Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তৈরি পোশাক খাতই রফতানিতে শীর্ষে

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

রফতানি বাণিজ্যে এখনও তৈরি পোশাক শিল্প খাত দেশকে এগিয়ে রেখেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে তৈরি পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। চামড়া, চামড়াজাত খাত, পাট, পাটজাত খাত হোম টেক্সটাইল, কৃষিজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য প্রভৃতি দেশের রফতানিতে বিশেষ অবদান রেখে আসছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে শান্ত। কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। কোন শ্রমিক আন্দোলনও নেই। তাই উৎপাদন খাত বেশ ভালো হওয়া উচিত। দেশে ব্যাপক আকারে শিল্পে বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শিল্প খাতে বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি। সরকারি বড় প্রকল্পে বেশ বিনিয়োগ হয়েছে। তাই দেশে মোট প্রবৃদ্ধি অনেকটা সন্তোষজনক। বর্তমান বাজেট দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেশ উচ্চস্থানে রাখা হযেছে। সরকারি ও বেসরকারি রফতানিকারকগণ দেশের রফতানি বৃদ্ধির জন্য বেশ তৎপর, কিন্তু নানা কারণে রফতানি খাতে টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তৈরি পোশাক শিল্পখাতই এখনও দেশের রফতানির একমাত্র ভরসা।
পণ্য রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। রফতানি আয় ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলার। সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পণ্য রফতানির চেয়ে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছর পণ্য রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের। সেবার প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় ২ দশমিক ২২ শতাংশ বা ৮৩ কোটি ১৯ লাখ ডলার কম হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্য রফতানি আয়ের এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, বরাবরের মতো তৈরি পোশাক রফতানির কারণেই সামগ্রিক পণ্য রফতানিতে ইতিবাচক ধারা বজায় আছে। বিদায়ী অর্থবছরের মোট রফতানির ৮৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। কয়েক মাস আগেও মোট পণ্য রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান ৮১ বা ৮২ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সব মিলিয়ে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে তৃতীয় সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের খাত পাট ও পাটপণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে পোশাক রফতানি থেকে ৩ হাজার ৬১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার আয় হয়েছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। তার মানে সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর তার আগের বারের চেয়ে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ২৪৬ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি বেড়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছর পোশাক রফতানিতে ভয়াবহ ধস নামে। সেবার পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। সেই হিসাবে পোশাক রফতানি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পোশাক কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ আছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের বেশ কয়েকজন শিল্পমালিক। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমরা পোশাক কারখানার সংস্কার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বিভিন্ন সময় বলেছে, আমাদের কারখানাগুলো নিরাপদ ও কমপ্লায়েন্ট। ফলে আমাদের ভাবমূর্তি নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেটি দূর হয়েছে। ক্রেতাদেরও আস্থা ফিরেছে। তাছাড়া সারা বিশ্বের মধ্যে আমরা মান ও সময়মতো পণ্য সরবরাহে বর্তমানে অদ্বিতীয়। সে জন্য পোশাক রফতানি ভালো অবস্থায় রয়েছে।’
ইপিবির হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে ১০৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রফতানি হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রফতানি হওয়া ১২৩ কোটি ডলারের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ১৩৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রফতানি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ শতাংশ কম রফতানি আয় হয়েছে। রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্পকারখানা সরিয়ে নেওয়ার কারণে রফতানিতে তার কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন এ খাতের শিল্পমালিকেরা। এদিকে পাট ও পাটপণ্য রফতানি থেকে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আয় হয়েছে ১০২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ১৫ কোটি ডলারের কাঁচা পাট, ৬৪ কোটি ডলারের পাটের সুতা, ১২ কোটি ডলারের পাটের বস্তা ও ৬ কোটি ডলারের অন্যান্য পাটপণ্য রফতানি হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৭ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৬৭ কোটি ডলার কৃষিজাত পণ্য, ৫০ কোটি ডলারের হিমায়িত খাদ্য ও ৩৫ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য রফতানি হয়েছে।
রফতানি বৃদ্ধির পদক্ষেপ:
১. রফতানি বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ সরকার বিভিন্ন সময় গ্রহণ করেছে। উদ্যোগগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন সরকার প্রধান উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশে নিয়ে আসার। বেসরকারি ব্যাংকের মালিকগণ এ উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা করছেন। ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার দাবি বিনিয়োগকারীদের অনেক দিনের। রফতানি বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকের সুদের হার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা জরুরি।
২. রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে নতুন নতুন খাতকে আমাদের বেছে নিতে হবে। এখন শুধু তৈরি পোশাক শিক্ষা আমাদের বড় খাত। নতুন বিনিয়োগে আইটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আইটি খাত থেকে সহজে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারি। এই ক্ষেত্রে যোগ্য জনশক্তি তৈরি প্রধানতম সমস্যা। দেশে আইটি শিক্ষাকে উপজেলা পর্যায়ে স¤প্রসারিত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা আইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ডিগ্রি বা মাস্টার ডিগ্রি পাস করার চেয়ে আইটিতে ট্রেনিং জরুরি। এই খাতের জন্য তাই উপজেলা পর্যায়ে আইটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করে এসএসসি ও আইটিএসসি পাস ছাত্রছাত্রীদেরকে আইটি শিক্ষা উৎসাহিত করতে হবে। তাতে আইটি খাত স¤প্রসারিত হবে, নতুন নতুন দক্ষ আইটি কর্মী তৈরি হবে। যারা দেশের বিদেশি দক্ষ কর্মী হিসাবে কাজ করতে পারবে।
৩. চামড়া ও পাট শিল্পকে আমাদের আরও বেশি স¤প্রসারিত ও আধুনিক করতে হবে। এই দুই খাতের কাঁচামাল আমাদের দেশে রয়েছে। শুধু প্রযুক্তি খাতকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে এই দুই খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। এই দুই খাতের বিনিয়োগকারীদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী ২০ বছর এই খাতে করমুক্তি নিশ্চিত করা উচিত। তাতে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসবে ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। রফতানিও বৃদ্ধি পাবে।
৪. রফতানি বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বস্তরে শিক্ষাকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। যাতে শিক্ষা খাতে মেধাবী দক্ষ তরুণগণ এগিয়ে আসে তার জন্য শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি ছাড়া মানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে না। বিদেশে যে সকল ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করে তাদের শিক্ষা জীবন শেষে দেশে ফিরিয়ে এনে সঠিক বেতন-ভাতা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক ও মানসম্পন্ন চাকরি নিশ্চিত করতে পারলে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীগণ দেশে ফিরে আসবে। দেশে ফিরে আসলে দেশের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখতে পারবে। দক্ষ জনশক্তির অভাবে আজ আমাদের দেশে জনশক্তি নিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা ভারত নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দক্ষ জনশক্তি থাকলে ভারত এইভাবে আমাদের অর্থ নেয়ার সুযোগ পেতো না। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরি আমাদের মূল বিষয়। তৈরি পোশাক শিল্প, বস্ত্র শিল্প, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নিয়োজিত। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা খাতের উন্নতি করা ছাড়া কোন বিকল্প নাই। সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দ এখন শিক্ষা খাতে দিতে হবে। জাতীয় রফতানি আয় বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা খাতের উন্নয়নের কোন বিকল্প নাই।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি



 

Show all comments
  • md. Alauddin dewan ২৮ জুলাই, ২০১৮, ৯:০২ এএম says : 0
    very nice.Thank you
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পোশাক

২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন