Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রশাসন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

গত ২৫ আগস্ট নাটোরের বরাইগ্রাম উপজেলায় বিকাল ৪টার দিকে পাবনা থেকে রাজশাহীগামী চ্যালেঞ্জার পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে বনপাড়া থেকে ঈশ্বরদীগামী লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনা স্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ৩ জনসহ মোট ১৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ২৫ জনের মতো। প্রত্যেক্ষদর্শী পথচারীদের মতে, ঈদের ছুটিতে মহাসড়ক ফাঁকা পেয়ে বাস চালকদের দ্রুত গতিতে অথবা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া পরদিন সকাল থেকে ২৪ ঘণ্টায় সড়ক দুর্ঘটনায় কুমিল্লার শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস প্রাইভেট কারকে ওভারটেকিং করতে গিয়ে মহাসড়ক থেকে ছিটকে খাদে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেলে ঘটনা স্থলে বাসের দু’জন যাত্রী নিহত হয়। কক্সবাজারের রামুতে যাত্রীবাহী হানিফ পরিবহনের বাসের ধাক্কায় এক সিএনজি যাত্রী, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, ফরিদপুরে পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জন, মাগুরা, ঝিনাইদহ সড়কের আসমাখালীতে একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় এক যুবকসহ ৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে বা কারা? যারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী তাদের কী শাস্তি হয়? যাদের কারণে নিরীহ যাত্রী-পথচারী প্রাণ হারাচ্ছে, বিকলাঙ্গ হচ্ছে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে দিনযাপন করছে, অন্যের নিকট থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করে ক্ষুধা নিবারণ করছে, ছেলে-মেয়ে স্ত্রীসহ পরিবার-পরিজন উপবাস করছে, তাদের কি শাস্তি হচ্ছে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও অর্থদণ্ডের বিধান চালু থাকলে হয়তো যানবাহনের মালিক ও চালকরা এবং বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা সচেতন হতেন।
আমরা কি চিন্তা করি কত সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন মূহুর্তেই শেষ হয়ে যায় একটি দুর্ঘটনার কারণে। একটা কালবৈশাখির ঝড় ওঠে শান্তিপ্রিয় পরিবারগুলোতে। অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারগুলো। রক্তমাংসের মানুষগুলো স্থবির হয়ে পড়ে দেহ-মনে। প্রতিদিন খবরের কাগজ কিংবা টিভিতে খবর দেখলে গা শিউরে উঠে। মনে আঘাত পাই। এসব খবর দেখে মনটা খারাপ হয়। অনেক সময় মনোকষ্ট থেকে রক্ষা পেতে খবর দেখি না। আর কতকাল এভাবে গাড়ির চাপায় বা ধাক্কায় প্রাণ হারাবে অসহায় মানুষগুলো? এর কি কোন সুরাহা হবে না?
ব্রিটিশ শাসন আমরা দেখিনি। যাঁরা দেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পরপারে। মুষ্টিমেয় যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন তাঁদের অনেকেই এখন বয়সের ভারে গৃহেবন্দি। তাঁরা বলে থাকেন, ব্রিটিশ আমলে দেশে আইন ছিল, শাসন ছিল, ন্যায়বিচার ছিল। আইনের প্রতি মানুষ শ্রদ্ধাশীল ছিল। এখন এর কিছুই নেই। ছোট বেলায় অনেকের মুখে শুনেছি, ব্রিটিশ জমানায় একটা কুকুর মারলেও তার বিচার হতো। এখন মানুষ মারলেও কিছু হয় না। শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকেই শুনেছেন এসব কথা। প্রশাসনের প্রতি মানুষের চরম অশ্রদ্ধা এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র এই সব কথা।
আজকাল মানুষ মরলেও কিছু হয় না। সত্যিই তো, একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। অহরহ খবরের কাগজে আমরা পড়ছি এবং টিভিতেও দেখছি সে সব সংবাদ। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক কিন্তু উপেক্ষিত। যেন কারও মাথাব্যথা নেই এ ব্যাপারে। মরছে মানুষ মরুক, কী হয়েছে তাতে, এ রকম একটা মনোভাব পরিলক্ষিত হয় নেতা, মন্ত্রী তথা প্রশাসনের। বলতে দ্বিধা নেই, আমরাও সোচ্চার নই এতটুকু, যেমনটা হওয়া উচিত ছিল। যেন মেনে নিয়েছি এটি। এমনি করেই যায় দিন, যাক না। সড়ক দুর্ঘটনা চেনা-অচেনা অনেকের মৃত্যু সংবাদ পড়ে থাকি আমরা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।
আমরা দেখি সড়ক দুর্ঘটনায় চালক পালিয়ে যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। ক্ষুব্ধ জনতার রোষে পোড়ে গাড়িখানা। গাড়ি ভাঙচুর হয়। অথবা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পথ অবরোধ হয়। তারপর প্রশাসনের আশ্বাসে, অনুরোধে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। খ্যাতনামা কোনও ব্যক্তি মারা গেলে শোকপ্রকাশ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি ছাপা হয় কাগজে। অখ্যাত কোনও ব্যক্তি মারা গেলে সংবাদটি ছাপা হয় সংক্ষেপে। এতেও দুর্ঘটনা কিন্তু কমছে না মোটেই, বরং বাড়ছে। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পড়ছি কাগজে। প্রশাসন নির্বিকার। আমরা উদাসীন।
স্বল্প পরিসর রাস্তা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সরকার দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তাগুলোকে আরো প্রশস্ত করতে উদ্যোগী হয়েছিল আশির দশকে। অনেকটা করেছিল। তারপরই নেতা-মন্ত্রী সবাই লেগে গেলেন এর বিরুদ্ধে। কাজ বন্ধ হলো। যারা বেশি বেগে গাড়ি চালায়, আইনের ভাষায় তারা গতি-অপরাধী। ইংরেজিতে বলে স্পিড অফেন্ডার। তাদের রোখবার জন্য গতিরোধক বা স্পিডব্রেকার দিতে হয় রাস্তায়। তাছাড়া জেব্রা ক্রসিং এবং রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা থাকতে হয় দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য। রাস্তার দু’পাশে ফুটপাতও থাকা চাই পথচারীদের চলার জন্য। ফুটপাত দোকানমুক্ত করতে শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সবকিছু তদারকি করার জন্য প্রশাসন এবং বিশিষ্ট নাগরিক তথা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথ কমিটি গড়তে হবে। নেশাগ্রস্থ এবং উপযুক্ত লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সে দায়িত্ব পুলিশের, সরকারের। তাদের সততা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দু’পাশে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা চাই। সে দায়িত্ব বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের।
যারা আইন-কানুন, নিয়ম-শৃংখলা মেনে রাস্তায় যানবাহন চালায় না তাদের জন্য মোবাইল কোর্ট বসাতে হবে। আমার ছাত্র জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় পার্শ্ববর্তী কলেজে আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলাম, বির্তকের বিয়য়টি ছিল: ওয়ান ইন দ্য প্রেজেন্ট সেঞ্চুরি ইন দ্য ক্রাই অব দ্য বারবারিয়ানস। বিচারক ছিলেন তিনজন। একজন অধ্যাপক, একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন সিনিয়র ছাত্র। বির্তক শেষ হওয়ার পর মঞ্চ থেকে নেমে এসে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। তারপর আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। এরপর তাকে একখানা রিক্সা ডেকে দিতে বললেন। আমি রিক্সা ডেকে দিয়ে তার নিকট থেকে সালাম দিয়ে বিদায় নিলাম। ঠিক তিন দিন পর শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দিয়ে রাতে আমি বাতি ছাড়া সাইকেল চালাচ্ছিলাম। পুলিশ আমাকে সাইকেল থেকে নামতে বললো। আমি তাই করলাম। বললো মোবাইল কোর্টে যেতে হবে। আমি সাইকেল নিয়ে পুলিশের সঙ্গে গেলাম। গিয়ে দেখি একটি দোকানের বারান্দায় একটি হাতা ছাড়া চেয়ারে বসে আছেন ঐ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তার সামনে একটি ছোট টেবিল। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সালাম দিয়ে আমার বিরুদ্ধে বাতি ছাড়া সাইকেল চালানোর অভিযোগ পেশ করলো। ম্যাজিস্ট্রেট আমার দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন পাঁচ টাকা জরিমানা। পরিচিত হলেও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে মাফ করলেন না। পাঁচ টাকা জরিমানা দিয়ে আমি সে দিন রেহাই পেয়েছিলাম। পূর্ব পরিচয় আমাকে আইনের প্রয়োগ থেকে ছাড় দেয়নি। এবার লন্ডনের একটি ঘটনা বলি। আমি লন্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন ভোরে একটা জনপ্রিয় পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি সংবাদ দেখলাম। রাজ পরিবারের কিছু ছেলে রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়িতে যতজনের আসন ছিল তার চেয়ে এক জন বেশি যাত্রী থাকায় লন্ডন পুলিশ তাদের ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার জন্য জরিমানা করেছিল। আইনের কাছে রাজ পরিবারের সদস্যদেরও রেহাই নেই।
ট্রাফিক শাখায় কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিএসপি (রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকপ্রাপ্ত) মুতালিব আহমদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. চালকের অসাবধানতা বা অতিরিক্ত বেগে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ২. অপরিণামদর্শী চালানো, ৩. নেশাগ্রস্থ হয়ে বা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় গাড়ি চালানো, ৪. নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী ও নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ মাল নিয়ে গাড়ি চালানো, ৫. অনভিজ্ঞ এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বিহীন চালকের দ্বারা গাড়ি চালানো, ৬. আবহাওয়াজনিত কারণ যেমন, ৭. অতিবৃষ্টির দরুণ রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া, ৮. কুয়াশায় রাস্তা অন্ধকার হয়ে যাওয়া, ৯. পথচারীদের অসাবধানতা, ১০. ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা, ১১. যত্রতত্র পার্কিং, ১২. ট্রাফিক চিহ্নের অনুপস্থিতি, ১৩. প্রশাসনিক অবহেলা, অব্যবস্থা তথা গাফিলতি, যেমন ১৪. চালকের দক্ষতার পরীক্ষা না করেই লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া, ১৫. গাড়িগুলোর পরীক্ষা না করেই ফিট্নেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া, ১৬. ব্যবহারের অযোগ্য পুরনো গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন বাতিল না করা, ১৭. যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত গাড়িগুলোর অবাধ চলাচল, ১৮. স্বল্প পরিসর রাস্তা, ১৯. চালকের শারীরিক অক্ষমতা- যেমন চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, ইত্যাদি, ২০. সূর্যাস্তের পর অপর্যাপ্ত আলো এবং ২১. রাস্তার মানের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি
প্রশাসনের কর্তব্যক্তিদের এ সব কথা জানা আছে। কিন্তু জানলে কী হবে? তাদের বেশির ভাগকেই ম্যানেজ করে নেয়া যায়। আবার তাদের তো নেতা-মন্ত্রীদের কথা শুনতে হয়। না শুনলে বদলি হতে হয়, না হয় ধমক খেতে হয়। ট্রাফিক পুলিশের একজন সাবইন্সপেক্টর আমাকে বলেছিলেন যে, নেশাগ্রস্ত এক ড্রইভারকে আটক করার দশ মিনিটের মধ্যেই মন্ত্রীর কাছ থেকে ফোন এসেছিল পুলিশ সুপারের মাধ্যমে ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আরও বললেন, ছেড়ে না দিলে কি হতো জানেন? আমাকে হয়তো কোনও খারাপ জায়গায় বদলি করে দেওয়া হতো, না হয় ক্লোজ করা হতো। বিপন্ন হতো আমার পরিবার। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক দুর্ঘটনা


আরও
আরও পড়ুন