Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্যবোধের সঙ্কট এবং সাম্প্রতিক সমাবর্তন বক্তৃতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

আমাদের রাষ্ট্রের মূল সংকট কি, সেই সংকট থেকে উত্তরণের পথ ও প্রতিবন্ধকতাগুলোই বা কি তার সঠিক অনুসন্থান ও মূল্যায়ণ হচ্ছে কি? এমন একটি প্রশ্নকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা ও উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সংকটকে সংকট বলে গণ্যই না করি, ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না করে সুস্থতার ভান করে যদি বলি দিব্যি আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি হাঁটাচলা, আমোদ ফ‚র্তি করে করে নিজের সুস্থতা জাহির করার চেষ্টা করি, তাহলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিয়েও কোন ফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা সে রকম। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখে ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছেন। এহেন বাস্তবতায় নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় সন্তানরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে বা লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় সামিল হচ্ছেন, তখন দেশের সরকার ও শাসকদলের প্রভাবশালীরা দেশের মানুষের সামনে উন্নয়নের ছবক দিয়ে চলেছেন। অথচ এসব প্রভাবশালীদের অনেকেই দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে দেশ থেকে লুণ্ঠিত কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মূদ্রায় বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে সঞ্চিত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, তারা নিজের দেশকে নিজের সম্পদ রাখা বা বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত বা নিরাপদ মনে করছেন না। যে দেশ বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত নয়, সম্পদ ও জীবনের জন্য নিরাপদ নয় সে দেশকে উন্নত বলা যায়না। দেশের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য নিশ্চয়ই দেশের মানুষ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোটদান এবং ভোটের ফলাফলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত রাখার নিশ্চয়তা যেখানে নেই, সেখানে শুধুমাত্র মেগাপ্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রচারনা সেটাও আবার বিলম্বিত, বহুবার বাজেট সংশোধিত এমনকি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ব্যয়বহুল অতি সাধারণ কাজ হলে জনগনের কাছে কোন গুরুত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। রাজকীয় অট্টালিকায় শুয়ে যদি ঘুম না আসে, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা যায়, তার চেয়ে পর্ণ ক‚টীরের সুখনিদ্রা ঢের ভাল নয় কি? এ কারণেই গত কয়েক দশকে বিশ্বে উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা পাল্টে গেছে। আগের এমডিজি (মিলিনিয়াম ডেভেলাপমেন্ট গোল) আর এখনকার এসডিজি(সাসটেইনেবল ডেভেলাপমেন্ট গোল)’র মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। এমনকি জাতিসংঘসহ বিশ্বের আমাদের অনেক দেশ অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা ও প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে জিএনএইচ বা গ্রোস ন্যাশানাল হ্যাপিনেস ইনডেক্সের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। তবে ক্যান্সারের রোগীর মত ইতিমধ্যেই অনেক বেশী দেরী হয়ে গেছে। যেখানে বিশ্বের শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো প্রকৃতির চরমভাবাপন্ন অবস্থা ও দুর্যোগ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে যে সব বিষয়কে দায়ী করা হচ্ছে তার পেছনে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ ও উন্নয়ন ও বিনিয়োগের নামে অপরিকল্পিত, অপরিনামদর্শি প্রকল্প বাস্তবায়ন।

উচ্চশিক্ষা, সমকালীন বিশ্বের নানামাত্রিক সমস্যার সমাধানে গবেষণা ও মুক্তবিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন সৃষ্টির পীঠস্থানের নাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার একটি আন্তর্জাতিক আবহ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যেমন অর্থনৈতিক সামর্থ্য অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যায়। তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও গ্লোবালাইজেশনের হাত ধরে এই মেলবন্ধন যখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে তার বিপরীতমুখী চালচিত্রই ধরা পড়ছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় প্রচুর বিদেশী শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা গেলেও এখন যতই দিন যাচ্ছে বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও নিজেদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা সত্বেও মালয়েশিয়া, ভারত বা ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চাইছে। এটি ঠিক এ কারণে ঘটছে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট-চুয়েটসহ উচ্চশিক্ষার বিশেষায়িত শিক্ষার মান নিচে নেমে গেছে, মূলত শিক্ষাঙ্গনে উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তার সংকটই এর জন্য দায়ী। দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার, সরকারী আমলা ও পেশাজীবীরা যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আসেন। একইভাবে দেশের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দীক্ষাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু হয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিক ধারণা হলেও স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের পাবলিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ও শিক্ষার পরিবেশ ও নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হতে শুরু করেছিল। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ গত এক দশকে চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি ও নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের চর্চার মধ্যদিয়ে একদিকে মেলবন্ধন, অন্যদিকে এক ধরনের উত্তাপ ও উত্তেজনাকর পরিবেশ থাকলেও ২০০৭ সালের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিপোলার পলিটিক্যাল স্পেস ক্রমে সঙ্কুচিত হতে হতে এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের দলীয় মনোভাবাপন্ন ভিসি নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ, ক্ষমতার রাজনীতিতের শিক্ষকদের সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং ছাত্রলীগের নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের অমানবিক আধিপত্য এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, গত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষাঙ্গণে অনেকগুলো বিভৎস ও হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম হয়েছে যা’ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকেই কলঙ্কিত করেনি, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের ঐতিহ্যের উপরও কলঙ্ক লেপিত হয়েছে। ধর্ষণে সেঞ্চুরী, প্রকাশ্য কুপিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে চাপাতি দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য কুপিয়ে ছাত্রী হত্যার চেষ্টা, সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনে হাতুড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পঙ্গু করে দেয়া বা নিরাপদ সড়কের আন্দোলন দমাতে হেলমেট বাহিনীর তৎপরতার সাথে জড়িয়ে গেছে ছাত্রলীগের নাম। এক সময়ে যারা ছাত্রলীগ করে জাতীয় রাজনীতিতে পা রেখে জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, আজ তারা কিছু সংখ্যক ছাত্রলীগ নেতার ন্যাক্কারজনক কার্যক্রম দেখে নিজেদের লজ্জিত অবমানিত বোধ করেন। একইভাবে শিক্ষকতাকে যারা একটি আদর্শ পেশার ব্রত হিসেবে বেঁেছ নিয়েছেন, তারাও নিশ্চয় এখনকার একশ্রেণীর শিক্ষকের অনৈতিকতা ও দুর্বৃত্তপনায় লজ্জিত ও অবমানিত বোধ করেন। শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার মানদন্ডের চেয়ে যারা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থকে বড় করে দেখেন, যাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ নেই, যারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পথে অন্তরায় নন এমন ব্যক্তিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনীত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। গত সোমবার একটি দৈনিক পত্রিবায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অনৈতিক কর্মকান্ডের বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এই নিবন্ধটি লেখার সময় রিপোর্টটি চোখে পড়েছে বলেই এর উল্লেখ করা হল। মূলত: দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে এমন আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। অর্থাৎ দলীয় রাজনৈতিক নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আর নীতিহীন ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে আচরণগত তেমন পার্থক্য থাকছে না।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক রির্পোটে জানা যায়, কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত প্রহৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এহসান রফিক দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে প্রিয় ক্যাম্পাসে ও হলে ফিরে যাওয়ার বদলে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়ে সেখানকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসএম হলের ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা মারধরের শিকার হয়ে গুরুতর জখম হয়। তার চোখের একটি কর্ণিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে পারিবারিক খরচে দেশে ও ভারতে অস্ত্রপচারসহ দীর্ঘদিন চিকিৎসা করা হয়। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, চট্ট্রগ্রাম কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষায়তনের ক্যাম্পাসে অন্তত ২০জন শিক্ষার্থী কথিত ছাত্রলীগ কর্র্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এহসানের খবরটি গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ৭ ছাত্রলীগ নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল তারা এখনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এবং হলে বহাল তবিয়তে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে চালিয়ে যাচ্ছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এমনকি আজীবনের জন্য বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতাও নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কার করা হলেও তারাও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে বলে জানা যায়। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সন্ত্রাসী ও গুরুতর অপরাধি ছাত্রলীগ কর্মীদের নিবৃত্ত রাখতে যেমন ব্যর্থ, তেমনি নির্যাতিত ও ক্ষত্রিগ্রস্ত এহসান রফিকের শিক্ষাজীবনের স্বাভাবিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে দেশের শ্রেষ্ট শিক্ষায়তন ছেড়ে বিদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে বাধ্য করা হল। এমন নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রতি বছর দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেও দেশ থেকে বছরে শত শত কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরোধি রাজনৈতিক মতের শিক্ষার্থীদের রাজনীতি চর্চার কোন স্পেস না থাকা এবং বিরোধি মতের শিক্ষার্থীদের বর্বর হামলার খবর মেইনস্ট্রীম মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থাহীনতার সংকটে পড়ে যাচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা আগের মত ঢাকায় পড়তে আসতে চায়না, আবার দেশীয় শিক্ষার্থীরাও বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ১০ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে জানা যায়, টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অসৌজন্যমূলক আচরণের বিচার না পেয়ে একযোগে ৫২ জন শিক্ষক পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। যে দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতি, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শিক্ষা ও সহাবস্থানের জন্য নিরাপদ নয়, সরকারী মদতে হামলা-মামলা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার এমন একটি সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কিভাবে উন্নয়নের সোনালী সময় বলে জাহির করা সম্ভব? চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় দেশের ধনিক শ্রেনী আরো ধনী হচ্ছে, দরিদ্র শ্রেনী আরো দরিদ্র হচ্ছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে বাড়ছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো খাত এবং ডিজিটালাইজেশনেও লক্ষ্যনীয় উন্নয়ন হচ্ছে। এসব উন্নতি নিয়ে দেশের ক্ষমতাসীনরা ভোটের মাঠে রাজনীতি করবেন, এটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান,অ্যাকাডেমিসিয়ান, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ মর্যাদার ব্যক্তিরা সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রের প্রকৃত সমস্যা ও সংকটগুলো চিহ্নিত করবেন এবং উত্তরণের পথ নিয়ে কথা বলবেন, এটাই সচেতন দেশবাসির প্রত্যাশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলার এডভোকেট আব্দুল হামিদের দেয়া ভাষণটি এবারো সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। দেশের মন্ত্রী-এমপিরা যখন তথাকথিত উন্নয়নের ভাঙ্গা ঢোল বাজিয়ে চলেছেন, তখন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ভিন্নধর্মী বক্তব্য দিয়ে শ্রোতাদের আমোদিত করেছেন। তবে রাষ্ট্র যখন একটি সমুহ সংকটের মুখোমুখি, আগামী প্রজন্ম এক ধরনের হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন দেশের প্রাচীনতম, বৃহত্তম ও ঐতিহ্যবাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল সমাবর্তন অনুষ্ঠানের চেন্সেলর ও রাষ্ট্রপতির কাছে কেউ বিনোদন বা ভাঁড়ামি প্রত্যাশা করেন না। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সরকারী প্রটোকলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে দেয়া বক্তৃতায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা’ রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতার মত সিরিয়াস বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার মত সরলতা ও উদারতা প্রদর্শনের জন্য এবং ডাকসু নির্বাচনের উপর বিশেষ তাগিদ দেয়ায় রাষ্ট্রপতি অনেকের ধন্যবাদার্হ হতেই পারেন। সেই সাথে সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা, সহাবস্থান ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুগ স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখতে তার বক্তৃতায় কোন দিক নির্দেশনা বা প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যায়নি। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থানের কোন পরিবেশ নেই, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে ভিসিরা পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতা ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত হয়ে নিরাপত্তাহীনতা ভুগছেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রতিবেশী দেশের বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে চটুল গল্পসহ সন্তানত‚ল্য ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে নানা হালকা মন্তব্য করা অনেকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতির সমাবর্তন বক্তৃতাটি আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের সংকট ও সম্ভাবনার অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠতে পারত। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা কমেন্সমেন্ট স্পীচ দিয়েছেন তাদের কারো বক্তৃতাই আমাদের রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার সাথে তুলনীয় নয়। এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালে ইস্টার্ন কেনটাকি ইউনিভার্সিটির কনভোকেশনে অতিথি বক্তা তৎকালীন মার্কিন ফার্স্টলেডি মিসেল ওবামার বক্তৃতার অংশবিশেষের ভাবানুবাদ তুলে ধরা যেতে পারে। সমাবর্তন বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘তুমি যদি একজন ডেমোক্রেট হও তবে কিছুটা সময় রিপাবলিকানদের সাথে কাটাও। আর তুমি যদি রিপাবলিকান হও তবে ডেমোক্রেটদের সাথে আলোচনায় কিছুটা সময় ব্যয় কর। সেখানে কিছু না কিছু কমন বিষয় পেয়ে যেতে পার, যদি তেমন কিছু নাও পাও, যদি তুমি খোলা মনে এবং আন্তরিকভাবে মতবিনিময়ের চেষ্টা কর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তুমি শিক্ষনীয় অনেক কিছুই খুঁজে পাবে। আমাদের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে এ কাজটি আরো বেশী হওয়া প্রয়োজন। আমরা যদি শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধামত নিজেদের সমমনা ব্যক্তিদের সাথেই কথা বলা সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে আমাদের বিভক্তি দূর করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’ যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজনৈতিক পরিবেশ কখনোই আমাদের মত এতটা দূষিত হয়ে পড়েনি, সে ধরনের আশঙ্কাও দেখা দেয়নি। ২০১৩ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি যে বিষয়ে কথা বলেছেন, তার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট উত্তরণের দিক নির্দেশনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে ২০০৪ সালের একটি কনভোকেশনে পশ্চিমাবিশ্বের বিখ্যাত রকস্টার বোনো কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেখানে দেয়া বক্তৃতায় তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘তোমরা কি তোমাদের নৈতিক-মানবিক সম্পদ, তোমাদের মেধা সম্পদ, তোমাদের অর্থসম্পদ এবং তোমাদের কায়িম শ্রমকে এই পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির দেয়ালের বাইরের জগতে কাজে লাগাতে চাও? তাহলে জেনে নাও তোমরা যেভাবে ভাবছ বিশ্ব তার চেয়ে বেশী নমনীয়। এবং দুনিয়া তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, নিজেদের মত করে তা গড়ে নিতে উপযুক্ত আঘাতটি তোমাদেরকেই করতে হবে।’ গুগলে সার্চ করলে বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষনীয় ও মোটিভেশনাল কমেন্সমেন্ট বক্তৃতার সিরিজ পাওয়া যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও ভিসি মহোদয়গণ যদি দেশের সংকট ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে উপেক্ষা করে সমাবর্তন বক্তৃতাকে ভাঁড়ামি কিংবা রসিকতাপূর্ণ গালগল্পে পরিণত করেন, সেটি হবে খুবই অন্যায় ও বঞ্চনাপূর্ণ। জাতির এই সংকটময় ক্রান্ত্রিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী পাওয়া গ্রাজুয়েটদের কাছে শিক্ষক ও জাতীয় নেতাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। এটা তাঁদের অন্যতম মৌলিক দায়িত্বও বটে। অপ্রাসঙ্গিক রসিকতার মধ্য দিয়ে সেই দায়িত্ব বা সুযোগ অপচয় করলে জাতির ভবিষ্যৎ বিভ্রান্ত হতে পারে।
[email protected]



 

Show all comments
  • Md.Sayfullah ১০ অক্টোবর, ২০১৮, ৯:৪৬ এএম says : 0
    উপরক্ত কলাম দিয়ে দেশের বর্তমান অবস্তা ফুটে উঠেছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্ববিদ্যালয়


আরও
আরও পড়ুন