পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিক্ষা হল এমন একটি শব্দ যার দ্বারা একটি শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়। শিক্ষা হল এমন একটি হাতিয়ার যা শিশুকে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে অভিযোজিত করতে সাহায্য করে। শিক্ষা কিন্তু শিশুর উপর আরোপিত অথবা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিষয়বস্তু নয়। শিক্ষা হল এমন একটি উপকরণ যার দ্বারা শিশুর অন্তরের সুপ্ত যে ভবিষ্যৎ উন্নয়নমুখী উপাদান তার বিকাশ সাধিত হয়।
আমরা লক্ষ করলে দেখব যে, পৃথিবী আবির্ভাবের পর থেকেই শিক্ষা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রতিটি ব্যক্তির সাথে জড়িত। আর আমার আলোচ্য বিষয়টিও বিভিন্ন যুগে শিক্ষার যে মাহাত্ম্য তার উপরই ভিত্তি করে আলোচিত। আদিমযুগে শিক্ষা ছিল অনিয়মতান্ত্রিক। অর্থাৎ তখন মানুষ প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহের সময় যা কিছু জ্ঞান লাভ করত তাই শিক্ষা রূপে গণ্য হত। তখন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথেই ছিল শিক্ষার হাতছানি। মানুষ তার জীবনের কর্মোপলব্ধির দ্বারাই শিক্ষা লাভ করত তাই শিক্ষারূপে গণ্য হত। তখন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথেই ছিল শিক্ষার হাতছানি। মানুষ তার জীবনের কর্মোপলব্ধির দ্বারাই শিক্ষা লাভ করত।
এছাড়াও মুসলিম যুগ, ব্রিটিশ যুগেও শিক্ষা ছিল জীবন উপযোগী অথবা উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের উপযুক্ত হাতিয়ার। বিভিন্ন যুগে এই শিক্ষার মাহাত্ম্য নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, মনোবিদ এবং মহাপুরুষরা আলোচনা করে গেছেন। আর প্রত্যেকের মতেই শিক্ষা হল এমন এক সত্তা যা আমাদের জীবন নির্বাহের পরিপূরক হিসাবে বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। যেহেতু আজকের আলোচনার বিষয়ই হল শিক্ষা, তাই এর বুৎপত্তিগত অর্থও জানা দরকার। শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শাস্ ধাতু থেকে যার অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, আবার শিক্ষার সমার্থক শব্দ বিদ্যা এসেছে বিদ্ ধাতু থেকে যার অর্থ জানা বা জ্ঞান আহরণ করা। শিক্ষার সঙ্কীর্ণ অর্থ হল জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন, যা প্রথাগত শিক্ষার দ্বারা সংগঠিত হয়। অপরদিকে শিক্ষার ব্যাপক অর্থ হল শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক অর্থাৎ সকল রকম সম্ভাবনার বিকাশ সাধন করা। বিভিন্ন আঙ্গিকে শিক্ষার অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শিক্ষার দ্বারা শিশু জ্ঞান অর্জন করে। আর এই জ্ঞানই পরবর্তীতে উন্নত জীবনযাপনে সহায়ক হয়। কিন্তু শিক্ষার সঠিক মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে হলে শিক্ষা শব্দের যথার্থতা সঠিকভাবে অনুধাবন প্রয়োজন।
কিন্তু বর্তমানে মানুষের সুস্থ মানসিকতার অভাবের ফলে শিক্ষা তার মূল রূপ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ শিক্ষা আত্মোপলব্ধির উপকরণ না-থেকে, বর্তমানে একটি যান্ত্রিক উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার মূল আদর্শই আজ অপসারিত হচ্ছে। শিক্ষা শুধু পুঁথিগত জ্ঞানার্জন করাই নয় এবং শিক্ষান্তে জীবিকার্জন করাই নয়। শিক্ষা একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষা একটি শিশুকে সঠিক জ্ঞান সঞ্চারের দ্বারা প্রকৃত মানব সম্পদে পরিণত করবে। বিভিন্ন যুগে মহাপুরুষগণ নানাভাবে শিক্ষার দ্বারা মানুষের উন্নত মানসিকতা প্রতিস্থাপনের দ্বারা জীবন গঠনের বিভিন্ন উপায় নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু মানুষের আত্ম-অহঙ্কার, মনুষ্যত্ববোধের অপসারণ শিক্ষার মূল যে কাঠামো তার পরিবর্তনের প্রয়াস চালিয়েছে।
শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে এক অন্যরূপে বর্তমানে আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলে-মেয়েদের ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাকে বহির্দেশে প্রেরণ করা। বতর্মান প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজি শিক্ষা আবশ্যকীয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষাদানের কথা ভুলেই যাব। মাতৃভাষার দ্বারা শিশুদের সঠিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুনতে খুব অবাক লাগে যখন অভিভাবকরা গর্ব করে বলে থাকেন আমার ছেলেটা/মেয়েটা একেবারেই বাংলা পড়তে পারে না। শিক্ষা মানেই কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে বহির্দেশে প্রেরণ করা নয়। শিক্ষা হল শিশুদের উন্নত মানসিকতা দানের মাধ্যম। আর শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা জন্মের মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে পারে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন সুস্থ দেহে সুস্থ মনের সৃষ্টিই হল শিক্ষা।
বর্তমানে শিক্ষার সঠিক মূল্য হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষিত অভিভাবকমহল তাদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে যন্ত্রমানবে পরিণত করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটি সৎ, সাহসী, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত হচ্ছে না যা আমাদের কাছে বেশ হতাশাজনক। শিক্ষার মূল যে লক্ষ্য শিশুর আত্মপোলব্ধি, সুপ্ত সত্তার বিকাশ এসব বর্তমানে সঠিকভাবে ফলপ্রসূ হয় না। কিন্তু রুশো বলেছেন শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ যা মানবসমাজের সমস্ত কৃত্রিমতাবর্জিত একটি স্বাভাবিক মানুষ তৈরিতে সহায়ক।’ আমার সকল অভিভাবকদের কাছে প্রশ্ন, কেন তাঁরা সবাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত নৈতিক আদর্শের প্রতীক করে তুলতে সক্ষম নন? নিশ্চয়ই আমরাও বর্তমান বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে সঠিক লক্ষ্য থেকে অপসারিত হচ্ছি যার ভবিষ্যৎ পরিণাম অন্ধকারময়।
আমার সকল অভিভাবকদের কাছে প্রশ্ন, সবাই যদি উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এ দেশ ত্যাগ করে, তবে আমাদের জন্মভূমির উন্নতির জন্য কে অগ্রসর হবে? প্রতিবছরই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক-এ উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সাক্ষাৎকারে বলে থাকেন ‘আমরা আমাদের দেশের জন্য কাজ করতে চাই।’ কিন্তু আমার সকল সাংবাদিকের কাছে অনুরোধ রইল আপনারা দয়া করে পুনরায় ওদের সাক্ষাৎকার নেবেন ক’জন তাদের দেওয়া কথা রেখেছে। আসলে আবেগের বশবর্তী হয়ে আমরা সকলেই অনেক কথা বলি, কিন্তু আমরা সময় এলে সত্যকে মুখোমুখি করতে ভয় পাই। তখন সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। এখানেই আমাদের দুর্বলতা।
বর্তমানে আমরা প্রায়শই লক্ষ করি যে, অনেক মাস্টার্স ডিগ্রি প্রাপ্ত ছেলেমেয়ে বহির্দেশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজ রাজ্যে এসে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগদান করছে। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের ভাবনাটা সর্বদাই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তাই এক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষকে মানুষ ভরসা জোগানোর জন্য উন্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যকীয়। বর্তমানে প্রকৃত শিক্ষার আগে মূল্য পায় অর্থ। কিন্তু সঠিক অর্থোপলব্ধির জন্য প্রকৃত শিক্ষার হাতছানি প্রয়োজন। কিন্তু আমরা নাগরিকরা যে-কোনোভাবেই প্রকৃত সত্যটা অনুধাবন করেও এগিয়ে আসতে ভয় পাই। যদি শিক্ষাকে এখন থেকেই সৎ প্রচারের উদ্দেশ্যে কার্যকর করা না হয় তবে এমন ভবিষ্যতের সম্মুখীন হব যখন মানুষের কাছে শিক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়বে। শিক্ষা প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে চায়, শিক্ষা এর সার্থকতার পেছনে যথেষ্টই প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে।
আমার সকল অভিভাকদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন ছেলেমেয়েদের প্রকৃত শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেন। যে শিক্ষার দ্বারা শিশুটির সম্ভাবনা প্রকাশের পাশাপাশি উন্নত চরিত্র গঠিত হবে। বর্তমানে আমরা প্রায়শই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছেলেমেয়েদের দ্বারা কৃত বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকি। এমনকি ছেলেমেয়েরা অর্থের বিনিময়ে সামগ্রী বিপণনের বিজ্ঞাপনও করছে, অভিভাবকদের সরলতা এবং অসতর্কতার সুযোগে। প্রারম্ভিককালে শিক্ষা মানুষের উন্নত জীবনযাপনের সহায়ক উপাদান হিসাবে মান্য করা হত। কিন্তু বর্তমানে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে প্রকৃত শিক্ষার অর্থ লুপ্তপ্রায়।
আমার আরেকটা জিনিষ ভাবতে খুব অবাক লাগে যে, শিক্ষার মতো একটি পবিত্র উপাদানের মধ্যে বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ঢুকে পড়েছে রাজনীতির কুপ্রভাব। আমরা জানি আজকের ছাত্ররাই ভবিষ্যৎ নাগরিক। উন্নত সমাজ গঠনের মানদন্ড। আর এর জন্য রাজনীতি আবশ্যক। রাজনীতিই তাদের নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক করে। কিন্তু বর্তমানে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতির নামে চলছে হানাহানি, দ্বন্দ্ব, খুন, খারাবি। রাজনীতির বেড়াজালে আকৃষ্ট হবার ফলে ছেলেমেয়েদের জ্ঞানপিপাসা লুপ্ত হয়ে বিরাজ করছে হানাহানি।
আমরা যদি প্রাচীন যুগের শিক্ষাকে লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, শিক্ষা এমন একটি উপকরণ যা মানুষকে জীবনের সাথে সাযুজ্য স্থাপনের মাধ্যমে আয়োজিত করত। শিক্ষার মূল বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে এর প্রতিধ্বনি প্রতিফলিত হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের নাগরিকরা বিভিন্ন অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আকৃষ্ট হয়ে পড়ায় সুস্থ সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছে। যার ফলে শিক্ষার সঠিক প্রতিধ্বনি সকলের মধ্যে প্রেরিত হচ্ছে না। শিক্ষা কিন্তু শিশুকে ভেদাভেদ শেখায় না। প্রকৃত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অহিংসা থেকে মুক্ত করে সুস্থ মানসিকতার অধিকারী করবে, তাকে সমাজের সুনাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।