পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইহুদী হয়েছে, যারা সাবেয়ী, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজক এবং যারা মোশরেক হয়েছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর সম্যক প্রত্যক্ষকারী।’ (সূরা- হজ¦, আয়াত: ১৭) এ আয়াতে ছয় শ্রেণির লোকের কথা বলা হয়েছে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহতাআলা ফয়সালা করবেন। প্রথম শ্রেণির লোকেরা মোমেন এবং বাকি পাঁচ শ্রেণির লোকদের নামও বলে দেওয়া হয়েছে। এরা ইহুদী, সাবেয়ী, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক এবং মোশরেক। এ পর্যায়ে আমাদের আলোচনা ‘অগ্নিপূজক’ নিয়ে।
আয়াতে ‘অগ্নিপূজক’কে বলা হয়েছে ‘মাজুস’। সমগ্র কোরআনে ‘মাজুস’ এই একবারই বলা হয়েছে। পৌত্তলিকতার একটি প্রতীক হচ্ছে ‘অগ্নিপূজা’। সাধারণভাবে প্রচলিত, ভারতে ৩৩ কোটি দেবতার পূজা হতো। ভারত ছাড়াও দুনিয়ার নানা স্থানে অসংখ্য মূর্তির পূজা হতো। সে সব পূজ্য দেবতার পরিসংখ্যান নেওয়া হলে সম্ভবত দুনিয়াময় দেবতাই দেবতা দৃষ্টিগোচর হবে। ভারতে পূজার আধিক্যের প্রতি কটাক্ষ করে বিখ্যাত সাধক কবি হজরত আমীর খসরু বলেছিলেন; ‘গুলো বর্গে তুলসী বএক জানে হিন্দ,
হরিবুল গুয়েন্দে সেজদা দেহেন্দ’ অর্থাৎ- তুলসি গাছের পাতাগুল্ম হিন্দুদের কাছে এত প্রিয় ও ভক্তির পাত্র যে, ‘হরিবোল হরিবোল’ বলে তাকে সেজদা করতে থাকে।
কোরআনে শির্ক ও মোশরেক বলতে শূন্যবাদী বা অংশীবাদী সকল শ্রেণিকে বুঝানো হয়েছে। আর আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে যে শ্রেণিগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ‘মাজুস’ বা অগ্নিপূজকও রয়েছে। দুনিয়াতে আগুন জাহান্নাম বা দোজখের নিদর্শন। অগ্নিপূজকরা ভারত ও আরবসহ বিভিন্ন দেশে বড় বড় বহু ‘আতেশ কাদা’ বা অগ্নিকুন্ড নির্মাণ করেছিল এবং পূজারীরা সেগুলোর পূজা-অর্চণা করত। আগুন ছিল তাদের উপাস্য-দেবতা।
আবার বিভিন্ন যুগে পৌত্তলিক অত্যাচারী শাসক চক্র প্রতিপক্ষ ‘হকপন্থী’দের নির্মূল করার অসৎ উদ্দেশ্যে অগ্নিকুন্ড খনন করে তাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার জঘন্যতম ব্যবস্থাও করেছে। যার কিছু কিছু ঘটনা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে এবং ইতিহাসেও বহু দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে অগ্নিপূজার ইতিহাসও জেনে রাখা দরকার। নমরূদের পূর্বে অগ্নিকুন্ড খনন করে মানুষ পুড়ানোর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল কিনা বলা কঠিন। তবে নমরূদ হজরত ইবরাহীম (আ.)-কে তার স্থাপিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তাআলা অগ্নিকে নির্দেশ করেন, ‘ইয়া নারু কুনিবারদান ওয়াসালামান আলা ইবরাহীম’। হে আগুন! ইবরাহীম (আ.) এর প্রতি শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও। অগ্নিকুন্ড গুলজার হয়ে গিয়েছিল, ইবরাহীম (আ.) সম্পূর্ণ নিরাপদে বের হয়ে আসেন।
সূরা বুরুজে বর্ণিত ‘আসহাবুল অখদুদ’। অর্থাৎ- কুন্ডবাসীদের ঘটনাটি ঘটে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে। খন্দক বা গর্তে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদার লোকদের তাতে নিক্ষেপ করার বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়ে থাকে। তবে কখন থেকে এরূপ নিষ্ঠুর, নৃশংস ঘটনার সূত্রপাত এবং কে এর প্রবর্তক তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কোরআনে খোদায়ী দাবিদার নমরূদের কথা বলা হয়েছে। সে ‘হাওজান’ নামক এক অগ্নিপূজকের প্রস্তাবে বিভ্রান্ত হয়ে একটি গর্ত খনন করে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেছিল এবং সেখানে হজরত ইবরাহীম (আ.)-কে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের ৪৫ বছর পূর্বে পৌত্তলিক ‘যুনাওয়াস’ বাদশাহ ঈমানদারগণকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য যে অগ্নিকুন্ড স্থাপন করেছিল তাতে মোমেনদের নিক্ষেপ করার সাথে সাথে আল্লাহতাআলা তাদের সকলের প্রাণ কবজ করেন বলে একটি বর্ণনা রয়েছে। ফলে আগুনে দগ্ধ হওয়ার কষ্ট তাদের ভোগ করতে হয়নি। কোরআনে বর্ণিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের এ দুইটি ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন তফসীর গ্রন্থে আরও কিছু অনুরূপ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। যুনাওয়াসের ঘটনাটি তফসীরে হাক্কানীতে বিশদভাবে আলোচনা করার পূর্বে আরও দুইটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে। সিরিয়ায় রূমী শাসক ‘বেতামুস’ এবং ‘দানিয়াল (আ.)’ এর যুগে পারস্যে ‘বখতে নছর’ এরূপ ঘটনা ঘটিয়েছিল। হাবশা বা আবিসিনিয়ায় ও একবার এরূপ ঘটনা ঘটেছিল বলে হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন। ‘আসহাবে অখদুদ’ এর ঘটনাটি বনি ইসরাইল ঘটিয়েছিল বলে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা হতে জানা যায়। তখন তাদের মধ্যে প্রতিমাপূজার প্রচলন ছিল। তারা খোদা ভক্ত ঈমানদারগণকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল।
এবার ‘আসহাবে অখদুদ’ কুন্ডবাসীদের ঘটনাটির ওপর কিঞ্চিত আলোকপাত করা যেতে পারে, যা নাজরানে সংঘটিত হয়েছিল। এটি বিভিন্ন তফসীরে বিভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সীরাতে মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক ও মোহাম্মদ ইবনে কাব কর্তৃক যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
তিনি বলেন, নাজরানের অধিবাসীরা মূর্তিপূজা ও শির্ক বা শূন্যবাদীতে লিপ্ত ছিল। তাদের নিকটস্থ বস্তিতে একজন যাদুকর বসবাস করত। সে নাজরানের ছেলেদেরকে যাদু শিক্ষা দিত। কিছুদিন পর নাজরান এবং যাদুকরের বস্তির মধ্যে ‘ফায়মিরুন’ নামক একজন সাধক, মোজাহেদ এবং কাশফ কারামতের অধিকারী খ্রিস্টান পর্যটক এসে অবস্থান করতে থাকেন। নাজরানের যেসব ছেলে যাদুকরের নিকট যাদু শিখত তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘আবদুল্লাহ ইবনে তামুর’। একদিন সে খ্রিস্টান যাজকের নিকট চলে যায়। যাজক নামাজে ব্যস্ত ছিলেন। যাজকের নামাজ ও এবাদত পদ্ধতি আবদুল্লাহর খুব পছন্দ হয় এবং তার নিকট সে যাতায়াত করতে থাকে। যাজকের নিকট সঠিক খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা করে সে ধর্মের আলেম হয়ে যায় এবং সে ধর্মের প্রচার শুরু করে দেয়। সে লোকেদের ঈমান আনার জন্য আহ্বান করতে থাকে। তার দোয়ায় রোগীরা আরোগ্য লাভ করতে থাকে। নাজরানের বাদশাহ এ খবর জানার পর ছেলেটিকে তলব করেন এবং বলেন, ‘তুমি আমার দেশে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করছো এবং আমার বাপ-দাদার ধর্মের বিরোধিতা করছো। তাই তোমার শাস্তি হচ্ছে তোমাকে হত্যা করা।’
ছেলেটি বলে, ‘হে বাদশাহ! আমাকে হত্যা করা আপনার ক্ষমতার বাইরে।’ বাদশাহ রাগান্বিত হয়ে হুকুম দেন যে, ‘একে পর্বত চ‚ড়া হতে নিচে ফেলে দেয়া হোক’। সরকারি আমলারা নির্দেশ পালন করল। কিন্তু আল্লাহর কুদরতে সে সুস্থ ও নিরাপদে রইল। বাদশাহ ক্ষিপ্ত হয়ে নির্দেশ দিলেন, তাকে সাগরে নিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু সাগরও ছেলেটিকে কোন ক্ষতি করতে পারল না। তখন ছেলেটি বাদশাহকে বলল, ‘আপনি যদি নিশ্চিত আমাকে হত্যা করতে চান তাহলে তার একটি মাত্র উপায় হচ্ছে, আপনি একক আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আমার ওপর হামলা করুন।’ বাদশাহ একক আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে ছেলেটির ওপর হামলা চালান এবং ছেলেটি নিহত হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে আল্লাহর আজাবে বাদশাহও সেখানে ধ্বংস হন।
নাজরানে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচলন এবং ছেলে ও যাজকের ঘটনার আলোচনা যখন ইয়েমেনের বাদশাহ যু-নাওয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন তিনি রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। তিনি ছিলেন ইহুদী এবং খ্রিস্ট ধর্মের ঘোর বিরোধী। তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে নাজরানে পৌঁছেন এবং সমগ্র শহরে ঘোষণা প্রচার করে দেন যে, কোন ব্যক্তি খ্রিস্ট ধর্মে থাকতে পারবে না, প্রত্যেক ব্যক্তিকে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, অথবা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু কেউ তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত হলো না। কেননা, নাজরানবাসীদের অন্তরে সত্য ধর্ম এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, তারা ধর্ম ত্যাগ নয়, মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল। তাদের দৃঢ় সংকল্প ও মনোভাব দেখে যু-নাওয়াস আরও ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং নির্দেশ প্রদান করেন যে, শহরের সকল অলি-গলি ও রাজপথগুলোর ধারে ধারে খন্দক বা পরিখা ও গর্ত খনন করা হোক এবং সেগুলোতে অগ্নি প্রজ্জলিত করা হোক। সৈন্যরা যখন নির্দেশ পালন করে তখন নগরবাসীদের সমবেত করে বাদশাহ নির্দেশ প্রদান করেন যে, ‘যে ব্যক্তি ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে, সে পুরুষ হোক বা নারী কিংবা শিশু তাকে জীবন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হোক।’ এ নির্দেশ অনুযায়ী কুড়ি হাজারের মতো ঈমানদার লোককে শহীদ করা হয়।
হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিজী এবং মোসনাদে আহমদ-এ হজরত সোহায়ব রূমী (রা.) রসূলুল্লাহ (সা.) এর বরাতে অনুরূপ একটি ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন, যাতে বলা হয়েছে, এই হৃদয় বিদারক ভয়াবহ দৃশ্য বাদশাহ ও তার মোসাহেবগণ অত্যন্ত আনন্দের সাথে উপভোগ করছিলেন। এসময় দুধের শিশু কোলে এক মহিলাকে আনা হয়। মহিলা তার শিশুর প্রতি মমতাবোধে বিচলিত হয়ে উঠে। তৎক্ষণাৎ শিশুটি বলে উঠে; ‘ওম্মাহু! ইছবির ফাইন্নাকে আলাল হক্কে’ অর্থাৎ- হে মা! ধৈর্য ধারণ কর এবং নির্ভীকভাবে খন্দকের প্রতি ধাবিত হও। কেননা নিশ্চয় তুমি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ জালেম বাতিলের। নাজরানের এ ঘটনায় ‘দূছ যু ছা’লাবান’ নামক এক ব্যক্তি কোন রকমে প্রাণ রক্ষা করে পালিয়ে যায় এবং সিরিয়ায় অবস্থানরত রোমক সম্রাট কায়সারের দরবারে পৌঁছে নাজরানের হৃদয় বিদারক কাহিনী জানায়। বিবরণ শুনে কায়সার তাৎক্ষণিকভাবে হাবশার (আবিসিনিয়ার) বাদশাহ নাজ্জাশীকে লিখলেন যে, এই নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে হবে। নাজ্জাশী সত্তর হাজার হাবশী বাহিনী নিয়ে ‘আরবাত’ নামক সেনাপতির অধীনে ইয়ামেনে প্রেরণ করেন। তার আক্রমণে ইহুদী যু-নাওয়াস নিহত হয় এবং তার বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে ইয়ামেনে ইহুদী শাসনের অবসান ঘটে এবং ইয়ামেন খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের একটি অংশে পরিণত হয়। এই ঘটনাটি ঘটে রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের ৪৫ বছর পূর্বে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।