পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুর্নীতি কালো ব্যাধির মত ছেয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের পর প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রী যথাস্থানে যথার্থভাবেই দেশের মূল সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবারো সরকার গঠনের পর তিনি দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, এটা খুবই ইতিবাচক বিষয়। তবে যেখানে নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট কারচুপির মধ্য দিয়ে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ এবং আস্থার সংকট রয়েছে সেখানে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান কতটা সফল হবে সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। ধারাবাহিক তৃতীয় মন্ত্রী পরিষদে আগের দুই বারের বেশিরভাগ মন্ত্রীকে রাখা হয়নি। যাদের প্রায় সবাই ডাকসাইটে আওয়ামীলীগ নেতা এবং সাবেক সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন, তাদেরকে বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনগণের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দিয়েছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। সেটা অবশ্যই দুর্নীতি বিরোধী অবস্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির অনেক অভিযোগ রয়েছে। পচা চাল-গম আমদানী, স্বাস্থ্যখাতে বেশ কিছু দুর্নীতির ঘটনা, মন্ত্রীদের পোষ্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ার কাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জাল-জালিয়াতির ঋণ কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ধস, শেয়ার বাজার লুণ্ঠন থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফ্ট কোড হ্যাক করে শত শত মিলিয়ন ডলার চুরি হওয়ার ঘটনা সাথে জড়িত ও দায়ী ব্যক্তিরা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। মন্ত্রী সভায় রদবদলের পর দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি ও রির্জাভ চুরির মত ঘটনাগুলোতে সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য সেক্টরেও যে সব দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সেখানেও মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়া, প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা এবং বর্তমান সংসদের অনেক সদস্যের নাম সঙ্গত কারণেই উঠে আসতে পারে। তবে ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোন, রাষ্ট্রব্যবস্থা ঠিক থাকলে আইনের হাত ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দলীয় শক্তির চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। অবশ্য মাঝে মধ্যে সংবাদে-নিবন্ধে বা কেতাবে এ বাক্যটির দেখা মিললেও বাংলাদেশের মানুষ কখনো বাস্তবে এর উদাহরণ দেখতে পায়নি। বিশ্বের বহুদেশে এমন অনেক উদাহরণ আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বিরোধীদল ও জোটের নেতাদেরকে যেভাবে নানা অভিযোগে গ্রেফতার করে বিচারাদালতের মাধ্যমে রায় ও সাজা দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটাও একসময় নজিরবিহীন ছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যেসব অভিযোগে গ্রেফতার ও সাজা দেয়া হয়েছে তা’ সাধারণ মানুষের কাছে দেশের আইনের শাসন সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়ক হয়নি। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুনীর্তির দৃশ্যমান অভিযোগে কোনো মামলাই হয় না, পাবলিক পারসেপসন বা তদন্ত রিপোর্টে দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার বা বিচারের আওতায় আনা হয়নি, সেখানে বেসরকারি ট্রাস্টের দু’তিন কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে সত্তরোর্ধ বয়েসী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দিয়ে পরিত্যক্ত কারাগারে আবদ্ধ রাখার ঘটনা কতটা দুর্নীতি বিরোধী আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা জনসাধারণ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গত সরকারের দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমের রাজনৈতিক টার্গেট হিসেবে প্রধান বিরোধীদলের নেতাদের আইনের আওতায় এনে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অসম ও নড়বড়ে করে দিয়েছে। যা শেষ পর্যন্ত একটি অসমতল নির্বাচনী মাঠ, অস্বচ্ছ, একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বিরোধীদলের রাঘব বোয়ালদের ধরার পাশাপাশি সরকারের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি ও আমলাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের লক্ষ্য ও আইনের শাসনের মূল শর্ত। জর্জ অরওয়েল তার এনিমেল ফার্ম উপন্যাসে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ন্যায়বিচারকে ক্ষমতা দিয়ে অসম করে তোলার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। এনিমেল ফার্মের একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি হচ্ছে, ‘অল এনিমেলস আর ইকোয়্যাল, সাম এনিমেলস আর মোর ইকোয়্যাল দ্যান আদার্স’। মোর ইকুয়েলের ক্যাটাগরিক্যাল ধারণা থেকেই সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ন্যায় বিচার, সুশাসন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই আধুনিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ১৯৭২ সালে গৃহীত আমাদের জাতীয় সংবিধানের মূল লক্ষ্যই ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেন তেন প্রকারে দেশের মানুষের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলার মধ্য দিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। বৈষম্য যত বাড়ছে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ততই যেন দূরে সরে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের সাথে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রস্তাবনার কোনো বিরোধ নেই। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি অর্জনের কোনো সারবত্তা নেই। যারা কম গণতন্ত্র ও বেশী উন্নয়নের কথা বলেন তাঁদের মনোভঙ্গিতে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র ব্যক্তি ও দলনিরপেক্ষ সুসমন্বিত ব্যবস্থার নাম। উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও সমন্বয় না থাকলে ভঙ্গুর উন্নয়ন তৎপরতাকে ব্যক্তি ও দল তাদের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করার পাশাপাশি এটাও দাবি করে থাকে যে ওরা ক্ষমতায় না থাকলে উন্নয়নের যাত্রা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ক্ষমতাসীনদের এই ধারণা এবং প্রচারণা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের নাগরিক সত্ত¡া, মানবিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান ও কাঙ্খিত বলে মনে করে। এ কারণে জেনারেল আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশকের প্রচারণা এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনাকে ভোলাতে পারেনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূলত: বৈষম্যহীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু রেখে এই অঙ্গীকার বা লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঘোষিত লড়াইয়ে জয়ী হতে হলে প্রথমেই সহাবস্থানমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দূর করার সাথে সাথে অনিশ্চয়তা ও জনগণের অনাস্থা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমেই সরকারিদলের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলোকে উপযুক্ত আইনগত প্রক্রিয়ায় নিস্পত্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সোমবার দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের আদালতগুলোতে এই মুহূর্তে ৩৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলা নিস্পত্তি হওয়ার যে গতি, তার চেয়ে নতুন মামলা দায়েরের হার অনেক বেশি হওয়ায় চলমান প্রক্রিয়ায় শত বছরেও মামলা জট কমবে না। বিচার প্রক্রিয়াকে গতিশীল, স্বচ্ছ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ও ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে প্রথমেই বিচার সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে, উচ্চ আদালতের বেঞ্চ বাড়িয়ে, আদালতে বিকেন্দ্রিকরণ ঘটিয়ে এবং নি¤œ স্তরে বিকল্প সালিশ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে মামলা জট কমিয়ে আনা হয়তো সম্ভব। মামলা জট কমিয়ে আনার সাথে মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার ও সম্ভাবনার সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। প্রথমত: মামলাবাজির পরিবেশ দূর করা, দ্বিতীয়ত: বিচারিক কার্যক্রমকে স্বচ্ছ, গতিশীল ও ন্যায়বিচারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দুর্নীতি বিরোধী অবস্থানের ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব অঙ্গীকারের কথা বলেছেন, মন্ত্রীপরিষদ থেকে পুরনো অভিজ্ঞ, প্রভাবশালী ও সম্ভাব্য দুর্নীতিবাজদের বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে তার একটি ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বটে, তবে দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা দুর্নীতির বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন বর্তমান বাস্তবতায় হয়তো সম্ভব নয়। সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের খন্ডিত, লোক দেখানো বা পক্ষপাতদুষ্ট তৎপরতা সমাজের অন্য একটি অংশকে আরো বেপরোয়া দুর্নীতিপ্রবণ করে তুলতে পারে। রাজনৈতিক কারণে এমনটা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে নির্বাচনে দেশের জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকারের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জনগণের আস্থাশীল সরকারই কেবল এ ধরনের চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে পারে। এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে না পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চতনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও লক্ষ্য বিচ্যুত ও অর্থহীন হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি কালো ব্যাধির মতো ছেয়ে গেছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা এই উপলব্ধির বাস্তব প্রতিফলন আগামী দিনগুলোতে সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ডে পড়লে তবেই তা দিন বদলের সূচনা ঘটাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছার উপর অনেক কিছু নির্ভর করলেও দুর্নীতি রোধ, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরো অনেক বেশি কিছু প্রয়োজন।
নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের একজন সিনিয়র কমিশনার বলেছিলেন, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধিদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেয়, তাদের দ্বারা নিরপেক্ষ ভ‚মিকা ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা, এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছেই। নির্বাচনের ফলাফল ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন যেখানেই ঘুরপাক খাক না কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেই দেশের আইনের শাসনের নিশ্চয়তার প্রতিফলন পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। অনেক দিন আগে শুরু হওয়া সামাজিক অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক সন্ত্রাস, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও মাদকের আগ্রাসনের ভয়াল মূর্তি নির্বাচনের পর আরো ভয়ঙ্কর রূপে আবির্র্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে। গত তিন সপ্তাহের অপরাধ চিত্রে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো আমলে নিলে এই ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননী পারুল বেগম ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাটি সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সে ঘটনায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মানুষের প্রত্যাশা ছিল দ্রæততম সময়ে এসব নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কিন্তু না, এরপর থেকে একের পর এক পৈশাচিক খুন, ধর্ষণ ও শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনার বেশ কয়েকটির সাথে সরকারি দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে এসেছে। একইভাবে নোয়াখালীর কবিরহাটে তিন সন্তানের জননী আরেক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী জাকির হোসেন জহিরসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে মামলায় অভিযুক্ত ৭ জনের মধ্যে ৩ জনকে মামলার এজাহার থেকে বাদ দেয়া এবং ধর্ষিতা নারীর নিকটাত্মীয় কয়েকজনকে গ্রেফতার করে মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগীরা। সুবর্ণচরের ঘটনায়ও পুলিশের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ উঠেছিল। জাতীয় নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনাগুলোর সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ সরকারি জোটের বাইরের প্রায় সব রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের পর থেকে দেশে একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এখন আর অপরাধ ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের দলবাজ ভ‚মিকার কারণে মামলা ও বিচার প্রক্রিয়ায় এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। গুরুতর অপরাধে পুলিশের এজাহার ও সাক্ষি গ্রহণে দুর্বলতার কারণে মামলা থেকে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অথবা আইনগত ফাঁক-ফোঁকড় গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে গিয়ে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলেও সীমান্ত পথে মাদকের চোরাচালান বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। মাদকের গডফাদার, রাঘব বোয়ালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে, সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ায় মাদকের করাল গ্রাস থেকে সমাজকে রক্ষা করা অনেক দুরূহ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে গত এক দশকে দেশের অপরাধীরা লাখ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যায়। জাতীয় নির্বাচনের আগে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার একটি রেওয়াজ দেশে চালু থাকলেও এবারের নির্বাচনের আগে তেমন কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। গত বছরের মাঝামাঝিতে দেশে মাদক বিরোধী অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার কথা বলা হয়েছিল। নির্বাচন এবং রাজনীতিতে বিরোধীদলকে দাঁড়াতেই দেয়া হয়নি। সবকিছুৃই একতরফা হচ্ছে। বিরুদ্ধে তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় তারা প্রায় নিষ্ক্রীয় বিরোধী পক্ষের উপর জুলুম নির্যাতন ও দখলবাজির সাথে সাথে সরকারিদলের নেতাকর্মীরা নিজ দলে আধিপত্য বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরোধী নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ সদস্য, দলবাজ প্রশাসন এবং সরকারিদলের যেসব স্থানীয় নেতাকর্মীরা মাদক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ বেপরোয়া অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে তাদেরকে নিবৃত্ত করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সরকার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিরোধী চ্যালেঞ্জের ব্যর্থতা সমাজকে আরো বেশি অবক্ষয় ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।