Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

একদিন জবাবদিহি করতেই হবে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, ‘যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নিকৃষ্ট নির্বাচন হলো বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। আসল কথা হলো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি নির্বাচনের ফলাফল চুরি করেছে, আর যারা নিজেদের সরকার বলে দাবি করছে তারা অবৈধ। বাংলাদেশে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারিতাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দ্য ফ্রাইডে টাইমসে লেখা এক বিশেষ নিবন্ধে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন মাইলাম। নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ এবং কার্যকর ভ‚মিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে নিবন্ধে কড়া সমালোচনা করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, তাতে বিশ্বশান্তিরক্ষা মিশনে বাহিনীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং প্রশ্ন তৈরি হবে। মাইলাম বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে ২০১১ সাল থেকেই বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা ধারণা পোষণ করে আসছিলেন।
সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগও প্রকৃতপক্ষে তা প্রমাণসহ দেখিয়ে দিলো। বিরোধীদলগুলোর ওপর যত রকমের সন্ত্রাস চালানো যায় তার সব প্রয়োগ করেই ৩০ ডিসেম্বরের ভোট হয়েছে। ভোট চুরির সব নোংরা কৌশল প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা এবং তার দল ৯৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ ফলাফল নিজের দলের জন্য ভাগিয়ে নিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের ভোটের চিত্র তুলে ধরে মাইলাম বলেন, বিরোধী দলের প্রার্থীরা যেন তাদের আসনগুলোতে কোনো রকমের প্রচার-প্রচারণা না চালায়, বাইরে না যায়, সে জন্য হুমকি আর ভয় দেখানো হয়েছিল। মিথ্যা মামলায় অনেককে আটক করা হয়। অনেকের নামে আগেই আদালতে প্রহসনের মামলা দায়ের করা ছিল। কিছুসংখ্যক মানুষকে গুম করা হয়। নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রাণশক্তি পোলিং এজেন্টদেরকে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। আর এ ভয়েই অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সাহস করেননি। ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুমকি দেয়া হয়েছে ভোটারদেরও। গ্রামে মহিলা ভোটারদের ভোট না দিতে ভয় দেখিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আর যারা ভোট দিতে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে তাদেরকে হুমকি দিয়ে কিংবা পুলিশ দিয়ে বাধা দেয়া হয়েছে। আর কেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছে। আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, সে যে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল তার সবগুলো ভোট কাস্ট করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষে।’
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই সঠিক ছিল না বলে দাবি করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র বলেন, অবশ্যই নির্বাচন পারফেক্ট ছিল না। তাই আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ একটি সংলাপের জন্য উৎসাহিত করি, যাতে যতটা সম্ভব বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে ইতিবাচক শৃঙ্খলা আনা যায়।’
পত্রিকান্তরে আরো প্রকাশ যে, ‘যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছেন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও ভোটারদের কাছ থেকে নির্বাচনের এমন বিবরণ শোনার পর তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, নতুন করে নির্বাচন হওয়া দরকার। সুপ্রিমমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক এই বিচারপতি ৭৫ বছর বয়সী আব্দুস সালাম বলেন, এখন আমি সবকিছু জানতে পেরেছি এবং বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি জানায়, তাদের জরিপ করা সব এলাকাতে নির্বাচনি প্রচারে কেবল ক্ষমতাসীন দলটিই সক্রিয় ছিল। কখনো কখনো স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি সম্পদের সহায়তা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে ভিসা ইস্যু না করায় ভোট পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে মার্কিন তহবিলের বেশকিছু পর্যবেক্ষক। সংস্থাটির সভাপতি আব্দুল সালাম বলেন, তাদের পর্যবেক্ষকরা মাত্র কয়েকটি নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছেন। কাজেই এতে নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। তিনি বলেন, কয়েকজন প্রিজাইডিং অফিসার তাকে বলেছেন ব্যালট বাক্স ভরতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।’
৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন যদি সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য হয় তবে ভবিষ্যত নির্বাচনী পদ্ধতি কী হবে তা যে কতখানি ভোট ও ভোটারবিহীন হবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। বিষয়গুলি যদি স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থার প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করি তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শাসকগোষ্ঠি ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি জান্তাদের দ্বারা সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে যে নির্যাতন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয় তখন শ্লোগান উঠেছিল ‘হাতমে বিড়ি, মুখমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ পাকিস্তানিদের অত্যাচারে এ দেশের মানুষের অবস্থান পরিবর্তন করে বলেছে ‘লাখো ইনসান ভ‚খা হায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়।’ গণমানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে নাই তখনই পাকিস্তান থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক সময় পূর্ব বাংলা তথা পূর্বপাকিস্তানের সকলেই মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে একসময় মানুষ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেয়, পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে সৃষ্টি বিভিন্ন দল সৃষ্টি হলেও ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আইন করে জাতীয় সংসদে সৃষ্টি হয় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে যা ‘বাকশাল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দলটি দলে-উপদলে বিভক্ত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া, এ প্রক্রিয়া স্থায়ী নয়। জনগণ বিভিন্ন সময়ে যুগে যুগে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিষ্পেষিত হয়েছে, কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষ রাষ্ট্রের চেহারার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রযন্ত্র স্বৈরাচারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু শেষাবদি জয় হয়েছে জনগণের। জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে অনেককেই ক্ষমতায় বসিয়েছে, কিন্তু এখন শুরু হয়েছে ভোটবিহীন ক্ষমতা দখল। এ জন্য জবাবদিহিতা থেকে সংশ্লিষ্ট কেউই বাদ যাবে না, কারণ, একদিন না একদিন জবাবদিহি করতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন