পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নির্বাচন এলে কে কত পোস্টার লাগাতে পারে রীতিমত তার প্রতিযোগিতা চলে। তাতে কোটি কোটি টাকার অপচয় ঘটে। কেউ তা নিয়ে ভাবে না। পোস্টার লাগিয়ে রাখা গেলে না হয় পোস্টার লাগাক। কিন্তু লাগিয়ে যদি তুলে ফেলতে হয় তাহলে অর্থের অপচয় আর দেয়ালের সৌন্দর্য্যহানি ঘটিয়ে ফায়দাটা কী? লাগানোর সময় বাধা দেয় না নির্বাচন কমিশন; তুলতে সময় বেঁধে দেয় ঠিকই। বিষয়টা কি এমন, লাগানোর সময় তা বৈধ, আর লাগানোর পর অবৈধ?
পোস্টার, ব্যানারে সৌন্দর্য্য দেখে কি কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়? পোস্টার-ফেস্টুনে ভোট হয় না। কদিন আগে সড়ক ও সেতু মন্ত্রী নেতাকর্মীদের এ কথা বলেছেন। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ আর মাদক ব্যবসায়ী মন্ত্রী-এমপির ছবিসহ পোস্টার তৈরি করে নিজেকে জনদরদী আর সাচ্ছা লোক প্রমাণের কসরৎ করে থাকেন। মানুষ এসব পোস্টার দেখে বিভ্রান্ত হয়। জনগণ ভালোমন্দ বিচার করতে পারে না। কাঁচা টাকার মালিক, অবৈধ সম্পদের মালিকরাই বেশি বড় বড় পোস্টার, ব্যানার ছাপিয়ে বড় নেতা বনতে চান। দলে এদের কি খুব প্রয়োজন? মন্ত্রী-এমপির সাথে ছবি থাকলে সে দলের ভাবমর্যাদা আর থাকে না। পোস্টার-ব্যানারে লেখা থাকে ওমুক মন্ত্রীর, ওমুক নেতার আস্থাভাজন। কখনো কখনো লেখা থাকে প্রিয় মানুষ, জনদরদী আবার লেখে সাদামনের, সৎ চরিত্রের মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ কথিত এ মানুষগুলোর বিরুদ্ধে আদালতে ধর্ষণ, খুন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে দু’ চারটা মামলা ঝুলে আছে। মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী, খুনি, ধর্ষক যদি পোস্টার ব্যানারে এসব লিখে পাড়া-মহল্লা ভরে ফেলে, তখন অবশিষ্ট কি আর থাকে? তাছাড়া যারা সাধারণ ভোটার তাঁরা এসব বাক্য প্রয়োগে বিভ্রান্ত হয়। তাদের কথায় পটে যায়। এসব চরিত্রের মানুষগুলো মিষ্টি মিষ্টি সব বিভ্রান্তমূলক কথা লিখে অযথা দলকে কুলষিত করছে। এদের রোধে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? দলের লোকজন দরকার, টাকাওয়ায়ালাদের দরকার তা যে যেভাবেই কামাই করে টাকাওয়ালা হয়েছে তাতে কিছু এসে যায় না। ওদের কি এতই দরকার দলগুলোর? গণতন্তের কমতি থাকলে, দলের নেতাগণ অসৎ হলে, সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ আর মাদক ব্যবসায়ী, খুনীরাতো চটকদার পোস্টার অ্যাঁটে মস্ত নেতা বনে যাবেনই!
যাই হোক পোস্টার লাগানোর সুযোগ দিচ্ছি, আবার তুলে ফেলার কথাও বলছি আমরা। অর্থ ব্যায় করে পোস্টার লাগানো হলো। আবার তুলে ফেলার দিন ধার্য্য করারর পর তা তুলে ফেলতে সবাই ব্যস্ত। প্রথমত পোস্টারের খরচ দেশের সম্পদ নষ্টের পর্যায়ে পড়ে। কাগজ, কালি, ছাপা মেশিন এর সবই ডলারে কিনতে হয়। দ্বিতীয়ত আমরা বাড়ি-ঘর আর অফিস আদালতের সৌন্দর্য্য বর্ধনে দেয়ালগুলোর রং করে পরিপাটি করে রাখি। সেই সুন্দর রং করা দেয়ালে আটা-ময়দার আঠা লেপটে পোস্টার লাগানো হয়। পোস্টারের উপর পোস্টার লাগানোর প্রতিযোগিতাও চলে। এখানে শুধু বিল্ডিংগুলোর সৌন্দর্য্যই নষ্ট হয় না। পরে রং করতে টাকাকড়ির প্রয়োজন হয়। দেয়ালগুলোর স্থায়িত্বও নষ্ট হয়। তৃতীয়ত, লাগানো পোস্টার তুলতে জনবলের অপচয় হয়। এখানে কোথাও লাভ দেখি না। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন আর যারা দেশ পরিচালনা করে তাঁরা কী ভাবে?
এমন ভাবনা আমাদের দেশে খুব কম হয়। সরকারি অর্থ অপচয় করে রাষ্ট্রের অনেকেই বিদেশ সফরে যান। দেশের জন্য তারা কী নিয়ে আসেন? তাঁদের অনেকে কিছু শিখেও আসেন না, শিখার জন্য কোনো উপদেশও দেন না। সর্বশেষ যখন মালয়েশিয়াতে গেলাম তখন সেখানকার জাতীয় নির্বাচন চলছে। তখন পোস্টার মিছিল আর মানুষের জটলা চোখে পড়েনি আমার। তারাতো দেয়ালে পোস্টার না অ্যাঁটেই দিব্বি নির্বাচন করছে। সেখানকার বাংলাদেশের হাই কমিশনের এক পদস্থ কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, ‘ওরা এসব ভাবে না। কোথাও নির্বাচন হলে বোঝাও যায় না সেখানে নির্বাচন হচ্ছে কি না। নির্বাচনের দিন যে যার মতো কাজ করছে আবার সময় মতো ভোটও দিয়ে আসছে।’ তাঁর কথার সত্যতা পেলাম ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে। তিনি বলছিলেন, আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে ভোট দিতে যাবেন। ড্রাইভার বাংলাদেশি দিনাজপুরে বাড়ি। আরও বললেন, আমাদের মতো জনগণের মধ্যে এখানে এতো হৈ চৈ নেই নির্বাচন নিয়ে। ভোট দেবার সময় হলে শুধু ভোট দিতে যায় মানুষ। তবে সঠিক লোককে ভোট দিতে মোটেও ভুল করে না তাঁরা। পোস্টার, ব্যানার দেখে, চটকদার কথায় আঁটকে, বিভ্রান্ত হয়ে কাউকে তারা ভোট দেয় না। ড্রাইভার ভাই আরও বললেন, ‘গোটা রাস্তায় খেয়াল করুন, পোস্টার নেই।’ তবে যতদূর জেনেছি নির্দিষ্ট জায়গায় তারা পোস্টার-ব্যানার লাগায়। প্রশ্ন হলো, মালয়েশিয়া ভাবে, আমরা কেন ভাবি না বিষয়টি নিয়ে। আমাদের নির্বাচন কমিশন বিষয়টি ভাবনায় আনুক।
কাগজের অপচয়ের কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমাদের কাগজ শিল্পের খুব একটা সুদিন যাচ্ছে না। আমরা যেসব পোস্টার দেয়ালে লাগাই তার বেশিভাগই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। মিথ্যা ঘোষণায় ও বিনা শুল্কে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অবাধে আমদানি হচ্ছে এসব কাগজ। এর পর সেসব কাগজ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটে। তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশের মুদ্রণ শিল্প ও শিক্ষার্থীদের হাতে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কাগজ আর ফরমালিন, দুটোই আমদানি হয় মিথ্যা ঘোষণায়।
কাগজশিল্প সোনালী গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুছ কথা প্রসঙ্গে বলেন, দেশে কাগজের মোট বাজারের পরিমাণ বছরে ছয় হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে কাগজশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭১টি কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারখানাগুলোর বছরে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ লাখ টন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের কাগজকলগুলো প্রায় ৩০টি দেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এর পরও বাজার ছেয়ে গেছে বিদেশি কাগজে। দেশের কাগজশিল্পের এমন স্বয়ংসম্পূর্ণতার সময়েও বিদেশি কাগজের অবাধ আমদানি কমছে না বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এর বড় অংশই আসছে মিথ্যা ঘোষণায়, অন্য পণ্যের নামে। আর মিথ্যা ঘোষণায় দেশে যে পরিমাণ কাগজ আসছে, তার চেয়ে বহু কম আসছে বৈধ পথে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশ থেকে বৈধভাবে কাগজ আমদানি হয়েছে ৯ কোটি ২৬ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে কাগজ আমদানিতে ব্যয় হয় ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কাগজ আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণটি উদ্বেগজনক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে চিঠি পাঠায়, তাতে দেশীয় শিল্প রক্ষার পাশাপাশি নিম্নমানের কাগজ কিনে ভোক্তারা যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য মিথ্যা ঘোষণায় আনা কোনো কাগজ যাতে শুল্ক বিভাগ খালাস না করে সে জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বোর্ডও শুল্ক স্টেশনগুলোতে নির্দেশ পাঠিয়েছে। তবুও জাল-জালিয়াতি করে কাগজ আসা কমছে না। ঢাকার কাগজের পাইকারি বাজারগুলোতে প্রকাশ্যেই এসব কাগজ বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে টিসিবির মাধ্যমে আমদানির পর সংশ্লিষ্টদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করার উদ্যোগ নিলেই অবৈধ আমদানি ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে হয়।
সাবেক জজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ বলেছিলেন- ‘যেকোনো নগর বা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নগর বা পৌর কর্তৃপক্ষের। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে দেয়ালে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির বক্তব্য-সংবলিত লেখা বা কোনো রূপ পোস্টার লাগানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং উভয় কাজই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। উন্নত দেশের নাগরিকরা তাদের নগর ও শহরকে পরিচ্ছন্ন বা সুন্দর রাখা নিজেদের কর্তব্য বিবেচনা করায় তারা আইনের বিধানের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিজেরাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে। আমাদের দেশে নাগরিকদের সৌন্দর্য্যবোধের অভাব ও অসচেতনতার কারণে লেখা ও পোস্টারবিহীন দেয়াল কদাচিৎ দেখা যায়। আর এ ধরনের দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর কারণে নগর ও শহরের দেয়ালগুলোর একদিকে সৌন্দর্য্যহানি ঘটে, অন্যদিকে পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন হয়। আমাদের দেশে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো ব্যাপকতা লাভ করে যখন জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন অত্যাসন্ন হয়। আমাদের বিভিন্ন সরকারি অফিস ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ির দেয়ালে প্রায়ই রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বক্তব্য-সংবলিত লিখন প্রত্যক্ষ করা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন পণ্যের ও ব্যক্তির প্রচারণামূলক পোস্টার দ্বারা বছরের অধিকাংশ সময় দেয়ালগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ আবৃত থাকতে দেখা যায়।’
আমরা কি এ বিষয়ে আইন করতে পারি না? আইন করলে সৌন্দর্য্য রক্ষা হবে, অর্থের অপচয় রোধ হবে, জনগণ বিভ্রান্তির হাত থেকে রেহাই পাবে। তা হলে পোস্টার-ব্যানার বিষয়ক কেন আইন করা হচ্ছে না? দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো আইন সম্ভবত আছে, থাকলেও তা বাস্তবায়ন নেই। যেকোনো ধরনের দেয়াল লিখন মোচন ও দেয়াল থেকে পোস্টার অপসারণ সরকারি সংস্থা বা বাড়ির মালিকের জন্য বাড়তি ব্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উন্নত বিশ্বে দেয়াল লিখনের প্রচলন নেই। তবে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোস্টার লাগানোর জন্য নির্ধারিত জায়গা রয়েছে এবং যেকোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে নির্ধারিত জায়গায় পোস্টার লাগাতে পারে। এ ব্যবস্থাটি নগর বা শহর কর্তৃপক্ষ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে নগর বা শহর কর্তৃপক্ষের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।