পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
সর্বস্তরের শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা কিছু কার্যকর পদক্ষেপের কথা চিন্তা করতে পারি। যেমন- একটি গবেষণালব্ধ সর্বব্যাপী এবং প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে যেখানে স্তরে স্তরে বাংলাদেশের ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পর্কিত বিষয়সহ সমসাময়িক বিশ্ব, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ঘটনাপ্রবাহ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এতে বাচ্চারা নিজের সম্পর্কে, নিজের আচরণ সম্পর্কে, জাতিবোধ সম্পর্কে এবং পরিবর্তিত বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা পাবে। গড়ে উঠবে দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাস। অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার পাঠ্যক্রম/ সিলেবাস পরিবর্তন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে বাচ্চারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এবং বাচ্চাদের কোমল মনে বারবার অনাকাঙ্খিত আঘাতের ফলে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ঝরে পড়া রোধ ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য-পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শিখানোর বিষয় এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষকদের গভীর জ্ঞান/পারদর্শিতা নিশ্চিত করতে হবে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্মতৎপর ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক তার আদর্শ ও বিশ্বাসকে শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ স্কুল পরিবেশ (বিদ্যুৎ, লাইব্রেরি, পর্যাপ্ত ফার্নিচার, উম্মুক্ত বাতাসের ব্যবস্থাকরণ, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, এসেম্বলি করার জায়গাসহ খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি) নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও নীতিমালার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে শিশু কিশোরদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটর করতে হবে। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার শিশু কিশোরদের সঠিক সামাজিকায়নে বাধাসহ বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় পর্যায়ে ইনোভেশনের মাধ্যমে কর্মপদ্ধতির ধারাবাহিক উন্নয়নকে (কাইজান) আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। শিক্ষক-শক্ষার্থীর অনুপাত অত্যন্ত যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে হবে। শিক্ষক সংকট দূর করার জন্য উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে রিটায়ার্ড শিক্ষকদের নিয়ে একটি কার্যকর শিক্ষক পুল গঠণ করা যেতে পারে। এ পুলের শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভলেনটিয়ার সার্ভিস দিবে। আমাদের জাতীয় রিসেম্বলেন্স (সমরূপতা) এর জন্য শিক্ষার একমুখীকরণ নিয়েও ভাবতে হবে। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক শিক্ষাকার্যক্রম তদারকীর জন্য একটি শিক্ষকবান্ধব মনিটরিং টিম/ টাস্কফোর্স গঠন করা যায়। মনিটরিং টিমে সরাকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি শিক্ষক ও সুধী সমাজ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। টিমের সদস্যরা মাসিক মিটিং-এ মিলিত হবে/মতামত বা সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কাজ করবে। পারফরমেন্সের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানদন্ডে (যেমন ফলাফল, স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষকের উপস্থিতি, ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা, ক্লাসরুম, ভর্তি প্রক্রিয়া, ইনোভেশন ইত্যাদি) বিদ্যালয় র্যাংকিং করা এবং এ র্যাংকিং এর ভিত্তিতে ভালো পারফরমেন্সধারীদের বিশেষ প্রনোদনা দেয়া যেতে পারে। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে আকর্ষণীয় ফলাফলধারীদের বিশেষ প্রশংসাপত্র, সংবর্ধনা বা পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় টাইম উল্লেখসহ স্বাক্ষর নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা (প্রয়োজনে আলাদা শিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে) যাতে তারা অতি আন্তরিক হয়ে ক্লাসে পাঠদান করতে পারে। প্রতিদিন অভিভাবক সমাবেশ (উল্লিখিত ধারণা মতে) করা। ‘স্কুল ক্যাফে ডে’ চালু করা যেতে পারে যেদিন একেক বিদ্যলয়ের নির্ধারিত ২/৩ জন শিক্ষক পাশর্^বর্তী অন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে এবং ভালো অর্জনগুলো নিজের বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজ যেমন নীতিশিক্ষা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উপর আরো বেশি জোর দিতে হবে।
জাপানে ছাত্র/ছাত্রীদের বিশ্বাস করানো হয় যে, চেষ্টা ও শ্রমের দ্বারা তারা নিজেরাই তাদের সকল সম্ভাব্য মেধা ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম। শিক্ষকরা বাচ্চাদের শুধু মোটিভেট করে থাকে এবং চেষ্টা করে বাচ্চাদের ভিতরের সবল এবং দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে। বাচ্চাদের বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন দেখাতে হবে। আমার কর্মস্থল থেকে একবার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে বাচ্চাদের জিজ্ঞাস করলাম, তারা বড় হয়ে কে কী হতে চায়। ২৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ জনই বলল তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। বাকীদের ২ জন পাইলট, ১ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ১ জন বিচারক ৩ জন শিক্ষক হওয়ার কথা বলে। বুঝা গেল আমাদের শিক্ষার্থীরা সাধারণত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা এধরনের কিছু একটা হতে চায়। এটা খারাপ কিছু নয় তবে এ কমন লক্ষ্য ছাড়া যেন আর কিছুই আমরা ভাবতে পারি না। আমরাও ছোটবেলা থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে দেখে এখন অন্য কিছু হয়ে গেছি। এটা আসলে আমাদের জাতিগত সমস্যা। আমাদের অভিভাবকরা হয়ত ভাবতেও ভুলে গেছেন যে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও সন্তানদের আরো বহু কিছু বানানোর চেষ্টা করা যায়, সমাজের বহু জায়গা থেকে নিজের-সমাজের-রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়। আমাদের সন্তানদের সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে, সেই বৈচিত্র্যময় স্বপ্নের বাস্তবায়নে মোটিভেট করতে হবে। জাপানে আমার ছেলের ঐ স্কুলটিতে ক্লাসের প্রথম দিনই সকল শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তারা কে কী হতে চায় এবং তা ভিডিও রেকর্ড করে রাখা হলো। ঐ ক্লাসের ৩৩ জন শিক্ষার্থীর কেউই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা বলেনি কেবল আমার ছেলেটা ছাড়া। তারা কেউ বলেছে রেল স্টেশনের সিকিউরিটি গার্ড, কেউ বলেছে নরসুন্দর, কেউ বলেছে নার্স, কেউ বাস ড্রাইভার, কেউ কৃষক, সপকিপার, ব্যবসায়ী, শিল্পি, টিচার ইত্যাদি। কত বৈচিত্র্যময় পেশার চিন্তা তাদের মননে ও মগজে। শুধু আমার ছেলেই বলেছে সে ডাক্তার হতে চায়। সত্যিকার অর্থে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এর বাইরে যে এত কিছু হওয়ার কথা ভাবা যায় আমিও সেখানে শিখলাম। বছরের শেষ দিবসে আবার তাদের একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। তুলনা করে দেখার জন্য যে এই এক বছরে তাদের লক্ষ্যের কোনো পরিবর্তন হলো কিনা। এভাবেই তাদের গ্রুমিং করে করে পলিশ করা হয় এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে রয়েছে প্রত্যেক পেশার প্রতি সমান সম্মান। শ্রমের মর্যাদা বাস্তবে কি তা সেখানে দেখেছি। আমাদের সন্তানদেরও সকল পেশার প্রতি সম্মানবোধ শেখাতে হবে। তাহলে তারা জেনে-বুঝেই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে। আমাদের সন্তানরাই দেশের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কৃষক হবে এবং সোনার মাটিতে মেধা ও শ্রম দিয়ে সোনার ফসল ফলাবে। আর এভাবে তারা নিজেদের সকল পেশায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সত্যিকারের খাঁটি মানুষে পরিণত হবে এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আর শিক্ষার্থীদের এভাবে তৈরি করার জন্য এবং শিক্ষার যথাযথ মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সুধীসমাজ এবং সরকারসহ সকলের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষকগণকে। একজন আদর্শ শিক্ষক তার মেধা ও শ্রমে গড়ে তুলবে এক একজন আদর্শ জাতি গড়ার সৈনিক। শিক্ষকের আদর- স্নেহ, শাসন, আন্তরিকতা, উপস্থাপনা, বাচনভঙ্গী, বোঝানোর ক্ষমতা, সদাহাস্যোজ্জল মুখ, ইত্যাদি সবই একজন শিক্ষার্থীর জীবন চলার পাথেয় হতে পারে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ পবিত্র উপলব্ধিতে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকগণ যত দ্রুত জাতি গঠনে এগিয়ে আসবে ততই মঙ্গল। (সমাপ্ত)
লেখক: অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, বরগুনা ও জেডিএস ফেলো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।