Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানব জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

এক

‘লাক্বদ কা-না লাকুম ফী রসূলিল্লা-হি উসওয়াতুন হাসানাতুল লিমান কা-না ইয়ারজুল্লা-হা ওয়াল ইয়াওমাল আ-খির ওয়া যাকারল্লা-হা কাছীর।’ সূরাতুল আহযাবের একটি বিখ্যাত আয়াত তিলাওয়াত করা হল, সূরা : ৩৩, আয়াত : ২১। এই আয়াতে আল্লাহ পাক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে, তিনি আল্লাহভীরুদের ‘উসওয়ায়ে হাসানা’ উত্তম আদর্শ। রাসূল এবং পয়গম্বর যিনি হন, তিনি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য আদর্শ নিয়ে আসেন এবং আদর্শ হয়ে আসেন। আল্লাহ পাক তাঁর হেদায়েত ও পথনির্দেশ পৌঁছাবার জন্য মানবজাতির মধ্য থেকে তাঁর কিছু বিশিষ্ট বান্দাকে নির্বাচন করেন এবং তাঁদের মাধ্যমে তাঁর পথনির্দেশ বান্দাদের কাছে প্রেরণ করেন। হযরত আদম আ. থেকে নবী ও রাসূলের এই ধারা আরম্ভ করেছেন এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। সূরাতুল বাকারায় আছে, হযরত আদম আ.-কে লক্ষ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, যখন তাঁকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়- ‘তোমরা পৃথিবীতে নেমে যাও, এরপর আমার পক্ষ থেকে যদি তোমাদের নিকট হেদায়েত ও পথনির্দেশ আসে তো যারা এই পথনির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না।’ (সূরা বাকারা (২) : ৩৮)। তো আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আ.-এর মাধ্যমে হেদায়েত পাঠানোর ধারা শুরু করেছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে সেই ধারাকে পূর্ণাঙ্গ ও সমাপ্ত করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের জীবনের শেষ দিকে বিদায় হজ্বের সময় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এই আয়াত নাযিল হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে সম্পূর্ণ করলাম। তোমাদের উপর আমার নিআমতকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়েদা (৫) : ৩)। এটা হল আদম আ. থেকে নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পথনির্দেশ প্রেরণের যে ধারার সূচনা হয়েছিল সেই ধারার সমাপ্তি। আল্লাহ তাআলা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। এখন কিয়ামত পর্যন্ত এই দ্বীনই অনুসরণীয়, সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয়। নবী ও রাসূলগণ নিছক ‘বার্তাবাহক’ ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন ওই আসমানী বার্তার বাস্তব নমুনাও। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের কাছে যে শিক্ষা ও বিধান পাঠিয়েছেন তাঁরা ছিলেন ঐ শিক্ষার বাস্তব নমুনা। আম্বিয়ায়ে কেরাম তাওহীদ-রিসালাত ও আখিরাতের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন আর এইসব বিষয়ের প্রতি তাঁদের ঈমানই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁরা আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দিয়েছেন আর তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে বড় আবেদ। তারা বান্দার হকের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন আর বান্দার হক কীভাবে আদায় করতে হয় তা তাদের কর্ম দ্বারা দেখিয়ে গেছেন। তারা উত্তম স্বভাব-চরিত্রের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন আর তারাই ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। এভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত শিক্ষা ও বিধানের তাঁরা ছিলেন বাস্তব নমুনা। কুরআন মাজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের গুণাবলী এবং তাঁদের দাওয়াতের যে ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে তা এই বাস্তবতার দলীল। কুরআনের সেই বৃত্তান্ত এক মধুর দৃষ্টান্ত। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাভী রাহ.-এর ভাষায় কুরআন যখন আম্বিয়ায়ে কেরামের গুণাবলী বয়ান করে তখন যেন মনভরে প্রিয়ের কাহিনী বর্ণনা করে। তো সূরাতুল আহযাবের এই বিখ্যাত আয়াতে ‘তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ্র রাসূলের মাঝে উত্তম আদর্শ’। এতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই মহান বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে। তিনি আল্লাহর বাণী ও বিধান মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আর তাঁর গোটা জীবন ও কর্ম ছিল তারই বাস্তব নমুনা। তাঁর অনুকরণের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করা সম্ভব। এরপর বলা হয়েছে, এই আদর্শ তাদের জন্য, অর্থাৎ এই আদর্শ দ্বারা তারাই উপকৃত হবে, যারা আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশা করে। আর শেষ দিবসকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। নবী-আদর্শ দ্বারা উপকৃত কারা হয় তিনি সবার ‘উসওয়া’ ও আদর্শ। কিন্তু বাস্তবে এই উসওয়া দ্বারা উপকৃত তারাই হবে, যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং আখেরাতকে ভয় করে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশা করে এবং আখেরাতে নাজাতের প্রত্যাশা করে। আর সে কারণে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। দেখুন, কুরআন মাজীদের ক্ষেত্রেও এই কথা। কুরআন নাযিল হয়েছে সকল মানুষের জন্য। কিন্তু কুরআন দ্বারা উপকৃত হয় তারাই, যাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে। সুরাতুল বাকারার শুরুতে কুরআনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে, ‘এই কিতাব মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত’। কুরআন যদিও নাযিল হয়েছে সকল মানুষের হেদায়েতের জন্য কিন্তু বাস্তবে এই কুরআনের মাধ্যমে তারাই হেদায়েত পাবে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে। হযরত শায়খুল হিন্দ রাহ. বলেছেন, এর কারণ হচ্ছে, যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে সেই তো আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দ তালাশ করবে আর তখন সে কুরআনে পেয়ে যাবে কোন্ কাজ আল্লাহর পছন্দ আর কোন্ কাজ অপছন্দ। অন্তরের খোদাভীতি ও আল্লাহর রেযামন্দির অন্বেষার কারণে সে কুরআনের বিধান মোতাবেক চলবে এবং দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ লাভ করবে। তো কুরআন যদিও নাযিল হয়েছে সকল মানুষের হেদায়েতের জন্য কিন্তু বাস্তবে তারাই কুরআন দ্বারা সুপথপ্রাপ্ত হবে, যাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে। তো কুরআন সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কেও একই কথা। কুরআন দ্বারা যেমন শুধু তারাই সুপথপ্রাপ্ত হয়, যারা আল্লাহকে ভয় করে তেমনি আল্লাহর রাসূলের উসওয়া দ্বারাও তারাই উপকৃত হয়, যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশা করে। এখান থেকে কয়েকটি বিষয় বের হয়ে আসে। প্রথম বিষয় হল, কুরআনের বাণী সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য, কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য, তেমনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত ও জীবনাদর্শ সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য, সীরাত থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে ঈমান ও তাকওয়া। আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখেরাতের প্রতি ঈমান, আল্লাহর ভয়, আখেরাতের ভয়। কুরআন মাজীদ যখন নাযিল হচ্ছিল তখন কিছু মানুষের অবস্থা এই ছিল যে, কুরআনের আয়াতসমূহ নাযিল হচ্ছে আর তাদের ঈমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুরআনের নতুন নতুন বাণী ও বিধান আসছে আর তাদের আনুগত্য বাড়ছে, ইলম ও হিকমতের নতুন নতুন দিগন্ত তাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একেকটি বাণী, একেকটি কর্ম, তাঁর পবিত্র জীবনের একেকটি অধ্যায় তাঁদের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে আর তাদের ঈমান বাড়ছে। এরা হচ্ছেন ঐ সকল সৌভাগ্যবান, যাঁদের আল্লাহ ঈমান দান করেছিলেন, ফলে ঈমানের আলোয় তাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক উন্মুক্ত ও আলোকিত ছিল। অন্যদিকে কিছু লোক এমনও ছিল, যখনই কুরআন মাজীদের কোনো আয়াত নাযিল হয়েছে তাদের কুফর বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো বাণী ও কর্ম সামনে এসেছে, তাদের কুফর বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই আয়াতকে তারা অস্বীকার করেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্মকে অবজ্ঞা করেছে, এভাবে তাদের কুফর উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এই দুই সম্প্রদায়ের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। কাজেই কিতাব ও সুন্নাহ থেকে উপকৃত হওয়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে, ঈমান ও তাকওয়া। ঈমান ও তাকওয়া থাকলে কুরআন তাকে পথ দেখাবে। সীরাত ও সুন্নাহ তাকে পথ দেখাবে। এজন্য ঈমান শিখতে হয়, অর্জন করতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম বলেছেন, ‘আমরা ঈমান শিখেছি। এরপর কুরআন শিখেছি। ফলে আমাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৬১)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আদর্শ

১৩ অক্টোবর, ২০২২
৮ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ