Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যখন অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘জায়দা সিতানী’ মানে জমিদার কর্তৃক প্রজার উপর জুলুম না করার অঙ্গীকার। ‘জমিদার যখন প্রজার নিকট এই মর্মে অঙ্গীকার করতেন যে, প্রজার উপর রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে কোন অন্যায় বা জুলুম করা হবে না, তখন এ রূপ অঙ্গীকার ‘জায়দা সিতানী’ (JAIDA SITANI) নামে পরিচিত ছিল। (চৌধুরী মূনীরউদ্দিন মাহাফুজ প্রণীত ‘আইনী শব্দ মালা’ পৃষ্ঠা-৩০৯)। জমিদারী আমলে জমিদাররাই ছিল নিজ নিজ এলাকার শাসনকর্তা। মোগল/ব্রিটিশকে পত্তনী/বাৎষরিক খাজনা প্রদান করে ‘জমিদারী’ স্বীকৃতি এনে তারা প্রজাদের নিকট থেকে সুদে-আসলে খাজনা বা কর আদায় করতো।
জমিদারী প্রথার সৃষ্টি সম্পর্কে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তার ‘আমাদের জাতি স্বত্বার বিকাশ ধারা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘কৃষকদের কাছ থেকে যত খুশি খাজনা ও কর আদায় করে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য এক নতুন জমিদারশ্রেণি সৃষ্টি করা হয়। এই জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইংরেজরা বাংলা ও বিহারের নিষ্ঠুরতম দস্যু সরদারদেরকে ‘নাযিম’ নিয়োগ করে। ‘নাযিম’ নামক এই দস্যুদের অত্যাচার ও লুণ্ঠন সম্পর্কে কোম্পানির দলিলপত্র থেকেও জানা যায়। বাংলা ও বিহারের রাজস্ব কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ১৭৭২ সালের ৩ নভেম্বর ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘নাযিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে। জমিদাররাও নাযিমদের কাছ থেকে চাষীদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। নাযিমরা আবার তাদের সকলের (জমিদার ও কৃষকদের) সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন-সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে। ১৭৬৫-৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর সে বছরই তারা প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সে আদায়ের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।’
ইংরেজদের রাজস্ব-নীতি ও ভ‚মি-ব্যবস্থা সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ‘এই সকল ব্যবস্থার ফলে চাষীদের পিঠের ওপর বিভিন্ন প্রকারের পরগাছা শোষকদের একটা বিরাট পিরামিড চাপিয়ে বসে। এই পিরামিডের শীর্ষদেশে রহিল ইংরেজ বণিকরাজ, তার নীচে রহিল বিভিন্ন প্রকার উপস্বত্বভোগীর দলসহ জমিদারগোষ্ঠী। এই বিরাট পিরামিডের চাপে বাংলা ও বিহারের অসহায় কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়াল।’
জমিদারদের চাবুকের কষাঘাতে কৃষক প্রজার পিঠের চামড়া যখন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল তখন রক্তে রঞ্জিত কৃষক/প্রজার জন্য ছায়া হিসাবে প্রণীত হলো প্রজাস্বত্ব আইন এবং গঠিত হয়েছিল ঋণ শালিশী বোর্ড। জমিদারী প্রথা বিলোপের মাধ্যমে কৃষক প্রজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও অত্যাচার-নির্যাতনের হাত বদল হয়েছে মাত্র, কিন্তু সাধারণ মানুষ অত্যাচার-নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করে নাই। বাঘের মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে কুমীরের মুখে পড়েছে। শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুনরায় আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে ব্রিটিশ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সৃষ্টি হয় স্বাধীন পাকিস্তান ও পরের দিন স্বাধীন হয় ভারত। ১৯৫৬ সনের ২৩ মার্চ জনগণের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকারে পাকিস্তান একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি নতুন গণপরিষদ শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করে। ২ মার্চ গভর্ণর জেনারেল নতুন শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর দান করেন এবং ২৩ মার্চ থেকে তা বলবৎ হয়। শাসনতন্ত্রে ‘পূর্ব বাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হয়। পশ্চিমাঞ্চলের সকল প্রদেশ একীভ‚ত করে এক ইউনিটের ভিত্তিতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ নাম রাখা হয়। দুই প্রদেশের মধ্যে সংখ্যাসাম্য নীতি প্রবর্তন করা হয়। বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং যুক্তভাবে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়। সংবিধান প্রণেতারা সেদিন নাগরিকদের যে প্রতিশ্রæতি দিয়ে ছিলেন তা রক্ষা করার পরিবর্তে বার বার সে অধিকারকে পদদলিত করেছে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার স্বার্থে।
পাকিস্তানের সংবিধানে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করার ক্ষোভ থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের কার্যক্রম। গণমানুষ অধিকার বঞ্চিত হয়েই ১৯৪৭ এবং ৭১ সালে স্বাধীনতা লাভে সফল হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের অধিকারকে রক্ষা করতে কি পেরেছে?
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি গণমানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে যা ১৬ ডিসেম্বর/১৯৭২ থেকে কার্যকর হয়।
সরকার কর্তৃক সর্বশেষ মুদ্রিত (১৮ এপ্রিল ২০১৬) সংবিধানের উপক্রমনিকার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় তাহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রচিত জনগণের অধিকারের দলিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। দেশের জনগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, এই সংবিধান তাহারই অভিব্যক্তি, তাই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ প্রতিফলিত হইয়াছে। এই সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, জনগণের মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের কার্যপরিধিসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ামক দলিল। সংবিধান যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন আইন বৈধ নয় এবং এমন কোন আইন বা ইহার অংশ বিশেষ যদি সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইন বা আইনের অংশবিশেষ বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।’ এই সংবিধান যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ নামে পরিচিত সে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অনুচ্ছেদ-২৬ থেকে ৪৪ পর্যন্ত জনগণের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত প্রতিশ্রæতি বা জনগণের প্রতি রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারনামা প্রদান করেছে তার বাস্তবায়ন কি গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার করছে? নাকি নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকারকে ভুলণ্ঠিত করছে?
সংবিধান বলতে কী বুঝায়? একদিকে বলা হচ্ছে, এটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, অন্যদিকে এ আইনে স্বীকৃত গণমানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দেয়া ‘সাংবিধানিক অধিকার’ রাষ্ট্র দ্বারাই খর্ব করা হচ্ছে ‘মৌলিক অধিকার’কে পদদলিত করে। সংবিধান কী? এ সম্পর্কে মাহমুদুল ইসলাম প্রণীত Constitutional law of Bangladesh এ বলা হয়েছে, A constitution adopted through democratic process is expected to reflect the consensus of the people about their political organisation and the democratic values they cherish. Whatever may be written in a constitution, the success of democracy and realisation of the democratic values depends on a proper environment created by the actors in the political scene who must have faith and conviction in the utility and effectiveness of the rule of law and constitutionalism and must work relentlessly to establish it. In the absence of such conviction and commitment, the constitutional law may turn into what Wade and Bradley called “a transparent cover for a power-struggle that is not conducted in accordance with anything deserving the name of law. মাহমুদুল ইসলাম তার প্রণীত বই এ সংবিধানকে একটি Commitment অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন যা রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণ বা নাগরিকদের প্রতি একটি প্রতিশ্রুতি।
‘জায়দা সিতানী’ জমিদার কর্তৃক নাগরিকদের প্রতি প্রদত্ত একটি প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার যা ক্ষেত্র মতে জমিদাররা রক্ষা করেনি। ফলে জনগণ জমিদারী প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। রক্তের অক্ষরে প্রণীত ‘সংবিধান’ যেখানে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছে না সেখানে জনগণ এর প্রতিকার বা প্রতিশোধ নেবে কোন পদ্ধতিতে? অধিকার বঞ্চিত জনগণ তার শেষ আশ্রয় কোথায় খুঁজে নেবে? জনগণকেই সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অঙ্গীকার

২০ ডিসেম্বর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন