পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমার চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য ভূখন্ড, একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে সে তার অংশ বলে মানচিত্রে দেখিয়েছে। শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়সহ অন্তত তিনটি ওয়েবসাইটে সেন্টমার্টিনকে তার বলে দাবি করেছে। এমন কি সেন্টমার্টিন নিয়ে সমীক্ষাও শুরু করেছে। ঘটনার এই প্রেক্ষপটে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইউ লুইন ওকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জনিয়েছে বাংলাদেশ। দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ ও মিথ্যাচারের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে তার কাছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মো: খুরশিদ আলমের দফতরে ডেকে রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের প্রতিবাদ, বক্তব্য ও অবস্থান জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবাদলিপি তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলোচনায় এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেন সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমারের ভূখন্ড হিসাবে দেখানো ভুল হয়েছে। মো: খুরশিদ আলম ভুল হওয়ার বিষয়টি মানতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা করেছে। তিনি আরও বলেছেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে সমীক্ষার বিষয়টিও তিনি রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চেয়েছেন। বলা বাহুল্য, ভুল হলে সমীক্ষার প্রশ্ন ওঠে না। সেন্টমার্টিনকে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত ও ওয়েবসাইটে প্রদর্শন যে মিয়ানমার বুঝে-শুনে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করেছে, তার বড় প্রমাণ দ্বীপটি নিয়ে সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ বা পদক্ষেপ। রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে তার মুখ খুলতে সম্মত হননি। শুধু বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থান তিনি তার দেশের সরকারের কাছে তুলে ধরবেন। সেন্টমার্টিন যে বাংলাদেশের, সেটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এবং এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করলে যে কেউ দেখতে পাবেন, সেন্টমার্টিন কখনই মিয়ানমারের অংশ ছিল না। ১৯৩৭ সালে যখন ব্রিটিশ শাসকরা মিয়ানমারকে ভারত থেকে আলাদা করে তখন সেন্টমার্টিন ভারতের অংশে দেখানো হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের বিভক্তির সময় সেন্টমার্টিন অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি হয় বাংলাদেশের অন্তর্গত। ১৯৭৪ সালে সেন্টমার্টিনের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চুক্তি করে মিয়ানমার। ২০১২ সালে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের মানচিত্রেই দেখানো হয়েছে।
বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত বাংলাদেশের দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমার যে এখন তার বলে দাবি করছে কিংবা তার মানচিত্রে যুক্ত করে দেখাচ্ছে, এর পেছনে দূরপ্রসারী মতলব থাকাই স্বাভাবিক। তাই বিষয়টি সহজভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধানোর ব্যাপার বলেই মনে করা যায়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, অতীতে মিয়ানমার বিনা উস্কানিতে বাংলাদেশের পানিসীমায় জাহাজ পাঠিয়ে একটা যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের কঠোর পদক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের জাহাজ বাংলাদেশের পানিসীমা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের বিমান, ড্রোন বাংলাদেশের আকাশ সীমা লংঘন করেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে, প্রতিবাদে আবার ফিরিয়েও নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মাঝে-মধ্যেই বাংলাদেশের সীমানায় অনুপ্রবেশ করেছে, গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। বাংলাদেশ কখনই এসবের পাল্টা জবাব দিতে যায়নি। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে প্রতিটা ঘটনা ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীরা রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা, গণপীড়ন ও গণউৎসাদন শুরু করে, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েক লাখ। এই বিপুল সংখ্যাক মানুষের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করলেও তার জন্য রোহিঙ্গারা একটা বিরাট সমস্যা হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে বা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্ট এবং সমস্যাটি একান্তই তার, অথচ তা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এই গণহত্যা, গণপীড়ন ও গণউৎসাদনকে কেন্দ্র করেও মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সংঘাত সৃষ্টির নানান ফন্দি-ফিকির করেছে। বাংলাদেশ তার পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। বরং শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের পথ অনুসরণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলেও সে চুক্তি অনুযায়ী একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরৎ নেয়নি। এ ব্যাপারে তার তালবাহানা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো অনুরোধ ও তাকিদই সে গ্রাহ্য করছে না। উল্টো প্রত্যাবাস বিলম্বিত হওয়ার জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপরই দোষারোপ করেছে।
প্রতিবেশীর সঙ্গে সহাবস্থানমূলক নীতি, সীমান্তকে সর্ব প্রকার উত্তেজনা ও সংঘাতের বাইরে রাখা এবং যে কোনো বিরোধ-বিতর্কের আলোচনা-ভিত্তিক, ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান বাংলাদেশের অন্বিষ্ট হলেও মিয়ানমার একে বাংলাদেশের দুর্বলতা হিসাবেই দেখছে বলে মনে হয়। তা না হলে একের এক অন্যায়, অন্যায্য, উস্কানিমূলক আচরণ ও কাজ করছে কেন? তার কথা ও কাজের মধ্যে এত বৈপরীত্যই বা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেন? বিষয়টি বাংলাদেশকে গভীরভাবে বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। প্রথমে কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। দ্বিপাক্ষিক পর্র্যায়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এতে কাজ না হলে বন্ধু দেশেগুলোর সহযোগিতা পেতে কূটনৈতিক তৎপরতা সম্প্রসারিত করতে হবে। এক্ষেত্রে চীন বিশেষভাবে বাংলাদেশের সহায়তায় আসতে পারে। চীন একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। স্মরণ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ চীনের পরামর্শ মতো দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে সমাধানে সম্মত হয়ে কাজ করছে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও চীন প্রভাবক ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও রক্তমূল্যে কেনা। কেউ এর কোনো অংশ দাবি করলেই আমরা তা দিয়ে দিতে পারি না। সে অধিকার কারো নেই। এক্ষেত্রে আমাদের নীতি হতে হবে : ‘বিনা রণে নাহি দিব সূচগ্র মেদিনী’। অতএব, প্রয়োজনে কঠোর ও শক্ত হতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।