শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
একজন হুমায়ূন আহমেদ- বাংলা সাহিত্যজগতে আসা এক ধ্রুপদী জাদুকরের নাম। সে আসে ধীরে- আমাদের বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে কিন্ত‘ চলে যায় অনেকটা হঠাৎ করে। বাঙালির মননে ও চিন্তাশীলতার এক বিরাট অংশ জুড়ে তিনি স্বীয় কর্মদক্ষতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। বিশেষত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের হাসি-কান্না, দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম ও রাগ-অভিমানকে তিনি খুব সযত্মে ও সফলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যাপিত জীবনের প্রতিটি সাধারণ ঘটনাগুলোকে অত্যন্ত সুচারুতায় তাঁর সৃষ্ট বহুমাত্রিক চরিত্রের মাধ্যমে অসাধারণ ভাবে পাঠকের নিকট উপস্থাপন করতে পেরেছেন। মোহগ্রস্ত পাঠক সমাজ সেগুলোকে খুব সহজে লুপে নিয়েছে নিজেদের মাঝে। তার বর্ণিত কালজয়ী একেকটি চরিত্রে তারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছে। তৃষিত পাঠক সেসব চরিত্রে খুব সহজে হারিয়ে গেছে। এভাবে দিনরাত হুমায়ূন বন্দনায় পাঠক সমাজ নিমগ্ন থেকে তাঁর প্রায় সব সৃষ্টিকে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছেন। জননন্দিত হুমায়ূন আহমেদের পাঠকপ্রিয়তা সংগত কারণে আজো দিগন্ত বিস্তৃত। তিনি বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখকদের অন্যতম গণ্য করা হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর জনক। অন্য দিকে তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকহিনীর পথিকৃৎ। এ যুবরাজ জনপ্রিয় তার ভাষার সরলতায়, লেখাগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবের গভীরতায়, বিষয় বৈচিত্র্যে এবং অভূতপূর্ব সমাপ্তি টানার মাঝে। তিনি যেন কোনো এক দৈববলে হঠাৎ পাঠকের হৃদয়ের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন জাদুকরের ন্যায়। এমন কিছু তার লেখায় থাকে, যা পড়ে কোটি বাঙালির মনে হয়, আরে এ বুঝি তাদেরই জীবনের গল্প লিখেছেন! পাঠকের মনে এত গভীর অনুপ্রবেশ তার মতো আর কেউ পেরেছেন কিনা তা একদিন সময় বলে দেবে। কিš‘ তার মতো সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় পাঠক হৃদয় জিতে নেয়া বিশ্ব সাহিত্যে সত্যি বিরল। শুধু তাই নয়, অনেক অদ্ভুতুড়ে, পরাবাস্তব বা আধিভৌতিক ব্যাখ্যাতীত ব্যাপারগুলো তিনি পাঠক সমাজকে খুব সহজে বিশ্বাস করিয়ে দিতে পারতেন। বাংলা কথাসাহিত্যকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হুুুমায়ূন আহমেদ যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। সঙ্গতকারণে বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও পঠিত নন্দিত লেখক, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার এবং নাট্যকার-নির্মাতা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ। এ কিংবদন্তির ৭০তম জন্মদিন পুরো দেশব্যাপী পালিত হয়েছে গত ১৩ নভেম্বর। ১৯৪৮ সালের এই দিনে নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে তাকে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে থাকতে হয়েছে। এ কারণে তাকে স্কুল ও কলেজও পাল্টাতে হয়েছে ঘন ঘন। তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর পলিমার কেমিস্ট্রির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগে শিক্ষকতায়। দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত থাকার পর তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোমাত্রায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তার সাহিত্যিক জীবনে অসংখ্য জনপ্রিয় উপন্যাস রয়েছে। বাংলাদেশের পাঠকদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার যে অবদান তা সাহিত্যপ্রেমী মাত্রই বুঝতে পারেন। তার রচিত প্রতিটি বই পাঠক গ্রহণ করেছেন খুব সাদরে। বাংলাদেশের মিডিয়া অঙ্গনে অন্যতম শক্তিশালী একটি জায়গা দখল করে আছেন বাংলা সাহিত্যের এ মহানায়ক। শোক সাগরে ভাসিয়ে হঠাৎ করে চলে না গেলে আমাদের বাঙালি সাহিত্যকে নিশ্চিতভাবে তিনি আরও বহুুদূর নিয়ে যেতে পারতেন। তবুও বহুমাত্রিক প্রতিভাধর সফল এই ক্ষণজন্মা জাদুুুকর আমাদেরকে যতটুকু দিয়ে গেছেন, সেটুকুুও কোনো অংশে অপ্রতুল নয়। আমাদের মাঝে তিনি এসেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আশীর্বাদ হয়ে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে দু›হাতে একের পর এক রূপে, রসে ও প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ করে গেছেন। এমন একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন যুগের পর যুগ। তিনি পেরেছেন তাঁর কালজয়ী সব সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে এদেশের সকলশ্রেণী পেশার মানুষকে একসুতোয় গেঁথে রাখতে। জনপ্রিয়তার মধ্যগগণে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন মানুষটি এভাবে ওপারে চলে যাবেন, মোহগ্রস্ত পাঠকসমাজ মোটেও ভাবতেও পারেননি। অনেকটা এলেন, দেখলেন এবং জয় করে চলে গেলেন। এদেশের প্রকাশনা সংস্থাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। তাকে নিয়ে যখনি কলম ধরতে গিয়েছি, তখনি শব্দের অ¯ি’র পাখিরা এসে আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। কোথা থেকে শুরু করে আবার কোথায় গিয়ে কলমের ইতি টেনে শব্দের নোঙর ফেলবো- বুঝে ওঠতে পারিনি। এক হুমায়ূন আহমেদের›র কারণে বইপড়া আনন্দ হয়ে ওঠেছে প্রায় সকলের নিকট। ‹৭০ ও ‹৮০ দশকের পর থেকে প্রায় চারদশক ধরে তিনি দাপটের সহিত বাংলা সাহিত্যে মুকুটহীন সম্রাটের ন্যায় রাজত্ব করেছেন। যেখানে হুমায়ূন আহমেদ সেখানেই পাঠকের লম্বা মিছিল। প্রতিবছর বাঙালির বইমেলায় সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন তিনি। নিশ্চিতভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্র¯’ানের মধ্যদিয়ে এই দেশের পাঠক সমাজের মাঝে একধরণের অ¯ি’রতা ও ঘোর ক্রান্তিকাল দেখা দিয়েছে। এ অপূরণীয় শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।
হুমায়ূন আহমেদ ক্ষণজন্মা প্রবাদ পুরুষ। পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষিদের নিকট তিনি সমান জনপ্রিয়। গোটা বাঙালি জাতির সাথে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন এক আশ্চর্য রকমের নাড়ির সম্পর্ক। তিনি ছিলেন অন্য অনেকের থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। চলাফেরা, কথাবার্তা, ও উঠাবসাতে ছিল ভিন্নতা। একা থাকতে পারতেন না, একা কখনো খেতে পারতেন না। মানুষের সঙ্গ ছিল তাঁর অতি অতি প্রিয়। যথেষ্ট আড্ডা পছন্দ করতেন। আজ তিনি চলে গেছেন মানুষের সকল সঙ্গপ্রিয়তার উর্ধ্বে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোতে ইতিবাচক দিকগুলো বেশি থাকতো। তিনি সব সময় মানুষের ভেতরকার সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে চাইতেন। আরো চাইতেন নেতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে যেতে। সুন্দরের অন্বেষণ ছিল তার সারা জীবনের প্রচেষ্টা। জোছনার এক নিটোল নকশা সারা জীবন ধরে তিনি তৈরির চেষ্টা করে গেছেন। ‹নন্দিত নরকে› উপন্যাসের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবন শুরু হয়। এরপর একে একে লেখেন অন্যান্য উপন্যাস ও গল্পগ্রš’গুলো। অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী পেশার জীবন-যাপন তুলে ধরতে পারার চমৎকার জাদুকাঠি ছিলো তাঁর হাতে। তাঁর সৃষ্ট অনন্য প্রধান দু›টি চরিত্র হচ্ছে হিমু ও মিসির আলী। এছাড়া আরও রয়েছে- নিলু, বিলু, জরি, আনিস, শুভ্র, রুপা, মাজেদা প্রভৃতি চরিত্র। যেগুলো সব সময় মনে হতো আমাদেরই আশেপাশে পরিচিত কেউ না কেউ। আমাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে তাঁর সৃষ্ট একেকটি চরিত্রগুলো। যদিও এই চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনে বিশেষ কোনো চরিত্র নয়, কিংবা ইতিহাসের কোনো মহান ব্যক্তিও নয়। তবুও একজন জাদুকর হুমায়ূন আহমেদে›র ছোঁয়ায় আজ প্রতিটি চরিত্র হয়ে ওঠেছে জীবন্ত ও ঐতিহাসিক। তাই তিনিও ক্রমশঃ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের হৃদয়ের মণি। প্রায় তিন শতাধিক জনপ্রিয় ও কালজয়ী বইয়ের রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখির একপর্যায়ে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাংলা টেলিভিশন নাটকে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন। প্রচার করতে থাকেন ‹অয়োময়› ‹আজ রবিবার›, ‹বহুব্রীহি› ও ‹কোথাও কেউ নেই›সহ একেরপর এক জনপ্রিয় নাটক। একটা সময় যখন হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো এদেশের মানুষের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিলো। টেলিভিশনে নাটকগুলো প্রচার শুরু হলে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোও গুণে-মানে ও বিনোদনে ছিলো সেরা। তার ছবিগুলো যেমন রুচিশীল ও সমালোচকদের ভাবিয়েছে তেমনি নিতান্তই বিনোদন খোঁজতে যাওয়া দর্শককেও মুগ্ধ করেছে। তবে গীতিকার হিসেবেও তিনি সফল। তার গানগুলোর জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কম নয়। এসব গানে ওঠে এসেছে মাটি ও মানুষের গল্প, প্রেমের হাহাকার, জল, জোছনা, কদম, বর্ষা! তারমধ্যে সুপারহিট হলো ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ গানটি। এরপর ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ›, ‘ও কারিগর দয়ার সাগর’, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’, ‘চাঁদনি পসরে কে’ গানগুলো জয় করে নিয়েছে বাংলা গানের শ্রোতাদের মন। হারিয়ে যাবার নয় ‘যদি মন কাঁদে’, ‘বরষার প্রথম দিনে’, ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে অবাক জ্যোৎস্না ঢুইকা পড়ে’, ‘আমার আছে জল’ ‘তোমার ঘরের সামনে ছোট্ট একটা ঘর বানাব গো’ গানগুলোও।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত মধ্যাহ্ন উপন্যাস ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের অংশবিশেষ। এছাড়াও তার উলেখযোগ্য সেরা গ্রš’াবলীর মধ্যে রয়েছে- শঙ্খনীল কারাগার, কোথাও কেউ নেই, অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ময়ূরাক্ষী, একজন মিসির আলী, বৃষ্টি বিলাস, জনম জনম, নীল মানুষ ইত্যাদি। সেরা চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে দর্শকপ্রিয় আগুনের পরশমনি, দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, আমার আছে জল, চন্দ্রকথা ইত্যাদি। ঘেটুপুত্র কমলা তার নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র। অসামান্য প্রতিভাবান লেখক হুমায়ূন আহমেদের নিজ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সাফল্যের ঝুলি বিভিন্ন পুরস্কারে সমৃদ্ধ। সেগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার, জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক উলেখযোগ্য। ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ মরণঘাতী কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান মহান সৃষ্টিকর্তার অপার সান্নিধ্যে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা জাদুকর অমর এ ধ্রুপদী মহানায়ককে জন্মদিনে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।