পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নির্বাচন সম্পর্কে দেশে এবং বিদেশে যত বিরূপ মন্তব্যই হোক না কেন, কঠোর বাস্তব হলো এই যে, নির্বাচন হয়ে গেছে। সব দল এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। একথা ঠিক যে শতাধিক ক্যান্ডিডেট বেলা ১২ টার মধ্যেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু দলীয়ভাবে বা জোটগতভাবে নির্বাচন বর্জনের কোনো ঘোষণা আসেনি। যিনি যেভাবেই বলুন না কেন, সাংবিধানিক এবং আইনি অবস্থান এই যে, এই নির্বাচন বৈধতা পেয়েছে। শুধুমাত্র মুখে বললেই হবে না যে, আমরা এই নির্বাচন মানিনা, আমরা এই পার্লামেন্ট মানিনা, আমরা এই সরকার মানিনা। কঠিন বাস্তব হলো এই যে, বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে কোনো হরতাল ঘেরাও বা এই ধরণের কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। নির্বাচন হয়েছে ঠিক এক মাস আগে। এই এক মাসের মধ্যে দুই একটি প্রেস কনফারেন্স ছাড়া ড. কামাল হোসেন বা মির্জা ফখরুল নতুন নির্বাচনের দাবিতে কোনো রকম কর্মসূচি দেননি।
এর মধ্যে ২৯০ জনেরও বেশি সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেছেন। মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। দু দিন পরে নবগঠিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসবে। রাষ্ট্রপ্রধান যথারীতি সংসদে ভাষণ দেবেন। তারপর সংসদ স্বাভাবিক গতিতে তার কাজ কর্ম শুরু করবে। ঐ দিকে নির্বাচন এবং সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ওআইসি সহ অনেক দেশ এবং সরকার। আমেরিকা নির্বাচনে ত্রুটি আছে বললেও এবং সেই সব ত্রুটির তদন্ত দাবি করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কারচুপি , ভোট ডাকাতি, পুলিশের ভোট দেওয়া, এজেন্টদেরকে বের করে দেওয়া এসব হাজারও অভিযোগ করা সত্তে¡ও সরকার অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থানে আছে। এ সরকারের প্রতি বিরোধী দলের তরফ থেকে কোনো হুমকি নাই। কোনো দৈব দুর্বিপাক অথবা কোনোরূপ অস্বাভাবিক বা অলৌকিক ঘটনা ছাড়া এই সরকার আগামী ৫ বছরের জন্য দেশ শাসন করবে।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে আর একটি বিষয় আরও স্পষ্ট ভাবে সামনে এসেছে। সেটি হলো, শেখ হাসিনা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি বাংলাদেশের একচ্ছত্র নেতা। তিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। কে বিরোধী দলে যাবে বা যাবে না সেটিও তিনিই ঠিক করে দিচ্ছেন। সুতরাং বিএনপির ৬ জন ও গণফোরামের ২ জন মোট ৮ জন ছাড়া ২৯২ জনই শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত। শেখ হাসিনা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই দেশ চলবে এবং তিনি দেশ চালাতে পারবেন। আমি এতগুলো কথা বললাম এজন্য যে, নির্বাচনের পরে যে অস্বাভাবিক শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং শেখ হাসিনা যে আন চ্যালেঞ্জনড পাওয়ার নিয়ে এবার ক্ষমতায় বসেছেন সেই পটভূমিতে এই দেশ এবং এই দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করার বিরাট সুযোগ এখন তার সামনে উপস্থিত। তিনি চাইলে এখন দেশটির চেহারাই পাল্টে দিতে পারেন। সুযোগ সব সময় আসেনা। এবার তার সামনে এসেছে দেশ সেবার, জনগণের সেবার এবং দেশকে উল্লম্ফন গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ। দেশবাসী আশা করে যে, তিনি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন।
দুই
প্রথমেই রাজনৈতিক ফ্রন্ট। নতুন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে সততা এবং ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাদেরকে সব রকম দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকতে বলেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধান মন্ত্রী বলেছেন যে, দেশ শাসনের বেলায় সব মানুষকে সমান চোখে দেখা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য প্রশংসাযোগ্য। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এ পর্যন্ত যতগুলো কথা বলেছেন সেই সব কথা যদি কাজে পরিণত করতে পারেন তাহলে তার সরকারের বিরুদ্ধে অতীতে যত রকম মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে সেগুলির অনেকটাই মুছে যাবে এবং নতুন করে এই সরকারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হওয়া শুরু হবে। আর সেটা করতে গেলে সবচেয়ে আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো, প্রধানমন্ত্রীর মনে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। আমার তো মনে হয়, তার এই মানসিক রূপান্তর ঘটা খুব কঠিন কোনো বিষয় নয়। কারণ এ পর্যন্ত তিনি ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন। এবারে যে মেয়াদ শুরু করলেন সেটা পূর্ণ হলে তিনি ২০ বছরের মেয়াদ পূরণ করবেন। এবার তার ২০ বছরের প্রস্তাবিত শাসনের ১৫ তম বছর শুরু হলো। তার এই মেয়াদ শেষ হলে তার বয়স ৭৭ অথবা ৭৮ হবে। অর্থাৎ তিনি ৮০ বছরের কাছা কাছি চলে যাবেন। মানসিক পরিবর্তনের এটিই সময় এবং দেশের আমুল পরিবর্তনের এটিই সুর্বণ সুযোগ।
সব মানুষের চোখে যেটা দৃশ্যমান সেটা হলো এই যে, তার সামনে তো বস্তুত কোনো বিরোধী দল নাই। সংসদে তো নাইই, সংসদের বাইরেও নাই। বিরোধী দলের সবচেয়ে বড় দুই নেতা, যাদের ক্যারিশমাও আছে, তাদের একজন লন্ডনে। তিনি যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তি। এই সরকার তাকে আসতে না দিলে তার পক্ষে দেশে ফেরার কোনো চান্স নাই।
আর এক ব্যক্তি হলেন লন্ডনে অবস্থানরত ঐ নেতার মাতা। তিনি ১০ বছরের কারাদন্ড নিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত প্রাক্তন কারাগারে ব্যক্তিগত পরিচারিকা নিয়ে নির্জন কারাবাস করছেন। তার অপর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো ইন্তেকাল করেছেন। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান উভয়েরই স্ত্রী দেশের বাইরে। সুতরাং বলা যায় যে, শেখ হাসিনার সামনে এই মুহুর্তে ফরমিডেবল কোনো প্রতিদ্ব›িদ্ব নেতা নাই। এগিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনার পক্ষে মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা। এখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মন জয়ের জন্য শেখ হাসিনার সামনে এক বিরাট সুযোগের দ্বার উদঘাটিত হয়েছে।
এখনও বিএনপির হাজার হাজার কর্মী মামলা এবং হামলায় জর্জরিত। এখনও মামলা এবং গ্রেফতার চলছে। এই তো ৭ দিন আগেও বগুড়ার শিবগঞ্জ বিএনপির সভাপতি শাহে আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সব গ্রেফতার এখন কি না করলেই চলে না? এখনও বিএনপির হাজার হাজার নেতা কর্মী হয় কারাগারে, না হয় পলাতক জীবন যাপন করছেন। নির্বাচনের সপ্তাহ দুইয়েক আগে অনেকে আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে ইলেকশনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু দু চার দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল পুলিশ তাদেরকে দৌড়ের ওপর রেখেছে। ফলে এই শত শত ও হাজার হাজার কর্মীকে আবার আন্ডার গ্রাউন্ডে যেতে হয়েছে। ইলেকশনের পর যারা ভেবে ছিলেন যে, এখন আর পুলিশ কোনো কিছু করবে না, তখন তারা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বেরিয়ে এসে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিম্ন আদালতে আত্ম সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু নিম্ন আদালত তাদের অধিকাংশকেই জামিন দেয়নি। ফলে তাদের অনেককেই শ্রী ঘরে ঢুকতে হয়েছে। আর এই অবস্থা দেখে অন্যেরা জামিন চাইতেও সাহস পাননি। ফলে আবার সেই পলাতক জীবন।
তিন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি পারেন না এই সব মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নিতে? প্রথম দফায় তিনি সমস্ত গায়েবি মামলা তুলে নিতে পারেন। গায়েবি মামলা যে আছে সেটি তো এর মধ্যে অনেক গুলো কেসে প্রমাণিত হয়ে গেছে। গত ২৫ জানুয়ারি ইংরেজি ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বড় ছবি প্রকাশিত হয়। ছবিতে দেখা যায় এক ভিক্ষুক। তার ডান হাত সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। এই হাত সম্পূর্ণ অচল। বাম হাতও আধা পঙ্গু। বাম হাত দিয়েও সে ভাত তুলে খেতে পারে না। সেই ব্যক্তিকে বোমা হামলার মামলায় আসামী করা হয়েছিল। ঐ ভিক্ষুক জামিনের জন্য যখন উচ্চ আদালতের বিচারপতির সামনে হাজির হয় তখন বিচারপতির মুখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়। এমন ব্যক্তি কি কোনো দিন বোমা ছুঁড়তে পারে? তাই তার তাৎক্ষণিক জামিন হয়ে যায়। অনেক মৃত ব্যক্তি অথবা কয়েক বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন, এই ধরণের ব্যক্তিকেও আসামী করা হয়েছে। এই সব জামিন তো ২৪ ঘন্টার মধ্যেই দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া শত শত ব্যক্তি কারাগারে আছেন, যাদের বিরুদ্ধে কোনো কেস দাঁড় করানো সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকেও তো ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। অসংখ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় অতীতে কোনো রেকর্ড নাই। এবারও তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সপক্ষে কোনো প্রমাণ নাই। অথচ তারা বছরের পর বছর নিজের বাড়ী থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই সব লোকের মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা মুহুর্তের মধ্যে উঠিয়ে নেওয়া যেতে পারে। অবিলম্বে যদি এই সব পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলে বেশ কয়েক হাজার ব্যক্তি বাইরে এসে মুক্ত বায়ু সেবন করতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা পুলিশ ভাল ভাবেই জানে যে, যে সব হাজার হাজার ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে আত্মগোপনে আছে অথবা যারা বিনা বিচারে দীর্ঘ দিন ধরে কারাবাস করছে তারা এই বছরের পর বছর কোথাও কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধমূলক কাজ করেনি। এসব লোককে মুক্ত মানব হিসাবে বিচরণ করতে দিলে প্রধান মন্ত্রীর যেমন লাভ হবে তেমনি তাদেরও লাভ হবে। কারণ সরকারের ওপর থেকে তাদের ক্রোধ এবং বিদ্বেষ কমে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পরোক্ষভাবে হলেও তাদের একটি দুর্বলতা জন্মাবে। আর একটি বিষয় হলো এই যে, ২০১৫ সালের আন্দোলনের সময় যেসব নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার অনেক গুলো মামালা বিগত নির্বাচনের আগে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। গত নির্বাচনের আগেও হাজার হাজার মামলা হয়েছে। এখন যদি এসব মামলা প্রত্যাহার করা না হয় তাহলে একটা ধারণা থেকে যাবে যে পরবর্তী নির্বাচনে এই সব মামলাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে রাজাকার, আল বদর এবং পাকিস্তান পন্থীদেরকে ক্ষমা করে দেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জাতির মধ্যে বিভাজন রেখা উঠিয়ে দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সাধারণ ক্ষমার আওতায় অনেক পাকিস্তানপন্থীকে তার প্রশাসনে জড়িত করেন। এর ফলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা যদি বিভাজন রেখা অব্যাহত রাখতেন তাহলে হয়তো আবার গৃহযুদ্ধ হতো, আবার রক্তক্ষয় হতো।
উদাহরণ আর বাড়াতে চাই না। সমগ্র বাংলাদেশি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, বিরাজমান বিদ্বেষ দূর করে একটি শক্তিশালি জাতি গঠনের জন্য শেখ হাসিনার সামনে সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। আশা করি, তিনি সেই সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করবেন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।