড়ে দুটি প্রোগ্রামে যোগদানের চাহিদা রয়েছে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আলোচনাসভা, টকশো, গোলটেবিল, মতবিনিময়, তাফসির, খতমে বোখারী, দস্তারবন্দি, ইসলামী সম্মেলন, ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিল মিলিয়ে কমপক্ষে শ’তিনেক প্রতি বছর করতে হয়। গত পাঁচ বছর, করোনার দুই বছর ধরলে সাত বছর বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া খুব বেছে বেছে একশ করে প্রোগ্রাম করি। আমার মনে হয়, খুব কম প্রোগ্রামই এমন হবে, যেখানে বয়স্ক মুরব্বি আলেমগণ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর স্মৃতিচারণ বা আলোচনা করেন না। বিশেষ করে, বিভিন্ন ঘরানার পীর-মাশায়েখ আলিয়া মাদরাসার বড় আলেম এবং সব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আলোচনা করার সময় ইনকিলাবের সূত্র ধরে চলে যান মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর সাথে জীবনের কোনো বাঁকে তার নিজের কোনো স্মৃতির আঙ্গিনায়। আমি যত না লেখক বা আলোচক তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি মনোযোগী শ্রোতা। তাই সময় সুযোগ হলে তাদের আন্তরিক কথাবার্তা মন দিয়ে শুনি। মরহুম হুজুরের আতিথেয়তা, আদর-আপ্যায়ন, টাকা-পয়সা প্রদান, জামা-কাপড়, জুতা-রোমাল-টুপি-পাগড়ি ইত্যাদি গায়ে পরিয়ে দেওয়ার অমূল্য হাদিয়া, বিদেশ সফরে নিয়ে যাওয়া, হজে-ওমরায় প্রেরণ, মাদরাসার মঞ্জুরি প্রদান, প্রশাসনকে বলে দিয়ে সমস্যা সমাধান, রোগীর চিকিৎসা, বিদেশ প্রেরণ, ঈদে-চান্দে উপহার প্রেরণ ইত্যাদি তারা শোকরিয়ার সাথে স্মরণ করেন। খুব ঘনিষ্ঠ আলেমরা এখনো বলেন, জাতীয় প্রয়োজনে ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার শক্তিমান কারিগর ছিলেন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। তাদের এখনো স্মরণ আছে, দীন-ঈমানের প্রয়োজনে হিকমত ও উত্তম পরামর্শের মাধ্যমে তিনি সব সময়ের শাসককে সঠিক পথটি দেখাতেন। কোরআনী পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘বিল হিকমাতি ওয়াল মাওইজাতিল হাসানা।’ অনেকে বলেন, ফুরফুরা, শর্ষিনা, ফুলতলী, বাইতুশ শরফ, চরমোনাইসহ দেশের সব দরবারকে নিজের ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রাখতেন তিনি। অনেকে স্মরণ করে আপ্লুত হন, মরহুম খতিব উবায়দুল হক, শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামসহ প্রথম সারির সব আলেম তার আদর-আপ্যায়নে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নিষিক্ত ও আপ্লুত ছিলেন। মৃত্যুর আগে সুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি আল্লামা আহমদ শফি, হাটহাজারি মাদরাসা, মাওলানা আব্দুল হালিম বোখারী, পটিয়া মাদরাসা, মাওলানা সুলতান জওক নদবী, দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামসহ দেশের বিখ্যাত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে ভিজিট করেন এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সকল মতবৈচিত্র্য ধরে রেখেও যে বৃহত্তর ঈমানি ঐক্য গঠন করা যায়, সে ফর্মুলার প্রচার এবং তা বাস্তবায়নে নিজের সারাজীবনের আকুতি তুলে ধরেন। তার ইন্তেকালের পর এই নক্ষত্রমণ্ডলি আর সমবেত হয়নি। দশ-পনেরো বছরের ব্যবধানে ইসলামী ভূবন ব্যক্তিত্বশালী ওলামা-মাশায়েখের আকাশ আজ প্রায় তারকা শূন্য। মাওলানার সাথে যে সামান্য কয়েক বছর আমরা ছিলাম, এর কিছু স্মৃতি উল্লেখ করা যায়।

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) বর্ণাঢ্য জীবনসংগ্রামের অধিকারী একজন সফল মানুষ। অসাধারণ প্র্রতিভাধর ব্যক্তি। জাতি, ধর্ম, দেশ ও সমাজের প্রতি তিনি জীবনভর কর্তব্য করেছেন। মানুষের জন্য অবদান রেখেছেন নানা অঙ্গনে, নানাভাবে। বড় মনের মানুষেরা তাঁকে কোনোদিন ভুলবে না। চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের কেরোয়া গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক সাধক পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ মার্চ। পিতা হজরত শাহ মুহাম্মদ ইয়াসীন (রহ.) ছিলেন আধ্যাত্ম্য জগতের এক স্বনামধন্য সাধক পুরুষ। শিক্ষাজীবন শেষে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় ছিল তার সুদক্ষ বিচরণ।

বর্ধিত সেবা, অবদান ও বিস্তীর্ণ কর্মস্পৃহার উচ্চাভিলাষ তাঁকে ধীরে ধীরে শিক্ষাঙ্গন থেকে টেনে নেয় জীবনের রাজপথে, জনতার প্রাঙ্গণে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষক সমাজের প্রতিষ্ঠা, অবহেলিত পেশাজীবীদের উপায়ন, দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি, সংগঠন-সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পথ রচনা প্রভৃতি নিয়ে তিনি সফল সংগ্রাম ও সাধনা করে গেছেন। মুসলিম জাতি ও মুসলিম জাহানের ঐক্য-সংহতি উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য তিনি ছিলেন সহজাত চিন্তাবিদ। বাংলাদেশ পর্যায়ে ধর্ম ও সমাজ নেতৃত্বের পারস্পরিক আদান-প্রদান, সংলাপ ও সংহতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, দিকদার্শনিক। বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের সম্প্রীতির সেতুবন্ধন।

২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর চলে যাওয়ার পর থেকে এসব ক্ষেত্রে যে উদাসী শূন্যতা বিরাজ করছে, তা সহসা পূরণ হওয়ার নয়। মাওলানার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও লক্ষ্যভেদী রাজনীতির ফলে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনমানের সন্ধান পাওয়া মাদরাসা শিক্ষক সমাজের দৈনন্দিন জীবনানন্দ যেমন তাঁর অবদানের কথা স্মরণে এনে দেয়; ঠিক তেমনি তাঁর এ ধারার অসংখ্য কাজের সুফল ছড়াতে থাকে সুকর্মের অপার সুরভী। মসজিদনগরী ঢাকার মহাখালীতে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্সের অপূর্ব নির্মাণশৈলী আর নয়নাভিরাম স্থাপত্য যুগ যুগ ধরে ঘোষণা করবে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর জীবন সাধনার শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁর অন্যতম মানস সন্তান দৈনিক ইনকিলাব তিন দশকের অর্জন ও অবদান দিয়ে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে নিরন্তর। তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ চিন্তা, মেধা ও যোগ্যতাবলে দেশ, জাতি ও মানবতার জন্য নানামুখী অবদান রেখে তাঁরই স্মৃতিকে ঔজ্জ্বল্য দান করে যাচ্ছেন প্রজন্মান্তরে। সুকীর্তি ও শুভ কার্যধারা এভাবেই অমরত্ব লাভ করে থাকে।

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছাত্রজীবনে ভালো ছাত্র ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি ছিল খুব মজবুত। শিক্ষকতা জীবনে তিনি ইসলামি শাস্ত্রসমূহের বড় বড় কিতাব পড়িয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টে দক্ষতার সাথে পাঠদান করেছেন। যখন শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছেন, তখনো কিতাবের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বই-কিতাব পড়েছেন। লোকশিক্ষকরূপে মসজিদে বয়ান করেছেন। ইলম তাজা রেখেছেন। মসজিদে গাউসুল আজমে জুমার পূর্বে অথবা অন্যান্য ধর্মীয় বিশেষ দিবস বা রজনীতে বয়ান করেছেন। সেগুলো লিপিবদ্ধ হয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থাকারে পাঠকের হাতে গেছে। বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্ব ও বর্ণনার শৈলী থেকে ধারণাই হয় না যে, এটি কোনো রাজনীতিক, সংগঠক ও ব্যস্ততম সমাজনেতার বক্তব্য। মনে হয়, এ যেন ষোলআনা পেশাদার একজন শিক্ষক-আলেমের তাজা পড়াশোনার ফসল। একাডেমিক বিষয়বস্তু নিয়েও তিনি আলেম ও তালিবে ইলমের সান্নিধ্যে এমন সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন, যা থেকে মনে হতো, তিনি শিক্ষাঙ্গনেই কর্মরত একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ। তাঁর জীবনের শেষ বয়ানেও শ্রোতারা তাফসীর শাস্ত্রের একটি জটিল বিষয়ের আলোচনার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। তিনি সেদিন পবিত্র কোরআনের ষোল পারার তিনটি রুকুর তাফসীর বর্ণনা করেন। সাংবাদিকতা, সংবাদসূত্র বা তথ্য অনুসন্ধানের দর্শনের উপর তিনি নবী করীম (সা.)-এর মৌলিক কর্মনীতিও পবিত্র কোরআনের আলোকে বর্ণনা করেছিলেন। সম্ভবত এটি তাঁর জীবনের শেষ সমাবেশ ও শেষ বক্তৃতা ছিল। মাওলানা আধুনিক আরবি ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিজে ভালো আরবি জানতেন। মধ্যপ্রাচ্যের শাসক ও রাষ্ট্রদূতদের সাথে বিশুদ্ধ আরবিতে ভাববিনিময় করতে সক্ষম ছিলেন। দুঃখজনক হলেও এ দেশের প্রবীণ আলেম প্রজন্মের মাঝে খুব কম ব্যক্তিত্বের ভেতরই ভাষাগত এ দক্ষতা খুঁজে পাওয়া যায়। মাওলানার সপ্রতীভ উপস্থাপন, হৃদ্যতাপূর্ণ ভাববিনিময়, প্রভাবশালী যোগাযোগ এ কারণে অনেক অগ্রসর ছিল। পাশাপাশি তাঁর মেহমানদারি ও উপঢৌকন ছিল আকর্ষণীয়। তাঁর দিলখোলা আপ্যায়ন ও বিস্তৃত দস্তরখানে যারা শরিক হয়েছেন, তারা তাঁর আতিথেয়তা কোনোদিন বিস্মৃত হবেন বলে মনে হয় না।

তিনি তাঁর ভাষাজ্ঞান, ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ ও সঙ্গ-সহবতের ভব্যতার গুণে আরব শাসক এবং দায়িত্বশীলদের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, যা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর জন্য সমস্যা ও অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দেখা দিত। একজন স্বপ্নচারী অথচ বাস্তববাদী, আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী অথচ বিষয়বুদ্ধি ও ব্যবস্থাপনায় অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে মাওলানা প্রজন্মের উদ্দীপনা।

জাতীয় ঐক্য-সংহতি ও ইসলামি উম্মাহর চেতনা সুরক্ষায় মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) নানা মত ও পথের নেতাদের মাঝে অপূর্ব সমন্বয় সাধনের চৌম্বকীয় ক্ষমতা রাখতেন। বাংলাদেশের আলেম সমাজ নানা বিষয়ে বৃহৎ ঐকমত্যে যতবারই পৌঁছেছেন, এর পেছনে মাওলানার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। জাতীয় নানা সঙ্কট বা ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আজকের বাংলাদেশ যখন অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকশূন্য মনে হয়, তখন বারবার মনে পড়ে তাঁর কথা। শত বিরোধ ও বিভক্তি নিয়েও বিভিন্ন চিন্তার নেতারা তাঁর ডাকে এক টেবিলে বসতেন। তাঁর যুক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে সহনশীলতা এবং উদারতার বৃত্তে এক হতেন। এসব যেন আজ শুধুই অতীত স্মৃতি কিংবা হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাওলানা এম এ মান্নান খুব ব্যস্ততার মাঝেও প্রায় সময়ই ইনকিলাব ভবনে তাঁর চেম্বারে বসতেন। অসুস্থতাজনিত কারণে যখন খুব কম আসতেন, তখনো একটা রেওয়াজ ছিল, মাঝেমধ্যেই ইনকিলাব সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বসতেন, আলাপ-আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করতেন। সবশেষে হতো বিশেষ দোয়া-মোনাজাত ও খানাপিনা। নিজের পছন্দসই মাছ, গোশত, চাল, ফিরনি, পায়েস সমন্বয়ে খাস খাদেমদের দ্বারা সুস্বাদু খানা তৈরি করিয়ে বনানী থেকে গাড়ি করে মতিঝিল নিয়ে আসতেন। ইনকিলাব ভবন মিলনায়তনে বা এমডি সাহেবের কক্ষে সমাবেশ হতো। ইনকিলাব পরিবারের জন্য এ যেন ছিল অন্যরকম এক রিক্রিয়েশন। ফেলে আসা সে দিনগুলো এখনো অনেককে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। এমনি এক সম্মিলনীতে একদিন মাওলানা হুজুর কথা বলেছেন, প্রসঙ্গক্রমে আমাকে দেখিয়ে মাইকেই বলতে লাগলেন, এরা তো এখনো বাচ্চা মানুষ। অডিয়েন্স তখন হেসে উঠলে হুজুর বললেন, আমাদের বয়স ও অভিজ্ঞতার তুলনায় এসব মাওলানা তো একেবারেই শিশু। সত্যিই এখন ভাবি, মাওলানা হুজুর চলে গেলেন। বড়দের চলে যাওয়ায় আমার মতো ছোটরাও এখন বড় কেবল নয়, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্নেহ, মায়া-মমতা ও অভিভাবকত্বের চাদরে ঢেকে রাখার মতো মানুষ যেন প্রতিদিনই কমে চলেছে। হে আল্লাহ, এমন বড় মাপের যে ক’জন এখনো হায়াতে আছেন, তাদের তুমি অনেক দীর্ঘায়ু করো।

ধন, জন, জ্ঞান ও প্রতিপত্তিতে লব্ধ, প্রতিষ্ঠ এবং সমূহ সফল জীবনের অধিকারী মাওলানা ছিলেন খুবই নিপুণ ও সতর্ক মনীষার দৃষ্টান্ত। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, উদার, দানশীল, সদালাপী, অমায়িক ও আন্তরিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি তার শত্রুর দৃষ্টিতেও ছিলেন ঈর্ষণীয়। মহাকবি রূমীর ভাষায়: ‘যে গুণটির দরুণ শত্রুরাও তোমাকে হিংসা করার সুযোগ পায় না, সেটি হচ্ছে তোমার বিনয় ও নম্রতা।’ তাঁর বিনয় ও সদাচরণ তাঁর বিরোধীদেরও সমানভাবে পরাভূত করত বন্ধুদের মতোই। একবার মাওলানার চরম দুশমন এক ব্যক্তিকেও চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রেরণ করে তিনি তার মনে কৃতজ্ঞতাবোধ ও নতুন ধারণা জাগ্রত করেন বলে শুনেছি। বিখ্যাত সাবেক ছাত্রনেতা, এমপি ও মন্ত্রী এই নেতা ক্ষেত্র বিশেষে মাওলানার এ বদান্যতার কথা স্বীকারও করে থাকেন।

ইনকিলাব ভবনে একদিন মাওলানাকে দেখেছি রিসিপশনের টেলিফোন সেটটি ঠিক করে রাখতে। রিসিভারটি ক্রাডলে ঠিকমতো বসেনি। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়িতে ওঠার আগে একনজরে এটি দেখে রিসিপশনের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিপুণ হাতে সেটটি ঠিকঠাক মতো রেখে গেট দিয়ে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। আরেকদিন মাওলানার সাথে আমরা দু’একজন লিফটে উঠেছি মাত্র। বাইরে তখন সবেমাত্র এসে পৌঁছেছেন দুই তরুণ সাংবাদিক। মাওলানা লিফটম্যানকে বললেন, একটু দাঁড়াও। এদের তুলে নাও। তিনি এ দুজনকে নিয়েই তবে উপরে উঠলেন। এখনো আলাপচারিতায় আমরা মাওলানা হুজুরের এ ধরনের সূক্ষ্ম সৌজন্যবোধ ও স্নেহপ্রবণতার কথা স্মরণ করে থাকি। আল্লাহ তাঁকে নিজ রহমত ও মাগফিরাতের শীতল ছায়ায় জায়গা করে দিন।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব এবং ধর্ম ও সমাজতত্ত্ববিদ



 

Show all comments
  • সাইফুল ইসলাম ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৭ এএম says : 0
    মাওলানা এম এ মান্নান জনদরদী নেতা ছিলেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়নে এবং মাদরাসা শিক্ষকদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রভূত অবদান রেখে গেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Md.Rashadujaman ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৮ এএম says : 0
    জমিয়াতুল মুদার্রেছীন নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে যে ঐক্য সাধন করে গেছেন তা এখনও শিরাধার্যরূপে বিদ্যমান। তিনি গাউসুল আজম মসজিদ কমপ্লেক্স স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে আহলে সুন্নাতুল জামায়াতে সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Year Ali Sikder ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৮ এএম says : 0
    মাওলানা এম এ মান্নানের বলিষ্ঠ চেষ্টায় অনেক সংস্কার সাধিত হয়, যেমন- রেডক্রসকে রেড ক্রিসেন্ট করা, মাদরাসার শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত করা, আলেমদের মধ্যে রেষারেষি দূর করা, তাসাওউফ চর্চায় নবদিগন্ত উন্মোচিত করা ইত্যাদি।
    Total Reply(0) Reply
  • Ibrahim Hussain Noyon ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৯ এএম says : 0
    মাওলানা এম এ মান্নান সদালাপী ছিলেন। মেহমানদারিতে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তিনি ছিলেন সুবক্তা ও দক্ষ সংগঠক।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohi Uddin ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৯ এএম says : 0
    আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতি ও জনগণের চেতনা ও বিবেকের কণ্ঠস্বর, প্রখ্যাত রাজনীতিক এবং সমাজসেবক দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:)-এর আজ ইন্তেকাল বার্ষিকী। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আমরা তাকে স্মরণ করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Kazi Suzon ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৯ এএম says : 0
    আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:)-এর ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Faysal Mahmud ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০৯ এএম says : 0
    তার প্রতিটি উদ্যোগ, প্রতিটি কর্ম ও সেবা একেকটি মাইলফলক হয়ে আছে। সারা জীবন তিনি জাতি, দেশ, শিক্ষা ও ধর্মের সেবা করে গেছেন। যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি বাঁকে ও পর্যায়ে নানা মহৎ কর্মে, নানা পরিচয়ে তিনি নিজেকে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর করে গেছেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানুষ যাকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছে
আরও পড়ুন