পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিথ্যা অর্থাৎ মিথ্যা কথা (খরব), মিথ্যা প্রতিবেদন (False Report), মিথ্যা মন্তব্য (False Remark) মিথ্যা ঘোষণা (Announcement or declaration), মিথ্যা আশ্বাস (False Commitment) প্রভৃতির উপর নির্ভর করে এখন জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। পিতা-পুত্রের সাথে, স্বামী-স্ত্রীর সাথে, ছাত্র-শিক্ষকের সাথে, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে, ভাই-ভাইয়ের সাথে অনর্গল মিথ্যা বলে। এমনকি রাষ্ট্রও নাগরিকদের সাথে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, কোথাও প্রতিবেদন, কোথাও মন্তব্য, কোথাও ঘোষণার মাধ্যমে, কোথাও ইতিহাসকে রঞ্জিত, অতিরঞ্জনের মাধ্যমে। মিথ্যার কষাঘাতে সংবিধানও ক্ষত বিক্ষত। নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচারের নিশ্চয়তা সংবিধানে প্রদান করা হলেও ‘মিথ্যার’ কাছে সবকিছুই জলাঞ্জলি হচ্ছে। ‘নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন’ সংবিধান নিশ্চিত করলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন কী? আইনের শাসনের বাস্তব প্রতিফলন কী? জনগণ পাচ্ছে না আইনের শাসন বরং শাসকদের আইন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
পূর্বে মামলার ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে মিথ্যা মামলা সৃজন করে নির্দোষ লোককে ফাঁসানো হতো। এখন ভৌতিক বা কাল্পনিক ঘটনার এজাহার দায়ের করে জেলহাজত, রিমান্ড প্রভৃতি প্রদান করা হয়। পূর্বে মিথ্যা মামলার বাদী হতো সরকারের দলীয় লোকজন, এখন জেনেশুনে মিথ্যা মামলার বাদী হয় পুলিশ। জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘উপরের নির্দেশে করেছি’। মামলার সারবস্তু মিথ্যা জানার পরও সে মিথ্যা মামলায় অগনিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জেল-হাজত খাটতে হচ্ছে। ঘটনার আবর্তে প্রতিয়মান হয়, সরকারকে রক্ষা বা পুনঃ নির্বাচিত করার দায়িত্ব পুলিশের পাশাপাশি অন্যরাও নিয়ে নিয়েছেন। ইতোপূর্বে হাইকোর্ট আগাম জামিন দিলে নি¤œ আদালত হাইকোর্টের আগাম জামিনকে সম্মান জানাতো। বর্তমানে খুন/স্বর্ণচোরাচালান প্রভৃতি মামলায় নি¤œ আদালত জামিন দিলেও রাজনৈতিক মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিনপ্রাপ্ত আসামীদের জেল হাজতে নিয়ে যায়। এটা আসলে বেশি দিন হাজতে রাখার ফন্দি। জামিনের শুনানীর জন্য লম্বা তারিখ দেয়া হয়, অতঃপর জামিন নামঞ্জুর হয়। হাইকোর্ট যদি না থাকতো তবে রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে যেতো। মাদক কারবারসহ দেশে শত ধরনের ক্রাইম হচ্ছে, কিন্তু তা বন্ধ করার চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিধন করাই সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘মৌলিক মানবাধিকার’ সংবিধান বার বার নিশ্চিত করলেও তা থেকে জনগণ বঞ্চিত। এ কথা সকলেই জানেন এবং এটাও জানেন যে, জনগণ এ মর্মে অনেক ক্ষুব্ধ, তারপরও পাবলিক পারসেপশনের দিকে তারা তাকান না।
আইনের শাসনের চেয়ে শাসকের শাসন যখন বড় করে দেখা দেয় তখন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিরপেক্ষ আসনে আসীন রাষ্ট্রীয় চেয়ারগুলিও স্বৈরতন্ত্রের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে আজ সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। আদালত তার কোন কর্মকান্ড দ্বারা বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি করতে পারেন না। যেমন জামিন না মঞ্জুর হওয়ার আদেশ হওয়ার পর সইমোহরী নকল পেতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিচারপ্রার্থীর উচ্চ আদালতে যেতে বিলম্ব হয়। এ ধরনের বহু ঘটনায় বিচারপ্রার্থী হয়রানির শিকার হয়।
জাতীয় জীবনে মিডিয়ার অনেক প্রভাব রয়েছে। মিডিয়া ইচ্ছা করলে কারো ভাবমর্যাদা হিমালয়ের চূড়ায় নিতে পারে। অন্যদিকে কাউকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু পাঠক বা জনগণ চায় ঘটনার সঠিক চিত্র। অনেক ক্ষেত্রে সে প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়। বর্তমানে যার ১০টা ব্যবসা চলমান রয়েছে সে তার ব্যবসাগুলির নিরাপত্তার জন্য মিডিয়া ব্যবসাকে হাতে নিয়েছে। যে মিডিয়ার মালিক ভ‚মিদস্যুতার সাথে জড়িত সে মিডিয়ায় ভ‚মিদস্যুতার খবর ভিন্নভাবে প্রচারিত হয়। অনুরূপ ব্যাংক লুটের সাথে যারা জড়িত তাদের মালিকানাধীন মিডিয়াতে যা প্রচারিত হয় তাতে প্রকৃত ঘটনার প্রতিফলন হয় না। ফলে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয় জনগণ। মিথ্যা যখন কোন জাতিকে ঘিরে ফেলে তখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষ দ্বারা নির্যাতিত হয় সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। মিথ্যা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সত্য বলা যায় না অর্থাৎ গণতন্ত্র থাকে না। ভ‚মিদস্যুকে ভ‚মিদস্যু বলা যায় না, ব্যাংক লুটেরাকে লুটেরা বলা যায় না। কারণ দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করে।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ও জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট বাবুসোনার হত্যার রহস্য যদি তার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিকের পরকীয়া প্রেমের কাহিনীর মাধ্যমে উৎঘাটিত না হতো তবে যেভাবে মহাসড়ক বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছিল তাতে বিএনপি ও ২০ দলের উপর স্টিম রোলার চালানো সরকারের জন্য সহজতর হয়ে যেতো। প্রচার করা হচ্ছিল যে, জাপানী নাগরিক ও মাজারের খাদেম হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং যুদ্ধাপরাধী মামলার সাাক্ষী হওয়ার কারণে তাকে গুম করা হয়েছে। সে কারণেই গুমের মামলার তীর তাদের উপরে বর্ষিত হতো যারা সরকারের টার্গেট। প্রচার/অপপ্রচার এতো দ্রæতগতিতে ছড়ায় যা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং এ কারণেই মিথ্যার সাগরে জাতি নিমজ্জিত হচ্ছে। আবুল মুনসুর আহামদ প্রণীত ফুড কন্ফারেন্স নামক পুস্তকে ১২৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ‘মিথ্যা কথার প্রচার দরকার নাই। কারণ মিথ্যা কথা নিজেই প্রচারিত হয়, বিশ্বাসও তা করে সকলেই এবং খুব সহজেই। সত্য কথা কেহ বিশ্বাস করতে চায় না। সত্য কথা যদি সহজ হয় ব্যাপারটা আরো মুশকিল হয়ে যায়।’
প্রতিবাদবিহীন সমাজে মিথ্যা সহজেই বাসা বাঁধতে পারে এবং দিনে দিনে তা শিলাপাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। আমাদের সমাজের অবস্থা হয়েছে তাই। মানুষ কেন প্রতিবাদ করবে? প্রতিবাদকারীকে কেও সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, প্রকাশ্যে সমর্থন পর্যন্ত করতে চায় না। প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্যায় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বিপদে ফেলায়, গুম-খুন করে। নিয়োগকর্তার অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলে চাকরি হারাতে হয়। সত্যের পথে নেতার বিরুদ্ধাচারণ করলে পদপদবী-নমিনেশন হারাতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিচার বা মৌলিক অধিকার লংঘনের প্রতিবাদে কথা বললে রাষ্ট্রযন্ত্র কাল্পনিক ঘটনা সৃষ্টি করে জেলে ভরে রাখে এমতাবস্থায় সত্যের পিছনে দাঁড়ানোর অবস্থা কোথায়? মানুষ যখন সত্য বলতে পারে না, বা সত্য কথা শোনার বা বলার কোন পরিস্থিতি থাকে না তখনই হয় তাকে নিরব দর্শক নতুবা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েই বাঁচতে হয়। মানুষ যখন তার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করতে চায় এবং এ জন্য যখন কারো সমর্থন পাওয়া যায় না তখন হতাশা তাকে ঘিরে ফেলে।
সত্য কথা অনেক নির্মম। এটা বলা বা শোনা বা হজম করা অনেক দুরুহ ব্যাপার। অথচ মিথ্যা কথা সহজেই প্রচারিত হয় এবং বর্তমান পেক্ষাপটে এ জন্য কোন শক্র সাধারণত: সৃষ্টি হয় না। সুখের নেশায় আমরা যাই করি না কেন সবকিছুর মূলে রয়েছে ভবিষ্যত বংশধরদের শান্তিতে রেখে যাওয়ার নিশ্চয়তা। এতে আমাদের মানসিক চাহিদা থাকলেও কর্মে প্রমাণিত হচ্ছে বিপরীত চিন্তা ও চেতনা। ভবিষ্যত বংশধরকে একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে রেখে যাওয়ার সমস্ত প্রস্ততিই আমরা সমাপ্ত করেছি। সুখের নেশা প্রতি ঘরে ঢুকে গিয়েছে। অনেক ঘটনাই প্রমাণ করে যে, অভাবের তাড়নায় নয় বরং লাগামহীন অপচয় থেকে ধনীক শ্রেণী দ্বারাই নানাবিধ অপরাধ প্রবণতা প্রসারিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণও মানুষের মিথ্যার পিছনে ছুটে চলা। মিথ্যা অভিজাত্যও এক ধরনের নেশা। এ নেশায় ধনীক শ্রেণীর ঘরে ঘরে অশান্তি, যা থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। সত্য-মিথ্যার ব্যবধান মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে করতে পারে না, যখন উপলব্ধি করে তখন আর শোধরানের সময় থাকে না। রাষ্ট্রযন্ত্রসহ গোটা জাতির নিয়ন্ত্রকেরা যেভাবে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করছেন তার পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।