চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং তীর দ্বারা ভাগ্য-নির্ধারণ শয়তানের অপবিত্র কর্ম। অতএব, তোমরা এসব থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে শত্রæতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। তবুও কি তোমরা তা থেকে নিবৃত্ত হবে না? (সূরা মায়িদা-৯০,৯১) মদের ব্যাপারে এটি কোরআনের সর্বশেষ চূড়ান্ত আয়াত। এর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য মদকে চিরতরে হারাম করা হয়েছে। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর মদিনাতে এ পরিমাণ মদ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, পথ-ঘাট ছিল বৃষ্টির পানির মতো সিক্ত। মদের মটকাগুলো ভেঙ্গে ফেলা হল। যেসব পাত্রে মদ তৈরি করা হত নবীজি (সা.) সেসব পাত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেন। এমন কি বাহিরদেশ কোনো কাফেলা বা প্রতিনিধি মদিনায় এলে তাদেরকেও ওইসব পাত্র ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিতেন। মদপান থেকে মানুষকে বিরত রাখতে অসংখ্য হাদিসে নবীজি (সা.) এর ভয়াবহ পরিণতির কথা ব্যক্ত করেছেন। একটি হাদিসে তিনি বলেন, শরাব এবং ঈমান একত্রিত হতে পারে না। অর্থাৎ মদপান অবস্থায় মানুষের ঈমান থাকে না। (নাসায়ি শরিফ: ৭১২৬) মদপান করা মূর্তিপুঁজা সমতুল্য অপরাধ। এ ব্যাপারে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নিয়মিত মদ্যপানকারী মূর্তিপুজারীর ন্যায়।’ (ইবনে মাজাহ:২৮৭৬) আরেকটি হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদপান করে আল্লাহ তায়ালা চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন। এ অবস্থায় সে মারা গেলে কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। তবে তওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। কিন্তু যে ব্যক্তি পূনঃপূন পান কররে আল্লাহ তাকে ‘তীনে খাবাল’ (জাহান্নামীদের গলিত) পুঁজ পান করাবেন। (ইতহাফ: ৩৭৮৭) অন্য বর্ণনায় হাদিসটি এভাবে এসেছে-‘আল্লাহ পাক মদপানকারীর নামাজ, রোজা, হজ্জ ও উমরা কবুল করবেন না যতক্ষণ না সে তওবা করবে। আর সে তওবা ব্যতীত মারা গেলে আল্লাহ তাকে দুনিয়ার প্রত্যেক ঢোক শরাবের পরিবতে জাহান্নামের পুঁজ পান করাবেন। জেনো রেখো, প্রত্যেক নেশাজাতীয় বস্তু শরাব আর প্রত্যেক নেশাকর বস্তুই হারাম।’ (ইতহাফ:১৫৪৩) তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন ভ্র“ক্ষেপ করবেন না। তারা হচ্ছে-পিতা-মাতার অবাধ্যতাকারী, নিয়মিত মদপানকারী এবং যে ব্যক্তি দান করে তা বলে বেড়ায়।’ (মুস্তাদরাক:৭২৩৫)
মাদকের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণি লোকের প্রতি নবীজি (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। তারা হচ্ছেÑ ১. যে মদ নিংড়ায় ২. প্রস্তুত কারক ৩. পানকারী ৪.পরিবেশনকারী ৫. আমদানিকারক ৬. যার জন্যে আমদানি করা হয় ৭.বিক্রেতা ৮. ক্রেতা ৯. সরবরাহকারী ১০. লভ্যাংশ্যভোগকারী। (আবু দাউদ) মদের অপকর্মগুলোকে নবীজি (সা.) সংক্ষিপ্ত কথায় ব্যক্ত করেছেন এভাবে- ‘আলখামরু উম্মুল খাবায়িসি’ অর্থাৎ ‘মদ হচ্ছে সকল পাপের জননী।’
মদ যে সমস্ত জগন্য অপরাধের মূল তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় শিরোনাম হচ্ছে- ‘মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে মা খুন’। ‘মাদকের টাকার জন্য বাবাকে ছুরিকাঘাত।’ নেশাখোর স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন।’ ‘নেশার টাকা যোগার করতে না পারায় শিশুসন্তান বিক্রি।’ ইত্যাদি।
বর্তমানে অধিকাংশ খুন-ধর্ষণের পেছনে রয়েছে মাদকের নেশা। শারাবখানাগুলো ব্যভিচারের আখড়া। জনৈক জার্মান ডাক্তার বলেছেন, ‘যদি অর্ধেক শরাবখানা বন্ধ করে দেয়া হয়, তবে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, দেশের অর্ধেক হাসপাতাল ও জেলখানা আপনা থেকেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে।’ মাদকের বহুমুখী অপরাধের কারণেই স¤প্রতি মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন র্যাব প্রশাসন। এটি প্রশংসাযোগ্য। আবার উদ্বেগেরও বিষয়। কারণ, ক্ষমতা ও টাকার হাতবদলে বদলে যায় অনেক কিছু। প্রকৃত অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাওয়া এবং নিরপরাধ লোক হয়রানির শিকার হওয়া-ই উদ্বেগের কারণ। সহিহ বোখারির বর্ণনায় রয়েছে- একবার মাখজুমিয়া গোত্রের জনৈক মহিলাকে চুরির অপরাধে নবীজি (সা.) হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। সেই মহিলা ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়ার কারণে তার শাস্তি রহিত করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে আবেদন করা হলো। তাতে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি এই কারণে ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোনো সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করলে তার শাস্তি রহিত করা হতো। আর দুর্বল, অসহায় লোকের বেলায় শাস্তি কার্যকর করা হতো। শোন, মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (বোখারি শরিফ: ৩৪৭৫)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদপান করে তাকে বেত্রাঘাত করো। পূনরায় পান করলে আবার বেত্রাঘাত করো। আবার পান করলে আবার বেত্রাঘাত করো। এরপরও পান করলে এবারও বেত্রাঘাত করো। তারপরও যদি পান করে তাহলে হত্যা করে ফেল। (সুনানে বায়হাকি:৩৬৯০) এখানে যদিও চতুর্থ বারের পর মদপান করার অপরাধে হত্যা করার কথা রয়েছে কিন্তু অন্য আরেকটি হাদিস দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে-জনৈক মদ্যপকে নবীজি (সা.) এর নিকট ধরে আনা হলে তিনি তাকে বেত্রাঘাত করেন। হত্যা করেন নি। অথচ সে লোক ইতোপূর্বে চার বার মদ পান করেছিল। তাই মদপানকারীকে হত্যা না করার ব্যাপারে সমস্ত আলেমের ঐক্যমত। নবীজি মদপানকারীকে কখনও বেত্রাঘাত করেছেন, কখনও জুতাপিঠা করেছেন। হযরত উমর ফারুক (রা.) এর জামানায় মদপানকারীকে ৮০টি বেত্রাঘাত করার ফায়সালা হয়। কোনো সাহাবি তার বিরুধিতা করেননি।
মাদকের বিষাক্ত ছোবল থেকে আমাদের সমাজকে বাঁচাতে শুধু মাদকব্যবসায়ী নয়,মাদকসেবীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালাতে হবে। তাদেরকে আল্লাহর ভয় ও ধর্মীয় জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করাতে হবে। শুধু ইয়াবা নয়, নেশাজাতীয় সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদন ও বেঁচাকেনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।