পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রকৃতির আচরণের মধ্যে বিরূপভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, নিন্মচাপ, তাপদাহ, বৃষ্টি ও বর্জ্রপাতের মধ্যে এর প্রামণ বিধৃত। গ্রীষ্মে প্রচন্ড দাবদাহের সঙ্গে ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, নিন্মচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাত হয়, হতে পারে। তবে এবার এসবের প্রকোপ অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। বৃষ্টিপাতের কথাই ধরা যাক। গত ৩৫ বছরের মধ্যে এবার এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩ মিলিমিটার। অথচ ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মিলিমিটার। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝড়, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে অন্যান্য বারের চেয়ে বেশি এবং বাড়িঘর, ফসলাদি ও বৃক্ষরাজির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় বজ্রপাতের পরিমাণও বেশী এবং এতে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের মতে, মে-জুন মাসে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় সাগরে কয়েকটি নিন্মচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা ঘনিভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¦াসের কারণ হতে পারে। সাগরতলের পানির তাপমাত্রা ও উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতেই বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¦াসের আশঙ্কা। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ সব সময়ই আশঙ্কার কারণ। এবার আশঙ্কা একটু বেশি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু সচেতনতা এবং আত্মরক্ষামূলক পর্যাপ্ত প্রস্তুুতি ও ব্যবস্থা। এ দু’য়ের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ কমানো সম্ভব হতে পারে। বিদ্যমান আলামত ও আশঙ্কার প্রেক্ষিতে সঙ্গতকারণেই উপকূলীয় এলাকার প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সবচেয়ে বেশি শংকিত ও আতংকিত হয়ে পড়েছে। ৭১৫ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা বরাবর এবং সান্নহিত এলাকায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাসই কেবল নয়, সমুদ্রবন্দর। জ্বালানিস্থাপনা, পর্যটনকেন্দ্র, লবণশিল্প, চিংড়ীঘেরসহ মৎস্যসম্পদ, প্রতিরক্ষা স্থাপনা, শিল্পকারখানা, ক্ষেত-খামার, বৃক্ষ-বনরাজিও রয়েছে। ফলে বড় রকমের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস হলে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়সহ বিপুল আর্থিক ক্ষতি সাধিত হতে পারে।
স্মরণ রাখা দরকার, ইতোপূর্বে ‘মোরা’, ‘রোয়ানু,‘সিডর’ ‘আইলা,’ ‘নার্গিস’ ইত্যাদির মতো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে ক্ষতবিক্ষত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় এলাকা। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা অনেকের মনে থাকার কথা। ওই ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের মারাত্মক ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্যোগপ্রবণ সাগর-উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলের জানমাল সুরক্ষায় আগ্রাধিকার পরিকল্পনার আওতায় অবকাঠামো উন্নয়নের একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়। ‘মোকাম্মেল কমিটি’ এ ব্যাপারে দীর্ঘ প্রতিবেদনসহ একটি সুপারিশমালা পেশ করে। সুপারিশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বহুমুখী সুবিধাসম্বলিত সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ, সহজ ও বোধগম্য আবহাওয়া সতর্কসংকেত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এনজিও কার্যক্রমের সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৭ বছরে এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস থেকে আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় উপায় হলো টেকসহ বেড়িবাঁধ ও বৃক্ষবেষ্টনী। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ‘প্রতিরক্ষা দেয়াল’ বলে অভিহিত ৮৭৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধের চিহ্ন নেই। জানা যায়, বেড়িবাঁধের অন্তত ৩৮ শতাংশের তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। ৪৪ শতাংশ বেড়িবাঁধ ভাঙ্গাচোরা ও নড়বড়ে। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করা হলেও বাঁধ স্থায়ী ও টেকসই করে নির্মাণ সম্ভব হয়নি। কাজের মহড়া হয়েছে মাত্র। অর্থের বেশির ভাগই লোপাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে উপকূল জুড়ে ‘গ্রিন বেল্ট’ বা ‘সবুজ বেষ্টনী’ গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেয়া হয়, সে উদ্যোগও কার্যকর হয়নি। যেসব এলাকায় বৃক্ষবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছিল সেসব এলাকার অধিকাংশেই সেই বৃক্ষবেষ্টনী উধাও হয়ে গেছে। ভূমিখেকো ও বৃক্ষঘাতকরা তা সাবাড় করে দিয়েছে। জানমাল রক্ষায় বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের অবস্থাও তথৈবচ। যা নির্মিত নির্মিত হয়েছে তাও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অব্যবহারযোগ্য হয়ে আছে।
উপকূলীয় এলাকার মানুষ কেন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও আতংঙ্কিত হয়ে পড়ে তা বিশদ ব্যাখার অবকাশ রাখেনা। বাংলাদেশ বর্হিবিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের দেশ হিসাবে পরিচিত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সব দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা, বাংলাদেশ তার শীর্ষে। সাগরের পানি প্রতি বছরই কিছু না কিছু স্ফীত হচ্ছে। বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের পানি আর দেড়-দু’মিটার স্ফীত হলেই বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূভাগের বিরাট অংশ তলিয়ে যাবে। অন্তত দু’কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝড়, ভূমি-বিপর্যয়, বৃষ্টি-বন্যা, বজ্রপাত ইত্যাদিও বেড়ে যাবে। এরকম একটি ভয়ংকর আশংকা সত্তে¡ও আমাদের সরকারি পর্যায়ে ও নাগরিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতার দু:খজনক অভাব পরিলক্ষিত হয়। উপকূলীয় ভূভাগ রক্ষায় ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার যে ধরনের উদ্যোগ, পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেয়ার কথা, সরকার তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং বৃক্ষবেষ্টনী গড়ে তোলার অতি জরুরি কাজটিও সরকার করতে পারেনি বা করছে না। দুর্যোগ এলে মানুষের উদ্ধার-নিরাপত্তা ও খাদ্য-সংস্থানেরও বড় কোনো প্রস্তুতি আছে বলে আমাদের জানা নেই। বলা বাহুল্য, উপকূল অরক্ষিত রেখে দেশকে সুরক্ষিত করা এবং উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অরক্ষিত উপকূল মানে অরক্ষিত দেশ। কাজেই, উপকূল সুরক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ আগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা মানবিক বিপর্যয় ও সম্পদক্ষতিই বাড়াবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।