কীর্তিতে ভাস্বর তিনি
আজ মাওলানা এম এ মান্নানের ইন্তেকাল দিবস। বিষাদময় এই দিনটি এলেই সর্বত্র তাঁকে নিয়ে বিশেষভাবে
মনে পড়ে ২০০৪ ঈসায়ী সালের ২০ মে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের কথা। এর উদ্যোক্তা ছিল জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশ। যার সভাপতি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম ও দেশের অন্যতম ইসলামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। সীরাত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়
‘কমিটি চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদারের্ছীনের সভাপতি, দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সাবেক মন্ত্রী আলহাজ্জ মাওলানা এম এ মান্নানকে চলতি ১৪২৫ হিজরী সালের শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব পুরস্কার প্রদান করার সিদ্বান্ত গ্রহণ করেছে।’ সেই মোতাবেক ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে মুহতারাম মাওলানাকে এই সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এর মাত্র দুই বছর পর ২০০৬ ঈসায়ী সালের ৬ই ফেব্রæয়ারি নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান মাওলানা এম এ মান্নান। চলে গেছেন সেই মাওলানা মুহিউদ্দীন খানও। আসলে তো এই আগমন ও প্রস্থানের পালা চিরন্তন। কেউ এখানে চিরকালের জন্য থাকতে পারেনি, থাকতে পারবে না। এই না থাকার মধ্যেও কারো কারো কথা, কারো কারো কীর্তি, কারো কারো স্মৃতি থেকে যায় চির অম্লান চির ভাস্বর। মাওলানা এম এ মান্নান হচ্ছেন তেমনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
জাতীয় সীরাত কমিটির সম্মাননা স্মারকে মুহতারাম মাওলানা হুজুরের জীবন-আলোচনায় আরো লিখা হয়েছিল : ‘প্রাজ্ঞ আলেম, দক্ষ সংগঠক । সকল রাজনীতিবিদ, বহু ভাষাবিদ, অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে যেমন খ্যাত মাওলানা এম এ মান্নান তেমনি চারিত্রিক মাধুর্য়েও তিনি অনন্য। সদালাপী বন্ধু বৎসল অতিথিপরায়ণ উদার ও অমায়িক এই মানুষটি সান্নিধ্যে এসে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারত না। তার বদান্যতা ও উদার হস্তের অবারিত দানে উপকৃত হয়েছে শত সহ¯্র মানুষ। আত্মপ্রত্যয়ী নির্ভীক অধ্যবসায়ী প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, আধ্যাত্মিকতার মহিমায় সমুজ্জ্বল অক্লান্ত কর্মী পুরুষ মাওলানা মান্নান এক জীবন্ত ইতিহাস।’
মনে পড়ে, বিশ্ববিখ্যাত আলেমেদ্বীন শায়খুল ইসলাম ডক্টর আল্লামা তাহের আলকাদেরী একবার এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন হযরত মাওলানা এম এ মান্নানের সাথে সাক্ষাতের। সম্মানিত মেহমানকে নিয়ে আসা হলো। ইনকিলাব ভবনে তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করা হলো। মাওলানা এম এ মান্নান হুজুরের সাথে দীর্ঘক্ষণ তিনি আলোচনা করলেন। কিন্তু সাধ যেন তাঁর পুরোপুরি মিটল না। মাওলানা হুজুর তাঁকে দাওয়াত দিলেন মাহাখালীস্থ মসজিদে গাউসুল আজম ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সে। সেখানেও সংবর্ধনা দেয়া হলো তাঁকে। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলেন দুই মনীষী পুরুষ। সেখান থেকে হোটেলে ফিরে তিনি বললেন, মাওলানা এম এ মান্নান এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর এ সফরকালে আমি কয়েক দিন তাঁর সাথে সাথেই ছিলাম। তিনি বার বারই মাওলানা হুজুরের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বিস্ময় কণ্ঠে তাঁর প্রশংসা করেছেন। বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে রয়েছে তার ‘মিনহাজুল কুরআন’ সংগঠনের শাখা, প্রায় হাজারের মতো যার প্রণীত ইসলামী গ্রস্থ, যার ভাষণের হাজার হাজার ভিডিও ক্যাসেট সারা দুনিয়ায় ইসলামী পয়গাম পৌঁছাচ্ছে, বিভিন্ন ইসলামী চ্যানেলে উর্দু, আরবি, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষায় নিয়মিত যার প্রোগ্রাম দেখছে দুনিয়ার শত কোটি মানুষ- তেমন একজন মহামনীষীর কণ্ঠে বার বার মাওলানা হুজুরের প্রশংসা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কথায় বলে জহুরী জওহার চেনে। এ যেন ঠিক তাই।
মাওলানা হুজুরের সাথে আমি মুসলিম জাহানের বহু দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছি। ওআইসি, পপুলার ইসলামী কনফারেন্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছি। বহু সভা-সমাবেশ, সম্মেলন, মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি, মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষকদের সংগঠনে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তবুও অনেক সময় মনে হয়েছি তাঁকে যেন পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ, বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ এবং দেশের প্রখ্যাত পীর-মাশায়েখদের দরবারে এক রূপে তাঁকে দেখেছি। মনে হয়েছে আল্লাহর প্রেমে, রাসূল প্রেমে আত্মলীন এক মহাসাধক অধ্যাত্মিকতার অতি উচ্চ স্তরের এক দরবেশ। আবার যখন সাংগঠনিক কাজে মশগুল দেখেছি তখন লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করা, কর্মসূচি তৈরি করা তা বাস্তবায়নের জন্য যথোপযুক্ত কর্মী নির্বাচন করা, তাদের প্রত্যেকের কাজ বুঝিয়ে দেয়া, সে কাজ কতটুকু করা হলো তার তদারকিতে লেগে থাকার যে দৃশ্য আমি বার বার দেখেছি তা অতুলনীয়।
রাজনীতি তিনি করতেন, রাজনৈতিক দলের নেতাও ছিলেন তিনি, নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন, বহুবার বিজয়ীও হয়েছেন, একাধিকবার মন্ত্রিত্বের আসনও অলঙ্কৃত করেছেন। কিন্তু তাঁর সম্পূর্ণ বিরোধী মতের, বিরোধী আদর্শের নেতৃবৃন্দের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখনো ক্ষুন্ন হয়নি। পারস্পরিক সম্মান, মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদানে কখনো বিন্দুমাত্র কমতি হয়নি। রাজনীতি রাজনীতির স্থানে ঠিক, ব্যক্তি পর্যায়ে মধুর সম্পর্ক রয়েছে অটুট, অক্ষুণ্ন। যার অভাব আজ বড় প্রকট হয়ে উঠেছে। তিনি পীর খান্দানের লোক ছিলেন, পিতা ও নানা প্রখ্যাত পীর ছিলেন। বিভিন্ন শাখা মাসআলায় তার সুদৃঢ় অবস্থান ছিল, আমল ছিল। কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো পীর মোর্শেদের অন্য মতাবলম্বীর বা তাদের অনুসৃত আমলের বিরুদ্ধাচরণ করতে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতে কখনো তাকে দেখিনি। নিজে তাঁদের খিদমতে দরবারে গেছেন, তাঁরা কোনো সঙ্কট সমস্যায় পড়লে তার সমাধানের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সেই সঙ্কট অতিক্রমের জন্য যত প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দরকার তা করেছেন, সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিরন্তর প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছেন। তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছেন, অতি উন্নত মেহমানদারী করেছেন, তাঁরা তার আচারে-ব্যবহারে, সহযোগিতায়, সহমর্মিতায়, আন্তরিকতায়, আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন। মোহিত হয়েছেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে পীরে পীরে, আলেমে আলেমে যে বিরোধ ও শত্রুতা আমাদের সমাজে দৃশ্যমান, মাওলানা হুজুর তার বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন। শুধু আমাদের দেশে নয়, প্রায় সব দেশে, শুধু আমাদের কালে নয়, সবকালে, এই বিরোধ দৃশ্যমান ছিল ও আছে। কিন্তু মাওলানা হুজুর গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা চালাতেন সদাসর্বদা। বিভিন্ন মতাবলম্বীদের নিয়ে একই মজলিসে বসতেন, পরামর্শ করতেন। মুসলিম উম্মাহর সঙ্কট মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন, সাধ্যানুযায়ী সম্মিলিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতেন। ওহাবী-সুন্নী, কেয়ামী-লা-কেয়ামী, দোয়াল্লীন-জোয়াল্লিনের যে ঝগড়া তাকে কখনো তিনি উস্কে তো দিতেনই না, বরং মতপার্থক্য থাকা সত্তে¡ও বৃহত্তর দ্বীনি স্বার্থে সকলে সম্মিলিতভাবে যেন কাজ করতে পারেন, সে জন্য নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। আজ মুখে এক হবার কথা বললেও অনেকে যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়ার কাজেই মশগুল। এ জন্য মাওলানা হুজুরের মতো পরমতসহিষ্ণু, উদার দিল, দূরদর্শী নায়েবে নবীর বড় বেশি প্রয়োজনীতা আজ তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।
‘খায়রুন্নাস, মানইউন ফিউন নাস’ মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম সেই যে মানুষের কল্যাণ করে’ মাওলানা হুজুর ছিলেন যেন তারই প্রতীক। কেউ রোগ-শোকে, সমস্যা-সঙ্কটে, বিপদে-আপদে তাঁর কাছে ছুটে এলে তিনি তার কথা শুনতেন, পরামর্শ দিতেন, সার্বিক সহযোগিতা করতেন, প্রয়োজন হলে আর্থিক সাহায্য দিতেন। এ ক্ষেত্রে পরিচিত-অপরিচিতের প্রশ্ন ছিল না, আপন-পরে ভেদাভেদ ছিল না।
তার মুখের কথায় যেন জাদু ছিল। সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা পরিবেশে, দেশে কি বিদেশে মুহূর্তের মধ্যে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। চরম অনিশ্চতার অন্ধকারে তিনি পথ খুঁজে বের করতে পারতেন। বৈরী পরিবেশকে অনুক‚ল পরিবেশে রূপান্তরিত করে নেয়ার অদ্ভুত কলা-কৌশল জানা ছিল তাঁর। সাধারণ লোক থেকে বিদেশী রাজা-বাদশাদের পর্যন্ত বন্ধু বানিয়ে ফেলার দক্ষ ওস্তাদ ছিলেন তিনি।
কাজ করার আগে তিনি ভাবতেন, মনে মনে পরিকল্পনা করতেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল-অর্থবলের ব্যবস্থা নিতেন। কাজে হাত দিয়ে আর পিছপা হতেন না। লেগে থাকতেন, অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত বিরাম, বিশ্রাম নিতেন না। কেউ শৈথিল্য প্রদর্শন করলে বিরক্ত হতেন, ভর্ৎসনা করতেন, হয় মন্ত্রের সাধন, নয় শরীর পতন’ এটা ছিল তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য।
কাজের জন্য তিনি কাজের পরিবেশ তৈরি করতেন। ইনকিলাব প্রতিষ্ঠাকালে তার ভবন নির্মাণকালে তিনি বলতেন, আমার লোকেরা (সাংবাদিক কর্মকর্তা, কর্মচারী) যে স্তরেরই হোক না কেন, এখানে যেন বাড়ির চেয়ে সুন্দর পরিবেশ পায়। অফিস ছুটির পরও যেন কর্মস্থলে অবস্থান করায় আগ্রহী হয়। কোটি টাকার মেশিনটি নিজে নিজে কাজ করবে না। তার পেছনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে তার দিকে নজর দিতে হবে আরো বেশি। যিনি যেখানের যোগ্য যে কাজে নিয়োজিত তিনি সেই কাজটিই করবেন, চেইন অব কমান্ডও থাকবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে আমরা একই পরিবারভুক্ত। সবাই ইনকিলাব পরিবারের সদস্য। বাস্তবিকই তিনি সবার মধ্যে এই বোধ জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবাই তাকে কেবল মালিক নন, পিতার মতো অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন।
তিনি সবাইকে কর্তব্যনিষ্ঠ, দায়িত্বসচেতন, আদর্শপরায়ণ হওয়ার উপদেশ দিতেন। বলতেন, আমরা ইসলামের ব্যাপারে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে, দেশের স্বার্থের ব্যাপারে, আপোষহীন। আমরা কারো কাছে দায়বদ্ধ নই। আমরা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা, কল্যাণের কথা বলে যাব। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করব না। কোনো কিছু লিখব না। আমরা চরমপন্থী হব না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করব। দেশের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকবে, দেশের আইনের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা থাকবে। এই নীতি ও আদর্শে অবিচল থাকলে আল্লাহর সাহায্য আসবে। ইনকিলাব সমাজে সত্যিকার ইনকিলাব সৃষ্টি করতে পারবে। সবার নিকট প্রিয় পত্রিকা হিসেবে বরণীয় হবে। মাওলানা হুজুর আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে না থাকলেও আত্মিকভাবে আমাদের সাথেই আছেন, থাকবেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।