Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কাঁচা চামড়ার মূল্য ধস : মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের অন্তরায়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে গরু রফতানী বন্ধ হলে এ দেশের মুসলমানদের গোশত খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটাই ধারনা ছিল ভারতীয় গো রক্ষা নেতাদের। শুরুতে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ ধরনের আশঙ্কা কাজ করেছিল। তবে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের জন্য শাপেবর হয়েছে। ভারতীয় বা বিদেশি গরু ছাড়াই পর পর তিন বছর ধরে কোরবানীর ঈদের চাহিদা পরুণ করা সম্ভব হয়ছে। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এ বছর দেশীয় খামারী ও কৃষকদের প্রস্তুতি এমন ছিল যে, ঈদ শেষে উদ্বৃত্ত গুরু নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে খামারি, কৃষক ও বেপারীদের। তবে ঈদে কোরবানীর পশুর চাহিদা মিটাতে প্রস্তুতির কমতি না থাকলেও দেশের চামড়াশিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পুরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাৎসরিক উৎস সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের খাম-খেয়ালী, অদূরদর্শিতা ও অপরিনামদর্শিতা দেখে হতবাক হতে হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশগত ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে সারাবিশ্বেই চামড়া ও পাটের মত প্রাকৃতিক তন্তুজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে মূল্যও বাড়বে, এটাই বাজার ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্ববাজারে চামড়ার মূল্য কিছুটা কমলেও দেশীয় বাজারে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য কমেছে এমন কোন তথ্য আমাদের জানা নেই। পাঁচ বছর আগেও কোরবানীর গরুর চামড়ার সরকারীভাবে নির্ধারিত মূল্য ছিল প্রতি বর্গফুট ৯০ টাকা। মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ণ ইত্যাদি বিষয়গুলো ধর্তব্যে রাখলে পাঁচ বছরে চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় প্রতি বর্গফুট প্রায় ১২০ টাকা। সেখানে ২০১৮ সালে কোরবানীর আগে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে বর্গফুট ৪০ টাকা, যা’ যৌক্তিক মূল্যের তিনভাগের একভাগ। তবে এ সময়ে গরুর গোশতের দাম বেড়েছে দ্বিগুনের বেশী। রমজানের আগে সিটি কর্পোরেশন যে মূল্য বেঁধে দেয় বিক্রেতারা তা মানেনা। তারা কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেশী দামে বিক্রি করে। অন্যদিকে কোরবানীর ঈদে হ্রাসকৃত মূল্যের চেয়েও কমদামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে সাধারণ মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে ক্রমান্বয়ে কাঁচা চামড়ার মূল্য কমানো হয়েছে। এ বছর হ্রাসকৃত মূল্য নির্ধারণের ঘোষনা দিতে গিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ চামড়া ব্যবসায়ী ও রফতানীকারকদের স্বার্থের কথা বলেছেন। সরকার চামড়া ব্যবসায়ী ও রফতানীকারকদের স্বার্থ দেখলেও কোরবানীর পশুর চামড়ার অর্থনৈতিক লেদেনের সাথে জড়িত থাকে দেশের হাজার হাজার মাদরাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং এবং গ্রামীন জনপদের অতি দরিদ্রশ্রেণীর মানুষের স্বার্থ। কোরবানীর ঈদের সময় প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ পশুর চামড়ার বাজার মূল্য যদি ২ হাজার কোটি টাকা হয়, এই টাকার প্রায় পুরোটাই কওমী মাদরাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, দুস্থ ও অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে বন্টিত হয়। যে সব ক্ষেত্রে সরকারী অনুদান ও উন্নয়ন বাজেটের অর্থ পৌছায়না, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের এই দানে সে সব খাতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ ও গতি সঞ্চারিত হয়। কোরবানীর পশুর চামড়ার মূল্যে ধস নামিয়ে মূলত দেশের কওমী মাদ্রাসা ও গ্রামীন অতি দরিদ্র মানুষের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার উপর বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হয়েছে। চামড়ার মূল্য কমিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হলেও আদতে চামড়ার নামমাত্র মূল্যের কারণে এর প্রতি অবহেলা ও অপচয়ের কারণে সামগ্রিকভাবে চামড়ার উৎপাদনের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে।
প্রায় প্রতি বছর গো-খাদ্যের দাম বাড়ে, গরুর দাম বাড়ে, গরুর গোশতের দাম বাড়ে, জুতা, ব্যাগ, বেল্টসহ চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়লেও, কাঁচা চামড়ার দাম কমছে কেন? এমন প্রশ্নের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠে এসেছে কওমী মাদরাসার প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠনের সংবাদ সম্মেলনে। ঈদুল আজহার আগে আবারো চামড়ার মূল্য কমানোর প্রতিবাদে কওমী ফোরাম ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। কওমী ফোরাম চামড়ার অব্যাহত মূল্য কমানোর পেছনে একই সঙ্গে দেশের মাদরাসা শিক্ষা এবং চামড়াশিল্প ধ্বংসের চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা টেনারী সিন্ডিকেট এই চক্রান্তের সাথে জড়িত বলে তাদের অভিযোগ। এই অভিযোগের পেছনের সত্যাসত্য যা’ই থাক, কোরবানীর ঈদের সময় কাঁচা চামড়ার অব্যাহত মূল্য হ্রাসের সাথে দেশের চামড়াশিল্প এবং কওমী মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্বার্থের প্রশ্নটি ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে দেশের একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে এ শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার দাবী জানাচ্ছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সময় জঙ্গিবাদ সম্পৃক্ততার অভিযোগও তোলা হয়েছিল। যা পরবর্তিতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। সারাদেশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার কওমী মাদরাসার অবকাঠামো নির্মান, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণ, শিক্ষকদের বেতন ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই সরকারের বাজেট বা অনুদানের উপর নির্ভরশীল নয়। এটি পুরোপুরি দেশের ধর্মপ্রাণ কওম বা জনগনের ইচ্ছায় প্রত্যক্ষ দান ও সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে ও পরিচালিত হয়ে আসছে। অতএব বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে কোন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলণ এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়েনি। উপরন্তু কওমী মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থী প্রান্তিক জনগনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান-অনুদানে শুধুমাত্র কোরআন-হাদীসের শিক্ষায় শিক্ষিতই হয়না, সেই সাথে লাখ লাখ অতি দরিদ্র ও এতিম শিশুর ভরণ পোষণের দায়িত্বও মাদরাসা কর্তৃপক্ষই পালন করে থাকে। একজন অসহায়, স্বজনহারা এতিম শিশুর শিক্ষা ও ভরণ পোষণের মত অতি মহৎ কার্যে নিয়োজিত কওমী মাদরাসার বাৎসরিক আয়ের একটি বড় অংশই অর্জিত হয় কোরবানীর পশুর চামড়া থেকে। কোরবানীর পশুর রক্ত বা মাংস আল্লাহর নিকট পৌছায়না, পৌছায় শুধু এর জন্য উৎসর্গিত হৃদয়ের তাকওয়া ও সদিচ্ছা। কোরবানীর পশুর গোশত বিতরণ নিয়ে কোন সুনির্দ্দিষ্ট বা কড়াকড়ি নিয়মনীতি না থাকলেও এর চামড়াটি নিশ্চিতভাবেই সমাজের দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। শহর-গঞ্জের অনেক মানুষ নিজেদের কোরবানীকৃত পশুর চামড়াটি স্থানীয় মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করে দেয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে কোরবানীর পশুর চামড়ার টাকা বিলি বন্টনে নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায়। অনেক স্থানে সমাজ বা গ্রাম পঞ্চায়েতে জমাকৃত চামড়াগুলো একসাথে ডাক হতে দেখা যায়। এরপর লব্ধ অর্থ থেকে একটি অংশ গরুর মালিককে দেয়া হয় দরিদ্র ও দুস্থ্য নিকটাত্মীয়দের দান করার জন্য। সমাজ পঞ্চায়েতের হাতে থাকা অর্থের মধ্য হতে বেশীরভাগ স্থানীয় মাদরাসাগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিক হারে বন্টিত হয়। অবশিষ্ট্য অর্থ সমাজের এতিম, বিধবা, দরিদ্র রোগী ও কন্যাদায়গ্রস্থদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে সরকারী ব্যবস্থায় জনগনের রাজস্ব থেকে নানা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের বিশাল অংশ দুর্নীতি, অপচয় ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে লোপাট হলেও কোরবানীর পশুর চামড়া ও যাকাত ফিতরার সামাজিক ব্যবস্থাপনায় সে সুযোগ নেই বললেই চলে। অর্থাৎ কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত শত শত কোটি টাকা ঈদের এক সপ্তাহের মধ্যেই মাদরাসা, দুস্থ্য ও এতিমদের মধ্যে নিরবে নিভৃতে বন্টিত হয়ে যায়।
পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে সমাজ কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বছরে সরকারী বাজেটের বিপুল অংশ ব্যয় করা হয়। লক্ষকোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট ঘোষণার পরও আমাদের দেশে এখনো এক-চতুর্থাংশের বেশী ঘাটতি নিয়ে প্রতি বছর জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়। সেখানে শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেট বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজনের তুলনায় তা চারভাগের একভাগেরও কম। বর্তমান সরকার যে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে চলেছে তার ভালমন্দ সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, প্রায় একদশকেও এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ণের কাছাকাছি পৌছাতে পারিনি। এই ব্যর্থতার প্রথম ও প্রাথমিক অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের সংকট। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা এখন কার্যত মুনাফাবাজ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, নোটবই-গাইডবই বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনী বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, জিপিএ বাণিজ্য ইত্যাদি বাণিজ্যিক ব্যবস্থা পেরিয়ে যে সব সৌভাগ্যবান মানুষগুলো উচ্চশিক্ষিত পেশাদার হিসেবে সমাজে পদার্পণ করেন,তাদের বেশীরভাগের মধ্যেই শিক্ষিত, সৎ. মার্জিত, দক্ষ ও নিয়মনিষ্ঠ মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায়না। তথাকথিত নামিদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পিতা-মাতাকে জীবনের অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। অভিভাবকদের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের পর চাকুরী নামক সোনার হরিণের নাগাল পেতে অনেক পিতা-মাতাকে জীবনের সব সঞ্চয় ও সহায়সম্বল নি:শেষ করে দিতে হয়। অতএব চাকুরীতে যোগ দেয়ার পরই তারা শিক্ষা ও চাকুরীতে ব্যয়িত অর্থ উদ্ধারে তাদের বড় অংশই ঘুষ-দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সাধারণ ও বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত একেজনের পেছনে শুধু পরিবারেরই লাখ লাখ টাকা খরচ হয়না। জনগনের রাজস্ব থেকেও তার পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকার। কিন্তু সরকারী-বেসরকারী কর্মে নিয়োজিত হয়ে সে সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে শুরু করে। পক্ষান্তরে মাদরাসার ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে ধৈর্যশীল ও সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। অতি সাধারণ জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে পারলৌকিক জবাবদিহিতার মূল্যবোধে শাণিত জীবন হয় আড়ম্বরতামুক্ত, লোভ-লালসা, বিলাসহীন অল্পে তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত জীবন। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে সব নীতিহীন, আদর্শহীন, মানবিক মূল্যবোধহীন, লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত ডক্টরেট ডিগ্রীধারী-উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী, আমলা, শিক্ষক, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ গড়ে উঠেছে, তারা একটি বৈষম্যমুক্ত, কলুষমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মান করতে পারেনি। নীতিহীন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জনগনের টাকা লুন্ঠণ করে বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। নীতিহীন শিক্ষকরা সন্তানতুল্য ছাত্রীর শ্লীলতাহানী করতেও দ্বিধা করছে না। এ ধরনের ডাক্তাররা মুমুর্ষু রোগীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। অসৎ ইঞ্জিনিয়াররা স্থাপনায় রডের বদলে বাঁশ দিয়ে কোটি কোটি টাকায় নির্মিত স্থাপনাগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছেন। অন্যদিকে কওমী মাদরাসার মত ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রাপ্তরা সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল স্রোতে কর্মসংস্থানের উপযোগি হয়ে গড়ে উঠছেনা। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ সম্পৃক্ত আধুনিক শিক্ষার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, সন্ত্রাস ও লুন্ঠনের সংস্কৃতি থেকে এ জাতির মুক্তির কোন বিকল্প পথ নেই।
শত শত বছর ধরে এ দেশের কৃষক সমাজ তাদের ফসলের একটি অংশ, মুষ্ঠি চাল, হাঁস-মুরগী, গবাদিপশু, কোরবানীর চামড়া ও যাকাত ফিতরা দিয়ে কওমী মাদরাসাগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দেশে শিল্পায়ণ ও সেবাখাতের উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের ভোগবাদিতা ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মীয় কর্মকান্ডের পরিধিও বিস্তৃত হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে অধিক সংখ্যক মানুষ হজে যাচ্ছে, ঈদুল আজহায় ক্রমবর্ধমান হারে পশু কোরবানী হচ্ছে। একই হারে কোরবানীর পশুর চামড়ার জাতীয় শিল্প এবং এর সাথে জড়িত ধর্মীয় ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও বিস্তৃত হওয়ার কথা থাকলেও এর কোথায় যেন গলদ ঢুকে গেছে। তৈরী পোশাক খাতের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানীখাত দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত। আমাদের বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার বাইরে বর্তমানে দেশের চামড়াশিল্প রফতানী থেকে আয়ের পরিমান বৈদেশিক মূদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশী, যা’ বিশ্ব বাজারের শতকরা এক ভাগেরও কম। চামড়াশিল্পের উন্নয়নে সরকারের গৃহিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে চামড়া রফতানী আয় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কাঁচা চামড়ার অব্যাহত মূল্যহ্রাস এবং মুনাফাবাজদের সিন্ডিকেটবাজি চামড়াশিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চামড়ার দরপতনের কারণে কাচা চামড়া প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সেকেন্ডারী মার্কেটে চামড়ার মূল্য বাড়লেও কোরবানীর পশুর চামড়া নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ার কারণে দেশের কওমী মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক খাত সংকটে পড়ছে। কোরবানীর ঈদের সময় দেশের কওমী মাদরাসার ২০ লাখ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চামড়া ও টাকা সংগ্রহে নিয়োজিত হন। একেকটি মাদরাসা এ সময় বছরের চাহিদার একটা বড় অংশই এ সময়ে সংগ্রহ করে থাকে। অন্যদিকে দেশের চামড়াশিল্পের সারা বছরের প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার বেশীরভাগ সংগৃহিত হয় কোরবানীর ঈদে। যেখানে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য ও চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশী চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের সম্ভাবনাও বাড়ছে। সেখানে কাঁচা চামড়ার মূল্যে ধস নামলে দেশের হাজার হাজার মাদরাসা, এতিম ও দুস্থ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চামড়াশিল্প কতটা লাভবান হবে তা ভেবে দেখতে হবে। কওমী মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা চামড়ার মূল্য পতনকে কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে। কোরবানীর চামড়ার মূল্য দেশের ধর্মীয় শিক্ষা, গ্রামীন দরিদ্র ও দুস্থদের সহায়তার মধ্য দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সমাজ উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই সরকারকে কোরবানীর পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চামড়া

১৩ ডিসেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন