Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুতেরেস ও কিমের গুরুত্বপূর্ণ সফর

| প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

মিয়ানমারের সেনা ও বৌদ্ধ জঙ্গীদের নির্বিচার হত্যা ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে ও বুঝতে এবং বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং কিমের বাংলাদেশ সফর নি:সন্দেহ একটি উল্লেখযোগ্য বড় ঘটনা। তারা গত শনিবার ঢাকা আসেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের আগে দু’জনই গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। এ সম্পর্কে জাতিসংঘের মুখপাত্র তার টুইট বার্তায় বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এই সংকট মেটানোর দায় বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। জটিল এ সমস্যার সমাধান দুই সংস্থার নিবিড় সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন। তারা বলেছেন, ‘আমাদের দুই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জীবনের উন্নতি ঘটানো। পাশাপাশি তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পথ করে দিতে সেখানে সহায়ক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।’ তাদের সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন গুতেরেস ও কিম। জাতিসংঘের মহাসচিব ও প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছি। আমাদের এই চাপ আরো বাড়াতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে কি করা উচিৎ, তা মিয়ানমার বুঝতে পারে।’
হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে বর্তমান রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সূত্রপাত হয় ১৯৭৭ সালে। সেই থেকে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু ফিরেও গেছে। তবে আসা কখনোই বন্ধ হয়নি। গত বছর রোহিঙ্গাদের আগমন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা এখনো কমবেশী অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় এ পর্যন্ত ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমত, বাংলাদেশ কোনো ধনী দেশ নয়; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এমনিতেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার একটি দেশ। তার পক্ষে এত অতিরিক্ত লোককে ভরন-পোষণ দেয়া, নিরাপত্তা দেয়া, তাদের জীবনের উন্নয়ন সাধন করা অসম্ভব। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে ওই অঞ্চলের পরিবেশ, আইনশৃংখলা ও সামাজিক অবস্থার ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে সেটাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। তবে আমরা এটুকু ভেবে আশ্বস্ত হই যে, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তারা সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং বন্ধু দেশগুলো এই সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখার পূর্বাপর আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা, আন্তর্জাতিক রেডক্রসসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানিনিকাষ, দুর্যোগমোকাবিলা ও সামাজিক সুরক্ষায় এই অনুদান ব্যয় করা হবে। বলা আবশ্যক আন্তর্জাতিক সাহায্য বস্তুত সবই মানবিক সাহায্য। এই মানবিক সাহায্য বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ কতদিন দিয়ে যাবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রয়োজনের তুলনায় প্রাপ্ত সাহায্য যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে সাহায্যের পরিমাণ কমে গেলে আশ্রিত রোহিঙ্গারাই বিপদে পড়বে না, বাংলাদেশও বিপাকে পড়বে। এ জন্যই রোহিঙ্গা সমস্যার ত্বরিত ও স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ তেমন কিছু হচ্ছে না। জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী দেশগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেয়নি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় রকমের উদ্বেগের বিষয়। কারণ, সমস্যাটা এমন যা বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। যেহেতু এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, সুতারাং আন্তর্জাতিক উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যকই শুধু নয়, জরুরিও বটে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। মিয়ানমারই তাদের হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এর সমাধানও তাই রয়েছে মিয়ানমারেরই হাতে। তাদের ফেরৎ নিলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। অত্যন্ত দুর্ভাগজনক বাস্তবতা এই যে, মিয়ানমার তাদের ফেরৎ নিতে মোটেই আগ্রহ প্রদর্শন করছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে তার একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সে চুক্তির বাস্তবায়ন করছেনা। নানা টালবাহানা করে চুক্তি বাস্তবায়ন আটকে রেখেছে। চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে বাধ্য করার কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশের হাতে নেই। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই সেটা করতে পারে। জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের একটি গোপন চুক্তি হয়েছে। রয়টারসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও নিজেদের পছন্দ অনুসারে ফেরৎ পাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে চুক্তিতে। তবে ফেরৎ যাওয়ারা সেখানকার নাগরিকত্ব পাবে কিনা কিংবা দেশজুড়ে অবাধ চলাচলের সুযোগ পাবে কিনা সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা নেই। বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব খারিজ করা এবং সে দেশে তাদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা হরণ করা। নাগরিকত্ব নেই বলে রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক কোনো অধিকারও তাদের নেই। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক অধিকার এবং নিরাপত্তা দিলেই সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান হতে পারে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। চীন মিয়ানমারের প্রধান মিত্র হওয়ায় এ ব্যাপারে তার সহযোগিতা হতে পারে অধিকতর ফলপ্রসূ। চীন বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে সহযোগিতা করার। আন্তর্জাতিক উদ্যোগ-পদক্ষেপের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করা হলে সমাধান দ্রæতায়িত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমারের


আরও
আরও পড়ুন