পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষত আমিষের চাহিদা মেটাতে মৎস্য সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমকালীন বিশ্ব প্রায় সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ও চাহিদার কারণে সবক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। নতুন প্রযুক্তির বিকাশ অনেক প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি দিয়েছে। কিন্তু এসব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের অভাবে বিকাশশীল দেশগুলোর মধ্যে আমরা এখনো অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। এ দেশে আগের তুলনায় মৎস্যচাষ বৃদ্ধি পেলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেশের সব জলা ভূমিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা গেলে মৎস্য সম্পদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সারা বিশ্বের উৎপাদন কৌশল এখন বাণিজ্যভিত্তিক। কম শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জন এর মূল লক্ষ্য। মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই। বিশ্বের সব দেশে এখন আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নত জাতের মাছচাষ হচ্ছে। গড়ে উঠছে উন্নত মৎস্য খামার।
কৃত্রিম প্রজনন মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের মৎস্যচাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রজননের মাধ্যমে সরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে। পুষ্টিহীনতা দূর করতে বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদিত হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ ব্যপারে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি জনগণকে উদ্যোগী হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে আরো বেশি করে মৎস্য খামার যা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে। এমনি একটি প্রযুক্তির নাম ‘পতিত পুকুরে মৎস্য চাষ’ যা আমাদের দারিদ্র মোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রযুক্তি যেমন সহজ তেমনি দরিদ্র জনগণের জন্য উপযোগী। এ দেশের বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবী এবং গ্রামে বাস করে। মৎস্যচাষ এসব গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক আয় রোজগারের একটি অংশ। প্রতি বাড়ির আনাচে-কানাচে পতিত পুকুরে মৎস্য চাষ করা যায়। মৎস্য চাষে যে মন-মানসিকতা প্রয়োজন এ দেশের মানুষের তা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু এদের পরিকল্পিত উপায়ে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধ করা।
মৎস্যচাষ প্রযুক্তি অত্যন্ত সহজ। এর সাহায্যে আমাদের দেশের শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোকজন স্বাবলম্বী হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মৎস্য চাষের জন্য প্রয়োজন উন্নত জাতের বা রোগমুক্ত পোনা যা দ্রুত বাড়তে পারে। কিছু নিয়ম অনুসরণের মাধ্যমে মাছের পোনা কয়েক মাসের মধ্যে দ্রুত বাড়তে পারে।
জমিতে আগাছা থাকলে যেমন ফসল ভালো হয় না তেমনি পুকুরে গুঁড়ো ও রাক্ষুসে মাছ থাকলে ফলন ভালো হয় না। রাক্ষুসে মাছ হলো শোল, গজার, টাকি প্রভৃতি। এরা মাছের বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তাই মাছ চাষের শুরুতে পুকুরের সব পানি শুকিয়ে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করতে হবে। তলায় বেশি কাদা থাকলে তা তুলে মেরামত করা যেতে পারে। বড় গাছের ছায়া পুকুরে পড়লে ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। পুকুরের গভীরতা এমন হতে হবে যাতে শুকনো মৌসুমে অন্তত সাড়ে তিন হাত পানি থাকে। প্রথম অবস্থায় পুকুরে চুন দিতে হবে। প্রথমে একটি পাত্রে চুন ফুটিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলে পানিমিশ্রিত চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুনের মাত্রা প্রতি শতাংশে এক কেজি, পুকুরে চুন দেবার পাঁচদিন পর সার দিতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক উভয় ধরনের সার পুকুরে দেয়া দরকার। জৈব সার হিসেবে গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা দেয়া যায়। প্রতি শতাংশে এসব সারের মাত্রা ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ৬৫ গ্রাম এবং এমপি ২০ গ্রাম। জৈব ও রাসায়নিক এ দু’ধরনের সার এক সঙ্গে একটি পাত্রে পানির মধ্যে ভালভাবে গুলে নিতে হবে। তারপর এ সার সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর তৈরি হবার ১০-১৫ দিন পর ১০-১৫ সেন্টিমিটার সাইজের সুস্থ ও সবল পোনা ছাড়তে হবে। পুকুরের বিভিন্ন গভীরতায় ভিন্ন ভিন্ন গভীরতায় খাবার খায়। এ জন্য বেশি উৎপাদন পেতে হলে পুকুরে একসঙ্গে ৭-৮ ধরনের মাছ ছাড়তে হয়। বিভিন্ন ধরণের পোনার আকার সমান হলে ভালো হয়। শুধু প্রাকৃতিক খাবারে মাছের ফলন ভালো হয় না। এজন্য পোনা ছাড়ার পরদিন থেকে খাবার দিতে হবে। মাছের মোট ওজনের শতকরা ২ ভাগ হারে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে। যেমন পুকুরে বিভিন্ন মাছের মোট ওজন যদি ১০০ কেজি হয় তবে প্রতিদিন মাছের খাবার দিতে হবে ২ কেজি। যে পরিমাণ খাবার দিতে হবে তার অর্ধেক হবে কুড়ো এবং বাকি অর্ধেক হবে সরিষার খৈল ও চালের কুড়ো একটি হাঁড়িতে এক রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন সকালে খৈল ও কুড়ো দিয়ে গোল বল বানাতে হবে। খাবার দেবার পূর্বে পুকুরের চার কোনায় চারটি হাঁড়ি বসিয়ে নিতে হবে। এ হাঁড়িগুলোর মুখ বড় হওয়া দরকার। হাঁড়িগুলো পানিতে এক মিটার (২ হাত) নিচে রাখলে ভালো হয়।
প্রতি বছরের মতো এবার বর্ষা মৌসুমে নদ-নদীর উপচে পড়া এবং অতি বৃষ্টিতে জমা পানিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠ-ঘাট জলাবদ্ধতার রূপ নিয়েছে। বর্ষা চলে যাবার পরে এ সমস্ত স্থানে ৪/৫ মাস কিছু কিছু জায়গায় প্রায় বছর ধরে পানিবদ্ধ থাকে। তাই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে এ জলার উপযুক্ত ব্যবহার তথা মাছ চাষ করেও আর্থিক সঙ্গতি লাভ করা সম্ভব। ইতিপূর্বে এ জাতীয় বিল থেকে রুই জাতীয় মাছ ছাড়াও চিতল, বোয়াল, ফলি, পাবদা, রয়না, বাঁশপাতা, মলা, ঢেলা ইত্যাদি মাছ এবং প্রচুর পরিমাণে মাগুর, কৈ, শিংসহ প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ উৎপন্ন হলেও বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব এবং কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য তা শূন্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে সুষ্ঠুভাবে মাছচাষ করে বিশাল এ পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ২২ ভাগ উৎপাদন সম্ভব এবং প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। বিলে সাধারণত স্থানীয় মালিকানা এবং সরকারের খাস জমি বিদ্যমান থাকে। সে কারণে সরকার স্থানীয় বেকার যুবক ও দরিদ্র ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দল গঠন করে এবং তাদের প্রশিক্ষণ আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে মাছ চাষ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
বন্যাকবলিত এলাকায় মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যায়। বড় বড় বিলের কিছু এলাকা নিয়ে বাঁশ, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি দিয়ে মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল সৃষ্টি করে তার চারপাশে বেড়া বা জাল দিয়ে পেন তৈরি করা যায়। এরপর রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ সরিয়ে ৫/৮ ইঞ্চি পরিমাপের পোনা প্রতি শতাংশে ২২০টি রুই ও রুইজাতীয় ছাড়া যায়। এ পদ্ধতির মাছচাষের ক্ষেত্রে পোনার দেহের মোট ওজনের ৩ ভাগ হারে খৈল, ভুসি, কুড়ো প্রভৃতির সমন্বয়ে খাবার প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে।
প্লাবিত জলাশয়ের গভীর স্থানে খাঁচা তৈরি করে মাছ উৎপাদন করা যায় তবে এ পদ্ধতিতে তেলাপিয়া বা নাইলোটিকার চাষ করলে কম খরচে অধিক উৎপাদন আশা করা যায়। কাঠা বা কমর তৈরির মাধ্যমে গাছপালার ডাল দিয়ে মাছের আবাসস্থল তৈরি করে দিতে হয়। পশুর ভুঁড়ি এবং তার বর্জ্য অংশ দিয়ে কাঠা দিলে মাছগুলো আশ্রয় ও খাদ্যের আশায় এখানে একত্রিত হয়। এছাড়া গাছপালার ঝাঁক থেকে সৃষ্ট শ্যাওলা খেয়ে মাছ বড় হতে থাকে। প্রতি তিন মাস পর পর ঝাঁক তুলে বড় মাছগুলো বাজারজাত করলে আর্থিক লাভ হয় বেশি।
অপেক্ষাকৃত নিচু জমির পাড় দিয়ে জমিতে পানি ঢোকানোর পর পাড় মেরামত করে ধানের সঙ্গে বা মেয়াদ কালীন সময়ের জন্য ধানী জমিতে মাছ চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি শতাংশ জলাশয়ের জন্য ৩০টি সরপুটি, ২০টি কমন কার্প হিসেবে পোনা ছাড়তে হয়। মাছের মল সার হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় এ জমিতে ধানের ফলন বেশি হয়। এ পন্থা অবলম্বন করার পর মাছচাষে পোনা মজুত হতে ৩-৪ মাস অতিবাহিত হলে বড় মাছগুলো তুলে নেয়া যায়। সাধারণত ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের অর্থাৎ স্থানীয় ভাষায় হোটেল সাইজ’ মাছ তুলে দিয়ে নতুন করে ২০ ভাগ অধিক হারে পোনা ছাড়তে হয়। এ পদ্ধতিতে আর্থিক লাভ অপেক্ষাকৃত বেশি হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।