পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
এ যেন আলেমদের মিলনমেলা। সারা দেশ থেকে আসা হাজার হাজার আলেম, পীর-মাশায়েখ একত্রিত হয়েছেন। গায়ে পাঞ্জাবি-পরনে সাদা পায়জামা আর সবার মাথায় সাদা রঙের টুপি একেবারেই অন্যরকম দৃশ্য। সাধারণত এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মাহফিল হয়; কিন্তু এতগুলো দেশবরেণ্য আলেমের একত্রিত হওয়ার নজির খুব কমই ঘটে। গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও বি এইচ হারুন এমপির ‘সংবর্ধনা ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানে’ তারা একত্রিত হন। আর আলেমদের এই মহা-মাহফিলের আয়োজন করে দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের একমাত্র অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। সংগঠনের সভাপতি এবং দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিলে দেশের প্রথিতযশা ইসলামী চিন্তাবিদ, বরেণ্য আলেম, ওলি-আউলিয়া ও ইসলামী পন্ডিতদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা ইসলামী ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। তারা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত করতে সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলছি, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলব। তিনি মহানবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার আহ্বান জানান।’ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলেম-ওলামাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই দেশকে এগিয়ে নিতে চান। এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, দেশের আট কোটি মানুষ সপ্তাহে একই সময়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। প্রতি বছর দুই লাখের বেশি মাহফিল হয়। মূলত, মসজিদ ও মাহফিলে সামাজিক জনমত গঠন হয়ে থাকে। পুলিশ-র্যাব দিয়ে মাদক বন্ধ হবে না। আলেম সমাজকে কাজে লাগিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণে জনমত গঠন করে ড্রাগমুক্ত দেশ উপহার দেয়া সম্ভব। কাজেই আলেমদের কাজে লাগাতে সরকারকে অগ্রণী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শরিক হতে গতকাল (শনিবার) ফজরের নামাজের পর থেকেই গাউছুল আজম কমপ্লেক্সে আসতে শুরু করেন দেশবরেণ্য আলেম, সারাদেশের মাদরাসা প্রধান, শিক্ষক-কর্মচারী, পীর মাশায়েখ, বিশিষ্ট আলেম, ওলামাবৃন্দ। সকাল ৮টার পর মহাখালিস্থ গাউছুল আজম কমপ্লেক্সে আলেম-ওলামদের ঢল নামে। মাহফিল স্থানে আলেমদের বসার জন্য পাঁচটি জায়গায় হাজার হাজার চেয়ার বসানো হয়। নির্ধারিত চেয়ারের পরও মসজিদের ভেতর-বাইরে, গাছের নিচে, আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বসে মাহফিলে শরিক হন। তাদের জন্য মঞ্চে বসা অতিথিদের দেখা এবং বক্তব্য শোনা জন্য একাধিক প্রজেক্টর বসানো হয়। হাজার হাজার মানুষ অথচ সবাই সুশৃঙ্খল। পিনপতন নীরবতায় অতিথির জন্য অপেক্ষা করেন আলেম-ওলামা মশায়েখগণ। মাহফিলের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন ও মহাসচিব অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী যখন অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে উঠেন, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করে স্লোগান দেন উপস্থিত তৌহিদি জনতা। আলেমদের উপস্থিতি, সমাবেশে দীর্ঘ সময় চেয়ারে বসে অপেক্ষা করা, বক্তৃতা শোনা, নানা প্রয়োজনে একে অপরের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মতো এবং শিক্ষণীয়। কয়েকশ’ শিক্ষয়িত্রীকেও দেখা গেছে মঞ্চের অনতিদূরে বসে বক্তৃতা শুনতে।
মহানবীর পথ অনুসরণ করে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করব : আ হ ম মুস্তফা কামাল
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলার ঘোষণা দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘দেশকে এ দু’টি অপরাধ থেকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি। আমরা অন্যায়, দুর্নীতি করব না। ঘুষ দেবো না। আমাদের নবীজী (সা.) ঘুষ-দুর্নীতি পছন্দ করতেন না। আমাদের সবার উচিত প্রিয় নবীর (সা.) পথ অনুসরণ করা। ঘুষ দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ। ঘুষ দিলে জাহান্নামে যেতে হবে। তাই সবাইকে অঙ্গীকার করতে হবে, কেউ ঘুষ দেবো না। কোনো কাজ দু’দিন দেরি হলেও আমরা ঘুষ দেবো না। প্রধানমন্ত্রী ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলছি, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলব।’
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মনে করেন মন্তব্য করে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘তিনি জমিয়াতের একজন অংশীদারও। প্রধানমন্ত্রী যেখানে নিজে যেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার মনে করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ করতে অসুবিধা হবে বলে আমি মনে করি না। তিনি বলেন, আমরা এই পৃথিবীতে চিরকাল থাকার জন্য আসিনি। এসেছি ক্ষণিকের জন্য। আল্লাহর সাথে একটি চুক্তি করে এসেছি। এই চুক্তিটি হলো- আমরা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, তাকে খুশি করার জন্য তার যাবতীয় সাংবিধানিক চাহিদা আছে সেগুলো আমরা পূরণ করব। সাংবিধানিক চাহিদা হলো- আমাদের পবিত্র কুরআন এবং প্রিয় নবীর (সা.) রেখে যাওয়া সুন্নত। আমরা সে অনুযায়ী আমাদের জীবনকে পরিচালিত করব।’
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ৪শ’-৫শ’ বছর আগে যাকে বলা হতো মধ্যযুগের দেশ। সেই সময়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিল ইসলাম। সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ইসলামের ছিল জয়জয়কার। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা মুসলমান, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের মধ্যে অনেক বিরোধ-বিভাজন। আর এসব কারণে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে যেতে পারিনি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি।
সকলের মাঝে দেশপ্রেম থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাঁটি মানুষ ও খাঁটি মুসলমান হতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম থাকতে হবে। যার দেশপ্রেম নেই; সে কখনো খাঁটি মুসলমান হতে পারে না। আলেম-ওলামাদের উদ্দেশ্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা অনেক ভালো কাজ করেন। ভালো কাজ করেন বলেই দেশের অর্থনীতি আজ অনেক সমৃদ্ধ। সারাবিশ্বের মানুষ আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিয়ে গর্বিত। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। পিছিয়ে পড়া দেশগুলো আজ সামনে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করে। দেশের এই অবদান সকলের। আপনাদেরকে বাদ দিয়ে দেশ এই অবস্থানে আসতে পারত না।’
সামর্থ্যবানদের যাকাত প্রদানের তাগিদ দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি যখন রমজান মাস আসে মসজিদে জুমা এবং অন্যান্য নামাজের সময় ফিতরা আদায়ের তাগিদ দেয়া হয়। আমার অনুরোধ থাকবে, এখন থেকে ফিতরা আদায়ের পাশাপাশি আমাদের মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য যাকাত দেয়া। উপযুক্তদের সবাইকে যাকাত দিতে হবে। তাই এ ক্ষেত্রে আপনারা আলেম-ওলামারা সবাইকে অনুরোধ করবেন।’ তিনি বলেন, ‘পবিত্র কুরআনে ৩২ বার আল্লাহ যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন। এটা ইনকাম ট্যাক্সের জন্য নয়; ইনকাম ট্যাক্সের আওতার বাইরে। আমাদের সমাজে কিছু দরিদ্র মানুষ আছে। তাদেরকে যাকাতের মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে। যাকাত গরিবের হক। যাকাত দিলে কারো সম্পত্তি কমে না। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হয়, সম্পদ পবিত্র হয়, বৃদ্ধি হয়। সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে আমরা সবাইকে যাকাত দিতে উদ্বুদ্ধ করব। তাহলে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হবে।’
শুধু নিজের কথা নয়, পিতা-মাতার কথাও চিন্তা করার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবাই আমাদের পিতা-মাতার প্রতি তাদের হক আদায় করব। পিতা-মাতার হক আদায় করতে হবে। এটা করতে পারলে সারা পৃথিবী বেহেশতে পরিণত হবে। মারামারি-হানাহানি চাই না। একই সঙ্গে আমরা একজনের অনুপস্থিতিতে কথা বলি, গিবত করি। গিবত বড় অন্যায় কাজ। এটা না করে মানুষকে নামাজে অকৃষ্ট করবেন। নিজেরা শুধু নামাজ পড়বেন, অন্যেরা নয়; এটা হবে না। নিজের ছেলে-মেয়েকে নামাজে আকৃষ্ট করবেন। অন্যদেরও নামাজের আহ্বান জানাতে হবে।’
মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ভ‚মিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে জমিয়াতের ঐতিহাসিক ভ‚মিকা আছে। এ সংগঠনের নেতৃত্বেই মাদরাসা শিক্ষার বৈষম্য দূর হয়েছে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সমান মাদরাসা শিক্ষকরা সুযোগ ও মর্যাদা পাচ্ছেন। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা আলেমের পাশাপাশি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ সবই হয়েছে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বর্তমান সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীনের সুযোগ্য নেতৃত্বে।’
শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আপনারা অনেক আলোকিত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী ও শিক্ষিত ভয়ের কোনো কারণ নেই। ভয় করবেন শুধু আল্লাহকে। একই সঙ্গে নিজে যেটা ভালো মনে করবেন, সেটা নিজে করার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবেন।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ আগের আওয়ামী লীগ এক নয়; আজকের বাংলাদেশ এবং আগের বাংলাদেশ এক নয়। সুতরাং এই যে পরিবর্তন, এই পরিস্থিতিতে আসুন আমরা সবাই একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা এই দেশের উন্নয়নে কাজ করি। শিক্ষাব্যবস্থা এবং যে দিকটায় আমরা পিছিয়ে আছি, সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।’
শিক্ষিত মা-ই শিক্ষিত পরিবার উপহার দিতে পারে : সালমান এফ রহমান
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারলেও লিখিত বক্তব্য পাঠান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি। লিখিত বক্তব্যে তিনি নিজেকে দ্বীনি শিক্ষার একজন সহযোগী উল্লেখ করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার মাদরাসা শিক্ষার জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, অতীতে আর এমন নজির দেখিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড গঠন করেছিলেন, তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকারের আন্তরিকতা ও কর্মপ্রয়াসের কোনো ঘাটতি নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমি আপনাদের সকল দাবি-দাওয়া ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি যা করণীয় তা আন্তরিকভাবে পালন করব।’
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘দেশের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা অত্যন্ত অপরিহার্য। মাদরাসা শিক্ষা, দ্বীনি ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে একটি দক্ষ ও সৎ প্রজন্ম তৈরিতে অবদান রেখে চলছে। দেশের প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থী আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া করে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী। যে ৩৫ লাখ মেয়ে মাদরাসায় পড়াশোনা করছে, ভবিষ্যতে তারা অন্যান্য পেশা ছাড়াও প্রতিটি ঘরকে একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। কেননা, মা তার সন্তানের প্রথম শিক্ষক। একজন শিক্ষিত মা, একটি শিক্ষিত পরিবার উপহার দিতে পারে। মাদরাসা শিক্ষার সাথে কোটি কোটি অভিভাবক জড়িত। দেশের বড় বড় মাদরাসা জনগণের ধর্মীয় দিকনির্দেশনায় বিরাট ভ‚মিকা রাখে। সমাজ গঠন ও জনকল্যাণে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ বিষয়টি সরকারের চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে বলেই সরকার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে সুস্পষ্ট ভ‚মিকা রাখছে। আগামী দিনেও প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার বিষয়ে পূর্ণ সজাগ ও আন্তরিক দৃষ্টি রাখবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর নিয়মিত কাজ করে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা হিসেবে আমিও প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাদের পাশে থাকব।’
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের পাশে থাকব -শেখ মো. আব্দুল্লাহ
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আলহাজ অ্যাড. শেখ মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিএনপির শাসনামলেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের সৃষ্টি হয়েছিল। চার দলীয় বিএনপি জামায়াত-শিবিরই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের অর্থ যোগান দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করে না।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নয়; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলেম-ওলামাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই দেশকে এগিয়ে নিতে চান। আওয়ামী লীগ ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মধ্যে এমন সুসম্পর্ক চাই যাতে উভয়ের মাঝে আর ভাটার টান না পড়ে। নিয়ত সহি থাকলে দ্বীনের মহব্বতে সোহরাওয়ার্দী ময়দানের জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উদ্যোগে আয়োজিত শুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেবেন বলেও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।’ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একজন ভাই হিসেবে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের পাশে থাকার প্রতিশ্রæতি দিচ্ছি। মোদার্রেছীনের গঠনমূলক নেতৃত্বে মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। আমি দেশের ১০টি শ্রেষ্ঠ আলিয়া মাদরাসা ও ১০টি শ্রেষ্ঠ কওমি মাদরাসা শিগগিরই পরিদর্শনে যাবো’ উল্লেখ করেন তিনি।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুধু মুসলমানদেরই ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নই; সকল ধর্মাবলম্বীদেরও আমি মন্ত্রী। আলেম-ওলাগণের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়েই আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করব ইনশাআল্লাহ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়ে এবার একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা উপহার দিতে চাই। আমি দুর্নীতি করব না আর কাউকে দুর্নীতি করতেও দেবো না। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) সন্তুষ্টির জন্যই সকল কাজ করতে চাই। আল্লাহর মেহমান হজযাত্রীদের আর চোখের পানি দেখতে চাই না। হজযাত্রীদের চোখে পানি ঝরলে দায়ী ব্যক্তিদের চোখ দিয়ে রক্ত বের করে ছাড়ব।’
আলেম সমাজই জনমত গঠনের কারিগর -এ এম এম বাহাউদ্দীন
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়; বরং বাংলাদেশে প্রকৃত জনমত মসজিদ থেকে আলেমদের মাধ্যমে গঠন হয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন। সভাপতির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের জনমত তৈরি হয় না। প্রকৃত জনমত হয় মসজিদে। আলেম সমাজ এই জনমত গঠনের বড় কারিগর। বাংলাদেশের আট কোটি লোক সপ্তাহে একদিন অন্তত এক ঘণ্টা মসজিদে থাকেন। আট কোটি লোক পাঁচ মিনিটের জন্য একবার সেজদাহরত হন। বছরে দুই লাখের ঊর্ধ্বে বড় বড় মাহফিল হয়। এসব একেকটি মাহফিলে হাজার থেকে লাখ লাখ লোক হয়। সেখানেই তারা জনমত তৈরি করেন।
প্রধানমন্ত্রী যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সেটি তৈরিতে আলেম সমাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে মন্তব্য করে সংগঠনটির সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, জাতীয় ঐক্য করার জন্য রেডিমেট ফোর্স দরকার। জমিয়াতের নেতৃত্বে রেডিমেট ফোর্স অর্থমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর পেছনে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী যেটা চাচ্ছেন- মাদকমুক্ত, অপরাধমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে, আপনারা (অর্থমন্ত্রী-ধর্ম প্রতিমন্ত্রী) এই ফোর্সকে সে ক্ষেত্রে পাশে পাবেন। কারণ সারাদেশের আলেম সমাজ সম্মিলিতভাবে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সাথে আছে। দরবারের পীর সাহেব, মসজিদের ইমাম, খতিব, শিক্ষক, কর্মচারী নানাবিধভাবে জমিয়াতের সাথে আছেন। আর জমিয়াতুল মোদার্রেছীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে আছে। প্রধানমন্ত্রী যে সমাজ দেখতে চান, আমরা সকলে মিলে তাকে সহযোগিতা করব।
দুদক, পুলিশ-র্যাব দিয়ে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে না মন্তব্য করে জমিয়াত সভাপতি বলেন, যত উন্নয়ন করেন দুর্নীতি দূর করতে না পারলে কোনো কাজে আসবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিয়ে দুর্নীতি দূর হবে না। দুদক দুর্নীতি বাড়াচ্ছে, আরো বাড়াবে। পুলিশ-র্যাব দিয়ে গ্রেফতার করেও দুর্নীতি দূর করতে পারবেন না। এটা করতে পারে দেশের আলেম সমাজ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে মানুষের গরু-ছাগল, শস্য ক্ষেতসহ অন্যান্য সম্পদ এমনি খোলামেলা পড়ে থাকে। সারাদেশের মাহফিলগুলোতে যে বয়ান হয়, সেখানে বলা হয় চুরি করা মহাপাপ, এই ছোট্ট কথাতেই মানুষ খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। আর শহরে অনেক নিরাপত্তা প্রহরী, ক্যামেরা লাগিয়েও চুরি-ডাকাতি ঠেকানো যায় না। কারণ আমাদের (শহরে) আশেপাশে বার-ক্লাব ভর্তি। এগুলোতে নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাব কম। তাই ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী আদর্শের প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে কাজে লাগাতে হবে।
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরে মাদরাসা শিক্ষকদের এই নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত বলেন, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কারণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তার হাতে একটি পুস্তিকা তুলে দিয়েছিলাম। তিনি এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। এটা প্রতিষ্ঠা করার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি যুক্তিগুলো তুলে ধরেন। কোনো কিছু না বুঝে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এটা (আরবি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ভবিষ্যত সমাজ গঠন করার জন্য, একটা সোসাইটি করার জন্য এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রীর ভ‚য়সী প্রশংসা করে ইনকিলাব সম্পাদক বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার একজন অর্থমন্ত্রী হলেন, যিনি মনে করেন- উন্নয়ন করতে হবে মানুষের জন্য। কারণ স্ট্রাকচার চিরস্থায়ী না। স্ট্রাকচার থাকবে না। স্ট্রাকচার আজকে আছে, কালকে থাকবে না। কিন্তু স্ট্রাকচারের পেছনে মানুষগুলো (আদর্শিকভাবে, নীতিবান) যদি তৈরি করে দেয়া যায়, তাহলে দেশ ও জাতি দীর্ঘ দিন উপকৃত হবে। আর সেই চিন্তাই সার্বক্ষণিক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।’
বঙ্গবন্ধু মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন : বি এইচ হারুন
বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সংবর্ধনার জবাবে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ বজলুল হক হারুন এমপি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইসলামী শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরবর্তীতে তার কন্যা শেখ হাসিনা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু এটুকুই নয়, তিনি মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্যও দূর করেছেন। আরো যেসব দাবি-দাওয়া রয়েছে; সেগুলোও পূরণ হবে।’
নির্বাচনের আগে সারাদেশে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নৌকার পক্ষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝালকাঠিতে জমিয়াতের মহাসচিব সকল মাদরাসা শিক্ষকদের ডেকে বলেছিলেন নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য। আমি জানি সারাদেশেও একইভাবে জমিয়াতের নেতৃবৃন্দকে কাজ করতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।’ বজলুল হক হারুন আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জমিয়াত নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শুকরিয়া সমাবেশ করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আমি আশা করি, প্রধানমন্ত্রী তাদের সময় দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তিনটি দাবি : অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী
অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাদরাসা শিক্ষার অসংখ্য দাবি-দাওয়া পূরণ হয়েছে। অনেক দাবি আমরা জানিয়েছি, সেগুলো সরকার পূরণ করেছে। আবার অনেক দাবি আমরা জানানোর আগেই প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছায় পূরণ করা হয়েছে। এখনো আমাদের ছোটখাট কিছু দাবি রয়েছে। যেগুলো সরকারের আর্থিক কোনো বিষয় নয়, শুধু সদিচ্ছার প্রয়োজন। আমরা আশা করি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী সেগুলো বিবেচনায় নেবেন।’ এসময় তিনি তিনটি দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে- ‘সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করা, চাকরির বয়স বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো ইবতেদায়ি স্তরেও সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা।’
সারাদেশ থেকে আসা আলেম-ওলামা, মাদরাসা প্রধান, ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ কে এম ছায়েফ উল্লাহ, হাবের মহাসচিব এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম, জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহ-সভাপতি কবি মাওলানা রুহুল আমিন খান, সহ-সভাপতি মাওলানা নেছার আহমদ ওয়ালিহী, উপাধ্যক্ষ মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান, মাওলানা মোকাদ্দেসুল ইসলাম, ড. মাওলানা ইদ্রীস খান, মাওলানা হোসাইন আহমদ ভূঁইয়া, প্রফেসর সাহাদত উল্লাহ, মাওলানা জহিরুল হক, মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, অধ্যক্ষ মাওলানা জাফর সাদেক, অধ্যাপক মাওলানা আনসার উল্লাহ, অধ্যাপক মাওলানা আবুল ফরাহ মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন, অধ্যাপক মাওলানা সৈয়দ মনিরুল্লাহ আহমদী, মাওলানা কাজী আবুল বয়ান হাসেমী, মাওলানা আবু ইউসুফ, উপাধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, উপাধ্যক্ষ মাওলানা মাহবুবুর রহমান (ঝালকাঠি), অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রউফ, অধ্যক্ষ মাওলানা কামেল কাউছার, মাওলানা হারুন অর রশিদ, মাওলানা এ কে এম মনোয়ার আলী, মাওলানা নোমান আহমদ প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।