Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেজুর ও রোজাদারের খাবার

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলা নাম খেজুর । ইংরেজি নাম : Date Palm. বৈজ্ঞানিক নাম : Phoenix sylvestris. মহান আল্লাহ আমাদের কল্যাণের জন্য তার সমগ্র সৃষ্টি জগৎকে নিয়োজিত করেছেন। মানুষের উপকারের জন্য তিনি দিয়েছেন সবুজ বৃক্ষ, নানা বর্ণের ফুল ও ফল। আল্লাহর দেয়া অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে খেজুর অতি পরিচিত এবং সাধারণ একটি ফল। কিন্তু সাধারণ এই ফলের বর্ণনায় কুরআনে এসেছে বিশেষভাবে। এমনকি একে বেহেশতবাসীদের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন - পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘সেখানে আছে ফলমূল, খেজুর ও আনার । অতএব তোমরা উভয়ে তোমার পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (সুরা আর রাহমান)।
বর্তমান যুগের আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও খেজুর সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রাচীনতম উদ্ভিদের মধ্যে খেজুর একটি। শুধু ফল হিসেবেই নয়, পুষ্টিমানের জন্যও খেজুর আজ অগ্রগণ্য একটি ফল। বিভিন্ন গবেষণায় এর নতুন নতুন গুণাগুণ আবিস্কৃত হচ্ছে এবং ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খেজুর সম্পর্কে সুরা মারিয়ামে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রসব বেদনা তাঁকে খেজুর বৃক্ষমূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করাল। তিনি বললেন হায়! আমি যদি কোনোভাবে এর আগে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্তি হয়ে যেতাম! অত:পর ফেরেশতা তাঁকে নিম্নদিক থেকে আওয়াজ দিলেন যে, তুমি দু:খ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি নহর সৃষ্টি করেছেন। আর তুমি নিজের দিকে খেজুরগাছের কান্ডে নাড়া দাও। তা থেকে তোমার ওপর সুপক্ব খেজুর পতিত হবে। এখন আহার করো ও চক্ষু শীতল করো। (সূরা মারিয়াম) সুতরাং বুঝা যায় যে ফলের কথা কুরআন শরীফে বার বার বলা হয়েছে তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তার গুণাগুণের শেষ নেই। আল্লাহ তা’আলা কুরআন শরীফে আরো বলেন, ‘খেজুর ও আঙ্গুর ফল থেকে তোমরা সাকার ও উত্তম খাদ্য তৈরি কর। নি:সন্দেহে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা নাহল: আয়াত নং-৬৭)।
পবিত্র রমজান মাসে ইফতার ও সেহরিতে মুখরোচক অনেক খাবার বাসায় যেমন তৈরি হয় তেমনি বাজারে নানা ধরনের রকমারি খাবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর এসব খেয়ে আমাদের শুরু হয় পেটজ্বালা, বমি, পাতলা পায়খানা। পরে দেখা যায় পরদিন অনেকে রোজা রাখতে পারেন না। সাধারণত আমরা সারা দিন রোজা রাখার পরে ইফতারের সময় অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছা করে। আমরা মুখরোচক বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপসহ ভাজাপোড়াজাতীয় খাবার দ্বারা ইফতার করি। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, এসব ভাজাপোড়াজাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাসূলে কারিম সা: বলেন,‘তোমরা খেজুর দিয়ে ইফতার করো। কেননা তাতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না থাকে তাহলে পানি দিয়ে ইফতার করো। পানি পাক ও পবিত্র।’ রাসূল (সা:) ইফতারিতে শুধু খেজুর ও পানির কথা বললেন কেন? এ বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখেছেন। প্রমাণিত হয়েছে খেজুর শক্তিতে ভরপুর ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। খেজুর একটি নন্দিত ফল। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই এ ফলটি পুষ্টিকর হিসেবে বেশ সমাদৃত।
পুষ্টিগুণ : খেজুরে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শক্তি ক্যালসিয়াম, আয়রণ, পটাশিয়াম দস্তা, ফসফরাস, সালফার, মাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ভিটামিন সহ ১৮ প্রকার এমাইনো এসিড ও জিয়া জ্যানথিন বিদ্যমান। প্রতি ১০০গ্রাম খাবার উপযোগী খেজুরের খাদ্য উপাদান হলো : খাদ্যশক্তি ৩২৪ কিলো ক্যালোরি, জলীয় অংশ ১৮ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ১.৭ গ্রাম, আমিষ ২.২ গ্রাম, শর্করা ৭৭.৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৭.৯০ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৭৫৪ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৪.৭০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৫৮.৯০ মিলিগ্রাম, কপার ০.২১ মিলিগ্রাম,আয়রণ ৭.৩ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৬৩৮ মিলিগ্রাম, সালফার ৫১.৬০ মিলিগ্রাম,ক্লোরিন ২৯০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ১০.১০ মিলিগ্রাম, বি ২০.০৪ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.১৫ গ্রাম, আঁশ ৬.৭ গ্রাম। তবে এ পুষ্টিমান জাত ও জন্মানো স্থানের পার্থক্যের কারণে কিছুটা কম বেশি হতে পারে। রমজান মাসে রোজা নিয়ে অনেক খালি পেটে থাকার কারণে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। খেজুর উচ্চ মাত্রার প্রাকৃতিক সুগার শরীরকে অতি তাড়াতাড়ি শক্তি যোগান দেয়। ইফতারের সময় সকল রোজাদারের শরীরে প্রচুর গ্লুকোজের দরকার। আর এ অভাব পূরণে খেজুর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। খেজুর সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা:) বলেছেন, আজওয়া জান্নাতের ফল। এর মধ্যে বিষের নিরাময় রয়েছে। (তিরমিজি)। রাসূল (সা:)-এর প্রিয় সাহাবি সা’আদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা: বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক সা: বলেছেন যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন বিষ ও জাদু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। খেজুর সোডিয়াম মুক্ত, চর্বি মুক্ত বিশেষ করে কোলেস্টেরল মুক্ত এবং আঁশের একটি ভালো উৎস। খেজুর হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন ৫-৬ টি খেজুর খেলে প্রাত্যহিক আঁশজাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণ হয়। এটা শরীরে ১৪ শতাংশ আঁশজাতীয় খাবারের জোগান দেয়। খেজুর হার্ট ও ডায়াবেটিসের রোগীরাও ইফতারিতে খেতে পারে। খেজুরে প্রাপ্ত শর্করা দেহে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে দেহের মধ্যে শোষিত হয়। খেজুর চামড়ার সৌন্দর্য, দৃষ্টিশক্তি ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ফুসফুসের নানা রোগ প্রতিরোধ করে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খেজুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাবার। সন্তান জন্মদানের সময় নিকটবর্তী হলে নিয়মিত খেজুর খেলে সন্তান প্রসবে সহজ হয়। খেজুর খেলে জরায়ুর মাংসপেশি দ্রুত সংকোচন প্রসারণ ঘটিয়ে নিরাপদ প্রসব হতে সাহায্য করে। সন্তান জন্মদানের পর খেজুর খেলে রক্তক্ষরণ ও জরায়ুর খুবই উপকার হয়। শিশু স্বাস্থ্যের জন্য প্রায় সকল উপাদানই খেজুরে বিদ্যমান । তাই যে সব মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের জন্য খেজুর খুবই উপকারী। খেজুরে প্রচুর পরিমাণে বি-কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য ভিটামিন আছে। আমাদের উচিত খেজুরসহ ইফতারি হিসেবে রুহ্ আফজা, সিনারুজসহ ঠান্ডা পানীয়, ডাবের পানি, দেশী ফলমূল যেমন-পেঁপে, শসা, ক্ষীরা, জাম্বুরা, আনারস, আমড়া প্রভৃতি দিয়ে ইফতার করা। ঝালজাতীয় খাবার যদি না খেলেই নয় তাহলে কম ঝাল দিয়ে তৈরি বুটভুনা, পেঁয়াজু, বেগুনী, মুড়ি, পরিমিত খাওয়া যেতে পারে। চিঁড়া, মুড়ি, নারকেল, সেমাই, সুজি, পরিমাণমতো খাওয়া যেতে পারে। তাই রোগমুক্ত জীবন চান-ফল ওষুধির চাষ বাড়ান।

-ডা: মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খেজুর


আরও
আরও পড়ুন