Inqilab Logo

সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলাম ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে সুনড়বাতের উপকারিতা

এসএম আরিফুল কাদের | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

রাসূলুলাহ (সা)-এর কথা-কাজ, আচার-আচরণ, ইশারা-ইঙ্গিত তথা সব কর্মকাণ্ডকে শরিয়তের পরিভাষায় সুনড়বাত বলা হয়। রাসূল (সা) থেকে এমন কোনো সুনড়বত বর্ণিত নেই যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর কিংবা ফায়দাহীন। মানুষের জ্ঞানের পরিধির স্বল্পতার কারণে কোথাও অসামঞ্জস্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। রাসূল (সা) ছিলেন উম্মতের রূহানী ডাক্তার। সে হিসেবে রাসূলুলাহ (সা) যেসব ভবিষ্যতবানী করেছেন, কোরআন ও সুনড়বাহর পাশাপাশি তাতে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও উপকার বিদ্যমান।
রাসুল (সা)-এর যত সুনড়বাত আছে, তন্মধ্যে সর্বাগ্রে হলো দাড়ি। যা রাখার ব্যাপারে রাসুলুলাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা দাড়ি লম্বা করো এবং মোচ ছোট করো।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম) সেই দাড়ি রাখার যেমনি দ্বীনি উপকার রয়েছে। তেমনি বৈজ্ঞানীকভাবেও রয়েছে এর উপকার।
দাড়ি রাখার ধর্মীয় উপকারিতায় যা পাওয়া যায় তা হলো- এক. দৃষ্টিশক্তি ঠিক থাকে। ফলে ভালোভাবে কোরআন তেলাওয়াত সম্ভব হয়। দুই. দাড়ি থাকলে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। অবৈধ কাজে অংশগ্রহণে লজ্জাবোধ হয়। তিন. মুমিন হিসেবে পরিচিত হওয়া যায়। নতুবা মুমিন-কাফির, পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যায়। চার. অপরিচিত স্থানে মারা গেলে মুসলমান হিসেবে সসম্মানে গোসল ও দাফন-কাফন নসিব হয়। পাঁচ. হাশরের ময়দানে রাসুল (সা)-এর উম্মত দাবি করা সহজ হবে এবং তাঁর সুপারিশ লাভ সম্ভব হবে।
আর বৈজ্ঞানীক উপকারিতায় দাড়ি রাখার সুফল হলো- আধুনিক ডাক্তারদের মধ্যে একজন লিখেছেন যে, সব সময় দাড়িতে খুর চালালে চোখের শিরার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে চোখের জ্যোতিমেই ক্ষীণ হয়ে আসে। অন্য এক ডাক্তার লিখেছেন, দাড়ি বাহিরের জীবাণুকে দাড়ির ভেতরে ঢুকতে প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করে। তাকে গলা, বক্ষ পর্যন্ত অতিμম করতে বাধা দেয়। দাড়ি না রাখায় যৌনশক্তিকে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
খতনা হলো সকল নবী (আ)-এর একটি সুনড়বাত। হজরত ইবরাহিম (আ)-এর পর সব নবী-রাসুল খতনা করিয়েছিলেন। অনেক হাদিস শরিফে এ সুনড়বাত পালনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফিতরাত, অর্থাৎ মানুষের জন্মগত স্বভাব পাঁচটি। খতনা করা, নাভির নিমড়বদেশে ক্ষুর ব্যবহার করা, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা ও গোঁফ খাটো করা। (সহিহ বোখারি) আর এই খতনার স্বাস্থ্যগত উপকারিতার মধ্যে রয়েছে- যার দ্বারা শরীর অধিক পাক-পবিত্র ও পরিচ্ছনড়ব থাকে। খতনা করালে শিশুদের মূত্রপথের সংক্রমণ প্রতিরোধ হয়। এর ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, জ্বর, খাবারে অনীহা এবং স্বাস্থ্য ভালো না হওয়া ইত্যাদি রোগ থেকে ঝুঁকিমুক্ত থাকে। প্রাপ্তপ্তবয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে খতনা করালে লিঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধ হয় ও যৌনবাহিত রোগের ঝুঁকি কমে। পুরুষাঙ্গের মাথার বাড়তি চামড়ার নিচে এক ধরনের সাদা পদার্থ জমে এবং এটিই পুরুষাঙ্গের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। লিঙ্গের মাথায় প্রদাহ, চুলকানি ও জ্বালাপোড়া করলেও খতনা করালে তা সেরে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুরুষের খতনা এইচআইভি বা এইডস প্রতিরোধে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখে, এটি আংশিক সুরক্ষা দেয়। আফ্রিকার যেসব দেশে খতনার হার বেশি, সেসব দেশে এইডসের হার তুলনামূলক কম।
রঈসুল মুফাসসিরিণ হযরত আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস (রা) মিছওয়াকের ১০টি গুণ বর্ণনা করেছেন- ১. আলাহর সন্তুষ্টি অর্জন। ২. শয়তানের অসন্তুষ্টির কারণ। ৩. ফেরেশতারা আনন্দিত হয়। ৪. দাঁতের মাড়ি মজবুত হয়। ৫. মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। ৬. দৃষ্টি শক্তি তীক্ষè হয়। ৭. মুখে সুগন্ধি আনে। কপ ঘ্রাস করে। ৮. এটা রাসূল (সা)-এর সুনড়বাত। ৯. নেক-আমল তথা সওয়াব বৃদ্ধি করে। (সুনানে দারা কুতনি)
মেডিকেল সাইন্সে মিছওয়াকের উপকারিতা হচ্ছে- মিসওয়াক অ্যান্টি সেপটিকের কাজ করে। মুখে এমন কিছু জীবাণু আছে যা প্রচলিত ব্রাশ ও পেস্ট দ্বারা দূর করা সম্ভব নয়। এতে সত্তরেরও অধিক উপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে মাথা ব্যথা দূর হয়। মস্তিষ্ক সতেজ ও সহায়ক হয়। দাঁতের ব্যথা দূর হয়। দাঁতের শুভ্রতা ও উজ্জলতা বৃদ্ধি পায়। দাঁত শক্ত হয়। মাথা ঠাণ্ডা রাখে। চুলের গোড়া শক্ত হয়। চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়। খাওয়ার রুচি বৃদ্ধি পায়। গলায় মাংসপিণ্ড বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। রক্ত পরিষ্কার রাখে। সর্দি-কাশি নিরাময়ে ফলপ্রসূ হয়। হৃদপিণ্ড ব্যাধির উপকারিতা রয়েছে। পাকস্থলীর কার্যকর ভালো থাকে। শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায়। বাক শক্তি সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়। স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায়। অন্তর পরিচ্ছনড়ব হয়। নেকি বৃদ্ধি পায়। শরীরের অতিমাত্রার তাপ বা আদ্রতা দূর হয়ে যায়। শরীর ইবাদতের উপযোগী হয়। সর্ব প্রকার ব্যথা দূর হয়। পিঠ মজবুত হয়। জ্বর থাকলে কমে যায়। জিহ্বা তেজস্বী হয়।
রাসূল (স) ঢিলেঢালা পোশাক পছন্দ করতেন। বিজ্ঞান বলে, ঢিলেঢালা পোশাক পড়লে শরীরের রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। এর দ্বারা অনেক চর্ম রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীদেরকে ঢিলেঢালা পোশাক পরার কথা বলেন।
রাসূল (স)-এর ঘুমানোর বিছানা ছিল চামড়ার। নিচে ছিল খেজুরের ছাল। এতে বিছানাটি বেশ শক্ত হতো। আজকের বিজ্ঞানও বলে, নরম বিছানার চেয়ে শক্ত বিছানায় শোয়া উপকারী। শক্ত বালিশে শোয়াও স্বাস্থ্যসম্মত। শরীরের অনেক বাত-ব্যথা নিরাময় হয় শক্ত বিছানা ও বালিশে।
বসে বসে পানি পান করা সুনড়বত। বিজ্ঞান বলে, দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা পুরো শরীরে একটি চাপ ফেলে। এতে কিডনির সমস্যা হতে পারে। সড়বায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। থেমে থেমে কয়েক দফা নিঃশ্বাস ফেলে পানি পানের কথা বলা হয়েছে হাদিসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণীর নিঃশ্বাস ও ফুঁকের সঙ্গে কার্বনডাই অক্সাইড বের হয়। আর এ কার্বনডাই অক্সাইড যখন পানির সঙ্গে গিয়ে মিশ্রিত হয়, তখন তা থেকে কার্বলিক এসিড তৈরি হয়।
রাসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমরা উদর পূর্তি করে ভোজন করো না। কেননা এতে তোমাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যাবে।’ এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলছে, অতিভোজনের ফলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস ইত্যাদি হতে পারে।
রাসূল (সা) ডান কাত হয়ে শুতেন। তার ডান হাত রাখতেন ডান গালের নিচে। সাহাবিদেরকেও এভাবেই শুতে বলতেন। বিভিনড়ব গবেষণায় দেখা গেছে, ডান কাতে শোয়াই অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। এতে হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ কম পড়ে। পেটের ভেতর ভারি যকৃত ঝুলে থাকে না। ফলে পাকস্থলির ওপর চাপ পড়ে না। পাকস্থলির স্বাভাবিক নড়াচড়া ঠিক থাকে এবং পাকস্থলির ভেতরের খাদ্যদ্রব্য হজমের উপযোগী হয়ে সহজেই খাদ্যনালীর পরবর্তী অংশে চলে যেতে পারে।
সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিস অনুযায়ী পবিত্রতা ইমানের অঙ্গ। এর একটি দিক হল ইস্তেঞ্জা। এটা পানি, মাটির ঢিলা বা উভয়ের দ্বারা করা উচিত। এর বিপরীতে টয়লেট পেপার ব্যবহার ক্ষতিকর। যাতে লজ্জাস্থানের ক্যান্সার, ফিস্টুলা ও চর্মের ইনফেকশন হতে পারে। গত ২৮ অক্টোবর ২০১৭ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ডেইলি মেইল একটি জরুরি প্রতিবেদন ছেপেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আধুনিককালে পশ্চিমা বিশ্বে টয়লেটে পরিচ্ছনড়বতার জন্য যে টিস্যু ব্যবহার করা হয় তা আদৌ যথেষ্ট নয়। বরং টিস্যু ব্যবহারের পরও যথাস্থানে মল থেকে যায়। তা থেকে স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা ও ইনফেকশন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।
সুনড়বাত মোতাবেক জীবন যাপনে যেমন অসংখ্য ফায়দা ও উপকার রয়েছে। তেমনি তা পরিত্যাগের ভয়াবহতা ও অনিষ্ঠতাও অনেক। সুনড়বাত পালনে শৈথিল্য ও অবহেলার কারণে মানুষ নানাবিধ বিপর্যয়েরও সম্মুখীন হয়। বর্তমান বিজ্ঞানময় এই পৃথিবীতে সুখ-সমৃদ্ধির সঙ্গে বাস করতে হলে বিজ্ঞান সমর্থিত ও অসমর্থিত সুনড়বাতে রাসূল (সা)-এর ওপর আমল করার কোনো বিকল্প নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ