পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আহুত ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সড়ক-মহাসড়কে দেখা দেয় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সন্ত্রাসী কার্যক্রমও পরিলক্ষিত হয়। এই ধর্মঘটে সড়ক পরিবহন খাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতিরও অঘোষিত সমর্থন রয়েছে বলে প্রতীমান হয়। এই সংগঠনের সভাপতি সরকারেরই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান। ধর্মঘটে পরিবহন শ্রমিকরা নিজেরা যেমন যানবাহন চালায়নি তেমনি মালিকপক্ষও যানবাহন চালানোর কোনো চেষ্টা করেনি। পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক-মহাসড়ক দখলে নিয়েছে এবং যাচ্ছেতাই করেছে। তারা অন্যান্য যানবাহন যেমন, অটোরিকশা, ছোট গাড়ি, রিকশা, প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ি, এমন কি মোটরসাইকেল চলাচলে বাধা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা এ্যাম্বুলেন্স চলাচলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। গাড়ি নিয়ে যারাই রাস্তায় নামার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতি তারা মারমুখী আচরণ করেছে। গাড়িতে হামলা চালিয়েছে, চালক ও যাত্রীদের মুখে-গায়ে কালি ও পোড়া মোবিল লাগিয়ে হেনস্থা করেছে। কলেজের বাসে যাওয়ার সময় একজন ছাত্রীকে গায়ে পোড়া মোবিল ও কালি মাখিয়ে অপদস্থ করেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো, মৌলবীবাজারের বড়লেখায় এ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ধর্মঘটের কারণে নিকট ও দূরপাল্লার যাত্রীদের অপরিসীম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। ট্রাক, কার্ভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি, প্রাইম মুভার ইত্যাদি চলাচল না করায় পণ্য পরিবহন হয়নি। বলা যায়, ধর্মঘটের নামে পরিবহন শ্রমিকরা দেশের মানুষকে জিম্মি ও দেশকে স্থবির করে দিয়েছে। সরকারের তরফে ধর্মঘট প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। উচ্ছৃংখল শ্রমিকদের সন্ত্রাসী আচরণ ঠেকাতে আইনশৃংখলা বাহিনী কোনো তৎপরতা প্রদর্শন করেনি। বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ ও সমাবেশের কর্মসূচীতে সরকার আইনশৃংখলার অবনতি ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আনে, অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতির কথা বলে অথচ পরিবহন ধর্মঘটে এত কিছু হওয়ার পরও কাউকেই টু শব্দটি করতে দেখা যায়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত ১৯ অক্টোবর সড়ক পরিবহন আইন পাস হয় জাতীয় সংসদে। এর আগে ৬ আগস্ট মন্ত্রীসভায় আইনটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। জানা যায়, খসড়া আইনে শান্তি ও জরিমানার কিছু বিধান নিয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও মতবিনিময় হয়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়, যেখানে মালিক, শ্রমিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এসব মতবিনিময় ও আলোচনার আলোকেই আইনটি চূড়ান্ত করা হয় এবং মন্ত্রীসভায় তা অনুমোদন লাভ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, শ্রমিক ফেডারেশন ও মালিক সমিতির শীর্ষ নেতা দুই মন্ত্রী মন্ত্রীসভায় এবং সংসদে-কোথাও এই আইন সম্পর্কে তাদের আপত্তি বা দ্বিমত প্রকাশ করেননি। সঙ্গতকারণেই আইনটির প্রতি তাদের দৃঢ় সমর্থন থাকার কথা। বাস্তবতা হলো, পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে এক মন্ত্রীর সংগঠন, অন্য মন্ত্রীর সংগঠনের তাতে মৌন সমর্থন রয়েছে। তাদের সম্মতি ও সমর্থন ছাড়া এ ধর্মঘট ডাক হয়েছে, সেটা কেউই বিশ্বাস করে না। দুই মন্ত্রীর এই দ্বৈত ভূমিকা কেন? ধর্মঘট সম্পর্কে নৌপরিবহনমন্ত্রী জিজ্ঞাসিত হয়েও কিছু বলতে চাননি। আর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে। এখানে মালিকদের কিছু করার নেই। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন যে ৮ দফা দাবিতে ধর্মঘট করেছে, অনেকেই মনে করেন, তা অযৌক্তিক ও যাত্রীনিরাপত্তার পরিপন্থী। আইনে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকের শাস্তি ৩ বছর থেকে ৫ বছর করা হয়েছে। এটা তাদের একটি বড় আপত্তির জায়গা। তাদের আপত্তির আরো একটি জায়গা হলো ৫ লাখ টাকা জরিমানা। আইনটি যখন পাস হয় তখন আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় শাস্তি ও জরিমানা যথেষ্ট হয়নি।
সড়ক পরিবহন আইনের লক্ষ্য সড়কে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা এবং সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে চালকের নিরাপত্তাও রয়েছে। একথা কারো অজানা নয় যে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য চালকরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালনা, অদক্ষতা, ট্রাফিকবিধি লংঘন, অনাকাঙ্খিত প্রতিযোগিতা-প্রবণতাই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির রাস টানতে তাই আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিধানের সঙ্গে চালকদের উপযুক্ত শাস্তির বিধানও থাকা প্রয়োজন। আইনে শাস্তির ব্যবস্থা এই জন্য রাখা হয় যে, শাস্তির ভয়ে সংশ্লিষ্টরা আরো সতর্ক ও সচেতন হবে। অনেকেই বলে থাকেন, এদেশ সড়ক দুর্ঘটনায় যত প্রাণ যায়, তার অধিকাংশই আসলে হত্যাকাণ্ডের নামান্তর। ঘাতক ট্রাক বা বাস নয়, ঘাতক প্রকৃতপক্ষে একশ্রেণীর চালক। কাজেই আইনে তাদের উপযুক্ত শাস্তি থাকতে হবে। ওয়াকিবহালদের অজানা নেই, এরশাদের আমলে পরিবহন শ্রমিকদের কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়। পরিবহন শ্রমিকরা দেশ অচল করে দিয়ে তখন সরকারকে ওই আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। কিছু একটা হলেই পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক-মহাসড়ক দখল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি কোনো বিবেচনাতেই সমর্থন করা যায়না। সরকারকে এব্যাপারে কঠোর হতে হবে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, পরিবহন শ্রমিকরা আইনটি সার্বিকভাবে না বুঝেই ধর্মঘট করেছে। সেতুমন্ত্রী বলেছেন, এ মুহূর্তে আইন সংশোধন করা সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পরিবহন শ্রমিকরা নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে সহ্য করা হবে না। তারা যে যাই বলুন, তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, এই ধর্মঘটের পেছনে কারা আছে, কি আছে। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাই নিয়ামক ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারকে সেই সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।