Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যেভাবে মাছ চাষ করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ চাষের উপযুক্ত জলাশয় থাকা সত্তে¡ও সেগুলোতে বছরে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয় তা আহামরি কিছু নয়। অথচ প্রতিটি জলাশয় থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপাদন করা সম্ভব, যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগুলোর পরিচর্যা করে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যেত। গোটা দেশে প্রায় ৪৫ লক্ষ হেক্টর জলাভ‚মি আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ জলাভ‚মি পড়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, যশোর, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের জলাভ‚মিতে বছরে প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০০০-১৫০০ কিলোগ্রাম মাছ উৎপাদন সম্ভব। অথচ উপযুক্ত পরিচর্যা রক্ষাণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে প্রতি হেক্টরে মাছের উৎপাদন বছরে ১০০-৩০০ কিলোগ্রাম।
পরিচালনার জন্য বিলের শ্রেণি বিভাজন: প্রতিটি বিলেরই পারিপার্শ্বিক নানা কারণে স^তন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই সবরকম বিলের একই পরিচালন পদ্ধতি নির্ণয় করা কঠিন। মাছ চাষের জন্য বিলগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) যেসব বিল শুধু বর্ষাকালে নদীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। (২) যে বিলগুলো সারা বছর নদীর সঙ্গে যুক্ত। (৩) যেসব বিল নদীর সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পরিচালনার সুবিধার্থে আকারগতভাবে বিলগুলোকে আরো কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- (ক) খুব ছোট- ২০ হেক্টরের কম। (খ) ছোট- ২০-৯৯ হেক্টর। (গ) মাঝারি- ১০০-৪৯৯ হেক্টর। (ঘ) বড়- ৫০০ হেক্টরের অধিক।
পরিচালনার প্রকারভেদ: পরিচালনার সুবিধার্থে আকার এবং প্রকারগতভাবে বিলগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আছে মাছে প্রকল্প গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রকারের মাছের চাষ। এ বিভাজন পরিচালকরা নিজেদের সুবিধামত করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে অধিকাংশ বড় আকারের মুক্ত বিল থেকে স^াভাবিকভাবে জাত মাছকে তাদের স^াভাবিক বাসস্থান থেকে ধরা হয়। এ মাছ সংরক্ষণের এবং সদ্ব্যবহারের স¤পূর্ণ দায়িত্ব বিল পরিচালকদের। মাছ ছেড়ে এবং তাদের বাসস্থানের সংরক্ষণের মাধ্যমে এ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়।
বাসস্থান সংরক্ষণ: নিম্নলিখিত উপায়ে মাছের বাসস্থান সংরক্ষণ করা যায়। (ক) উপযুক্ত উপায়ে জলজ কচুরিপানা বা অন্যান্য আবর্জনা পরিষ্কার বা দমন করা। (খ) বিলের সংযোগকারী নালা এবং অন্যান্য সংকীর্ণ স্থানে জমা পলিমাটি পরিষ্কার করা। (গ) পানির বহির্গমন যথাসম্ভব রোধ করে গরম কালে বিলে পানির পরিমাণ ঠিক রাখা এবং জলীয় দূষণ রোধ করা।
সঞ্চিত মাছের সংরক্ষণ: নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। (ক) বড় মাছের পোনাগুলোকে বিল থেকে নদীতে এবং নদী থেকে বিলে অনায়াসে যাতায়াতের সুযোগ দেয়া। (খ) বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছের উৎপাদন স্থান নির্ণয় এবং তার সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। (গ) নিম্নে বর্ণিত উপায়ে মাছের পোনা এবং ছোট আকারের মাছের সংরক্ষণ করা যায়।
(১) বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুপত্বপূর্ণ মাছ ধরার ব্যাপারে বিধিনিষেধগুলো যথাযথভাবে পালন করা। (২) মাছের উৎপাদন সর্বাধিক করার জন্য বা প্রয়োজনাতিরিক্ত মাছ মারা রোধ করার জন্য মাছ শিকার বাড়ানো বা কমানো। (৩) মাছ উৎপাদন পদ্ধতি সফল করার জন্য বর্ষাকালে ফিশিং হলিডে মেনে চলা। (৪) ক্ষতিকারক মাছ মারার পদ্ধতি যেমন মশারি জালের ব্যবহার, পানি সিঞ্চন এবং বিষ প্রয়োগ করে মাছ মারা বন্ধ করা। (৫) কিছু কিছু মাছের ওভার ফিশিং রোধ করার জন্য মাছ ধরার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন করা।
মাছ চাষ স¤প্রসারণ: বর্তমানে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবং মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদে দেখা গেছে যে প্রকল্প গ্রহণ উপায়ে মীনক্ষেত্র পরিচালনা উপযুক্ত নয়। বিলে বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্রণের উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। এ পদ্ধতি মাছের প্রকল্প গ্রহণ এবং নিবিড় মাছ চাষের মধ্যবর্তী উপায়। বিলে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি সমূহ নিম্নরূপ-
মৎস্য প্রজাতি স¤প্রসারণ: এ পদ্ধতিতে ব— মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অধিক এবং দ্রæত বৃদ্ধি পায় সে জাতীয় মাছ বিলে ছাড়া হয়। প্রজাতি স¤প্রসারণের মূল উদ্দেশ্য: নতুন প্রজাতি বিলে ছেড়ে মীন ক্ষেত্রের স¤প্রসারণ। ২) মাছহীন জলাশয়ে মাছের প্রসার। ৩) মাছখাদ্যের যথাযথ সদ্ব্যবহার।
যেসমস্ত মুক্ত বা অপেক্ষাকৃত বড় বিলে নিয়মিতভাবে মাছ ছাড়া সম্ভব নয়, সেসব বিলের প্রজাতি স¤প্রসারণ করা যায়। যেসব ব— দেশীয় মাছ শামুক জাতীয় জীব খায় এবং যেসব বড় দেশীয় মাছ পানির উদ্ভিদ খায়, সেগুলো অন্য জলাশয় থেকে এনে বিলে ছাড়া যায়। এতে পানির মাছের খাদ্যের সদ্ব্যবহার হয়। গ্রাস, সিলভার, কমনকার্প, প্রভৃতি বিদেশাগত মাছ মুক্ত বিলে না ছাড়াই ভালো। কারণ তারা অনায়াসে নদীতে চলে যেতে পারে। তদুপরি, এ জাতীয় মাছ দেশীয় মাছ বা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক।
স্টক বৃদ্ধি: বিলে বর্তমান মৎস্য খাদ্যের সদ্ব্যবহার করে কিছু কিছু নির্বাচিত তথা বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রæত বৃদ্ধিকারক মাছের স্টক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতে অপেক্ষাকৃত গৌণ মাছের বৃদ্ধি হ্রাস পাবে। অতিরিক্ত মাছ ধরা ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ বিলেই বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মাছের স^াভাবিক স্টক কমে গেছে। এসব বিলে মাছ উৎপাদন বাড়াতে হলে নির্বাচিত মাছের ফিঙ্গারলিংগ নিয়মিতভাবে স্টক করতে হবে। আজকাল দেশের অনেক ছোট ছোট বন্ধ বিলে খুব সাফল্যের সঙ্গে মাছের চাষ হচ্ছে। এসব বিলে মাছ উৎপাদন কৃত্রিম স্টকিং- এর উপরই নির্ভর করে। পরিচালিত বিলে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিয়মিতভাবে কাতলা, রুই, মৃগেল ইত্যাদি কার্প জাতীয় মাছ ছাড়া হয়। বিলে মাছ চাষের সফলতা মূলত প্রজাতি নির্বাচন, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে স্টকিং- এর হার, স্টকিং- এর ঘনত্ব, স্টকিং- এর সময় মাছের আকার, মাছ ধরার সময় মাছের আকার, সঠিক পরিচালন এবং মাছ ধরার সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
উর্বরতা সাধন: যেহেতু অধিকাংশ বিলেই প্রচুর পরিমাণে জৈবিক পদার্থ থাকে এবং আশপাশের বাহিত পানি থেকে প্রচুর পুষ্টি পায়, সেজন্য এ জাতীয় বিলে বাড়তি সার দেয়ার দরকার হয় না। তবে বিলের তলদেশে চুন দেয়া যেতে পারে। তবে বেশি ঘনত্বে মাছ স্টক করলে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাড়তি সার দেয়া দরকার। ব্যয় বাহুল্যতার জন্য শুধু ছোট ছোট বদ্ধ বিলেই সার প্রয়োগ করা হয়। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রে এবং পশুপালন ক্ষেত্রের বর্জিত জলরাশি বিলে ছেড়ে উর্বরতা সাধন করা যেতে পারে। এতে খরচ অনেক কম পড়বে।
পরিবেশ সংরক্ষণ: নির্মাণ, মাছের প্রজনন, খাদ্যসম্ভার, আশ্রয়স্থল, বাসস্থান ইত্যাদির উন্নতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজন। বিলের পরিবেশ সাধারণত ঝোঁপে তৈরি করা হয়। ঝোঁপগুলো মূলত মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভাসমান জলীয় উদ্ভিদকে বাঁশ দ্বারা বেষ্টনী তৈরি করে ঝোঁপ বানানো হয়। তলদেশে বাঁশ পুতে এ বেষ্টনীকে স্থির রাখা হয়। বর্ষার শেষে এ বেষ্টনী তৈরি করা হয় এবং শীতকালে মাছ ধরা হয়।
অবাঞ্ছিত মাছ সরানো: বিলের সঞ্চিত মাছের বৃদ্ধির জন্য এবং তাদের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য বিলে থাকা অবাঞ্ছিত মাছগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। অবশ্য বড় আকারের বিলে এ কাজ খুব কষ্টকর। বিলের তীরে এবং নৌকায় ব্যবহার্য উপযুক্ত সাইজের জাল দিয়ে, বড়শি এবং ট্রেপ দ্বারা মাছ মেরে এ অবাঞ্ছিত মাছের সংখ্যা কমানো যায়।
বাসস্থানের রূপান্তর: কিছু কিছু বিলের কিনারের অংশ সুবিধামত কেটে ডোবা তৈরি করা যেতে পারে। পরে ওই ডোবায় কার্প জাতীয় মাছের বাচ্চা পালন করে বিলে স্টক করা যায়। বাচ্চা পালন শেষ হলে ডোবায় নিবিড় বা অর্ধ নিবিড়ভাবে মাছের চাষ করা যায়।
আবেষ্টনীতে মাছের চাষ: গ্রহণমূলক মাছ চাষের সঙ্গে সঙ্গে বিলে পেন এবং আবেষ্টনী নির্মাণ করে মাছ চাষ করা যায়। পেন তৈরি করতে বাঁশ দিয়ে পাটা বানিয়ে জলাশয়ের চারিদিকে বসিয়ে দিতে হবে। এ আবেষ্টনীতে কার্প জাতীয় মাছ কিংবা চিংড়ি পালন করলে প্রভ‚ত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
মাছ পালন: এ জাতীয় মাছ চাষে ডোবা বা পুকুরের চাষের পদ্ধতি যেমন, স্টকিং সার প্রয়োগ, অবাঞ্ছিত মাছের অপসারণ, মাটি ও পানির গুণাগুণ নির্ণয়, খাবার প্রদান, স^াস্থ্য রক্ষা ইত্যাদি অবলম্বন করা হয়। অর্ধ নিবিড় বা নিবিড়ভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ছোট এবং বন্ধ বিলই উপযুক্ত। এ জাতীয় চাষের ক্ষেত্রে বিলের পরিবেশের উপর প্রভাব এবং লাভ-লোকসানের হার ইত্যাদি খুব গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরর‹ার (স^র্ণপদক ১ম) প্রাপ্ত।



 

Show all comments
  • rakib ২৯ এপ্রিল, ২০২০, ৪:২০ পিএম says : 0
    আমার পুকুরের পানি কালো তাই করনীয় কি
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাছ চাষ

২৩ জুলাই, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
২০ জানুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন