Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য মহাযুদ্ধের পরিকল্পনা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জায়নবাদি ইহুদিদের নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থা এই সবুজ গ্রহের মানব সভ্যতাকে একটি ভয়ঙ্কর পারমানবিক মহাযুদ্ধের ঠেলে দিতে চাইছে। বিশ্বের প্রধান প্রধান সভ্যতা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর জায়নবাদি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অসম লড়াইয়ের এখনকার প্রধান টার্গেট মুসলমান সম্প্রদায়। বিশ্বসম্প্রদায়ের অন্যতম অগ্রসর ও সক্রিয় অংশীদার হিসেবে প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস, সভ্যতা, সম্ভ্রম ও বেঁচে থাকার অধিকারের উপর অযাচিত, নির্মম বেপরোয়া হস্তক্ষেপ বেড়েই চলেছে। আপাতদৃষ্টিতে মুসলমান দেশগুলোতে চলমান জাতিগত, আঞ্চলিক দ্বন্দ-সংঘাত ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রীক লড়াই হিসেবে প্রতিয়মান হলেও প্রতিটি আঞ্চলিক ও জাতিগত সংঘাতের পেছনে পশ্চিমা পুরনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলোর সভ্যতা, মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার, মানবিক অস্তিত,¡ সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা রুদ্ধ করতে পশ্চিমা জায়নবাদি ইহুদি থিঙ্কট্যাঙ্ক, কপোর্রেট মিডিয়া ও মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স সমন্বিত ও সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রমিজড ল্যান্ড তথা সম্প্রসাণবাদ নীতির বাস্তবায়ন এবং ইসরাইলের পাশে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অনিবার্য বাস্তবতা আরো শত বছরের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। ফিলিস্তিনী জনগনকে তাদের ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত করে প্রায় ৭০ বছর ধরে চলা দখলদারিত্ব ও সম্প্রসারণবাদী আচরণ বিশ্ব মেনে নেয়নি। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক ও অন্যায্য সুবিধাভোগি কতিপয় রাষ্ট্রশক্তির বাইরে বিশ্বের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনীদের অধিকারের প্রশ্নে একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে নতুন পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থা (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) গড়ে উঠেছিল তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। বাইপোলার বা দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রায় চারদশক ধরে একটি ভয়ানক পারমানবিক যুদ্ধের হুমকির মধ্যে ছিল, যাকে কোল্ডওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ নামে অভিহিত। বিগত শতকের নব্বই দশেকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ইউনিপোলার বা একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় পরিনত হয়। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পতনের সাথে সাথে তার সামরিক শক্তির ভরকেন্দ্র ওয়ারশ সামরিক জোটেরও প্রাতিষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। এক হাতে তো আর তালি বাজেনা! সঙ্গতকারণেই বিশ্ব স্নায়যুদ্ধ তথা পারমানবিক হুমকি থেকে আপাত রেহাই পেল বলে ধারনা করা হচ্ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় কমিউনিজমের জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের নিয়ামক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সমরাস্ত্র কারখানা তথা মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ অবধারিতভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গ্লোবালাইজেশনের কারণে এরই মধ্যে উদীয়মান বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান ও ম্যানুফেকচারিং খাতে বড় ধরনের ডাউন-টার্ণের মধ্য দিয়ে গত দশকে এসে একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে রূপ নেয়। এহেন বাস্তবতায় যুদ্ধবাদি অর্থনীতিকেই তারা উত্তরণের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এর সফুলও পেয়েছে। ফিলিস্তিনী সংকটের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্বিক তাড়না পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্টোডলারে সমৃদ্ধ দেশগুলোর উপর একেক সময় একেক জুজু ঝুলিয়ে আত্মরক্ষা ও প্রতিবেশী আরবদের উপর আগ্রাসী সামরিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পশ্চিমা মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের সাথে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রচুৃক্তিতে আবদ্ধ করা হয়। এরপর শুরু হয় নানাবিধ কৃত্রিম সংকট। প্রথমে তালেবানের হুমকির জুজু, সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিদ্ধংসী মারনাস্ত্রের মিথ্যা অপবাদ, মুয়াম্মার গাদ্দাফির কথিত নিউক্লিয়ার প্লান্ট, ইরানের পারমানবিক প্রকল্প, সিরিয়ায় বিদ্রোহী বাহিনী ও বাশার আল আসাদের রিজিম চেঞ্জ এবং আইএস’র মত সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর তৎপরতার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ভ’-রাজনৈতিক এজেন্ডা এখন বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে পরিস্কার।
নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে একেকটি আঞ্চলিক সমস্যা তৈরী করে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে এবং মুসলিমবিশ্বে ক্রমেই তা রক্তাক্ত গণহত্যায় রূপ নিচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তির এক বছরের মধ্যেই ইরাকের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে প্রথম গাল্ফ ওয়ার সংঘটিত হয়। ইরাকের কুয়েত দখলের নেপথ্যে সাদ্দাম হোসেনের প্রতি মার্কিনীদের গ্রিন সিগনাল ছিল বলে জানা যায়। আর কুয়েত দখলের এক সপ্তাহের মধ্যেই বিশাল সমরসজ্জা নিয়ে ইরাকের উপর হামলে পড়ে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। ইসরাইলী ও পশ্চিমা মদতে আটবছরব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে একটি টেকসই স্থিতিশীল অবস্থায় পৌছানোর আগেই কুয়েতে হামলার অজুহাতে ইরাকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও তার উপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে লাখ লাখ ইরাকী শিশুকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বিল ক্লিন্টন আমলের মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মেডেলিন অলব্রাইটকে এক সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিলেন, গাল্ফ ওয়ারের পর পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরাকের প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে যা’ হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমার শিকার হওয়া শিশুদের সংখ্যার চেয়েও বেশী। এটা কি ঠিক হয়েছে (ইজ দ্য প্রাইস ওর্থ ইট)? জবাবে কোন দু:খপ্রকাশ না করে অলব্রাইটের সোজাসাপ্টা জবাব ছিল, ‘যদিও এটা আমাদের জন্য কঠিন পদক্ষেপ ছিল, তবে এটাই সঠিক। তাদের এটা প্রাপ্য ছিল।’ কি অপরাধ ছিল ইরাকি শিশুদের? ইসরাইলী ও পশ্চিমাদের হাতে মুসলমান শিশুহত্যা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।
এক দশকের বেশী সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজার উপর ইসরাইলী অবরোধ ও সামরিক আগ্রাসন চলছে। জলে, স্থলে-অন্তরীক্ষে জায়নবাদি অবরোধের কারণে কত সহস্র ফিলিস্তিনী শিশুর মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব বা পরিসংখ্যান হয়তো কারো হাতেই নেই। তবে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইসরাইলী আগ্রাসনে নিরস্ত্র আরব ও ফিলিস্তিনী নিহতের সংখ্যা অর্ধকোটির কম নয়। জায়নবাদি ইসরাইলীদের মনস্তত্ব গড়ে উঠেছে আরবদের জমি দখল ও হত্যা পরিকল্পনার ভেতর থেকে। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের একদশক আগে ১৯৩৭ সালে ইসরাইলের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন তার পুত্রের কাছে লেখা চিঠিতে বলেন, “উই উইল এক্সপেল দ্য আরবস অ্যান্ড টেইক দেয়ার প্লেইস। ইন ইচ অ্যাটাক এ ডেসিসিভ ব্লো শুড বি স্ট্রাক রেজাল্টিং ইন দ্য ডেস্ট্রাকশন অব হোমস অ্যান্ড দ্য এক্সপালশন অব দ্য পপুলেশন” -আমরা আরবদের বিতাড়িত করে তাদের জায়গাগুলোর দখল নিব। আমাদের প্রতিটি আক্রমনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু হবে তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা এবং জনসংখ্যা নির্মূল করা।’ অর্থাৎ ফিলিস্তিনী আরবদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের অনেক আগেই তারা কিভাবে, কি পদ্ধতিতে আরবদের হত্যা করবে এবং জমি দখল করবে তার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও হোমওয়ার্ক করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে আরবদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মান এবং তা ক্রমাগত সম্প্রসারণের রাজনৈতিক এজেন্ডার বাস্তবায়ন চলছে। ইসরাইলীদের হাতে আরব মুসলমান হত্যা এবং জমিদখল ও দখলকৃত জমিতে নতুন ইহুদি বসতি নির্মান একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। শুধু ফিলিস্তিনী বা লেবাননের সীমান্তেই নয় আরব ও মুসলিম বিশ্বের যেখানেই জাতিগত, গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয়ী সংঘাত হচ্ছে, সেখানেই কোন না কোনভাবে জায়নবাদি ইসরাইলের স্বার্থ ও তার অন্ধ সমর্থকদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে।
বংশানুক্রমে বসবাসরত ফিলিস্তিনীদের পিতৃভ’মি থেকে অস্ত্রের জোরে তাড়িয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনীদের সব চিহ্ন বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র ও নতুন জনপদ গড়ে তোলে জায়নবাদি ইহুদিরা। আরবে ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের অনেক আগেই ফিলিস্তিনের ইহুদিরা প্রথমে রোমানদের দ্বারা অত:পর খৃষ্টানদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিল। ইসলামের বিজয়ের পর সেখানে সংখ্যালঘু ইহুদি এবং মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখেছিল। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা বহিরাগত নয়। ইহুদিদের মতই তারা সেখানকার আদি বাসিন্দা। ইহুদি জনগোষ্ঠির হাজার বছরের উত্থান-পতন ও ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের সাথে মুসলমানদের ভ’মিকা খুবই ক্ষীন। উপরন্তু মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পর সেখানে ইহুদি জনগোষ্ঠির নিরাপত্তাসহ সংস্কৃতি চর্চা ও অর্থনৈতিক বিকাশের যে সুযোগ সৃষ্টি হয় তাকে ইহুদি রেনেসাঁসের যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে জার্মানীতে নাজিদের উত্থান পর্যন্ত গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদি জনগোষ্ঠি কখনো কোন সাম্রাজ্যের অধীনে দীর্ঘদিন শান্তিতে বসবাস করতে পারেনি। তারা সব সময়ই রাষ্ট্রসমুহে নানা ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরী করেছে এবং রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিগৃহিত ও বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা যেখানেই তাদের বিজয়ের পতাকা উড্ডীন করেছে সেখানেই সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন সভ্যতার মাইলফলক প্রতিষ্ঠা করেছে। ক্রুসেডের সময় ইহুদি ও মুসলমানদের প্রতি খৃষ্টানদের চাতুর্য ও হিংস্রতার বিপরীতে মুসলমান সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাহসিকতার পাশাপাশি তাঁর মহত্ব, বদান্যতার গুনাবলীও ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে আছে। সে সময় জেরুজালেমের ইহুদিরাও মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। মূলত জায়নবাদ ও ইহুদিবাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। জায়নবাদের প্রভাবমুক্ত ধার্মিক ইহুদিরা ফিলিস্তিনী আরবদের ভ’মির উপর অস্ত্রের বলে ইসরাইলী দখলদারিত্ব ও একটি স্বতন্ত্র ইহুদি আবাসভ’মি হিসেবে ইসরাইল রাষ্ট্রের অনৈতিক অস্তিত্ব সমর্থন করেনা। দশ বছর আগে ২০০৮ সালে যখন ইসরাইলীরা সাড়ম্বরে ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের আয়োজন করছিল তখন ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্বের শতাধিক সেলিব্রেটি বিশিষ্ট নাগরিক আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাদের ক্যাম্পেইনের লিখিত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিরা যেমন নাৎসাী বাহিনীর হাতে হলোকষ্ট বা গণহত্যার শিকার হয়েছিল, একইভাবে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের সময় ফিলিস্তিনের মুসলমানরা জায়নবাদি ইহুদিদের হাতে নাকবা(ক্যাটাসট্রফি/বিপর্যয়)’র শিকার হয়েছিল। স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর দেয়ার আগে এক লাইনে তারা লিখেছিল, ‘(ইউ উইল সেলিব্রেট হোয়েন আরব অ্যান্ড জিউ লিভ অ্যাজ ইকুয়াল ইন অ্যা পিসফুল মিডল-ইস্ট) আমরা সেদিনই ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করব যেদিন আরব ও ইহুদিরা সমান সুযোগসুবিধা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে।’ চারশতাধিক ফিলিস্তিনী গ্রামের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে, আট লাখের বেশী ফিলিস্তিনী আরবকে ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করে, হতাহত করে তারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের ১৯৪ নম্বর রেজুলেশনে যুদ্ধের শিকার উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়া এবং ক্ষতিপুরণ পাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হলেও ইসরাইল কখনোই ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবী স্বীকার করেনি। এ কারণেই ইউরোপ-আমেরিকা ও ইসরাইলের শতাধিক ইহুদি-খৃষ্টান নাগরিক ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধাভিযান চালিয়ে, বিমান হামলা করে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ হাসপাতাল গুড়িয়ে দিয়ে হাজার হাজার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ হত্যা করে ইসরাইলীরা তাদের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রেখেছে। এ বছর আগামী মাসে ইসরাইলীরা ৭০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। মুসলমানদের হত্যা এবং আরবভ’মি দখল করাই জায়নবাদি ইসরাইলের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য। বেন গুরিয়নের চিঠি থেকে শুরু করে ইসরাইলের শিশুদের পাঠ্যসূচি এবং গত ৭০ বছরের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ বছর ইসরাইলের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে সামনে রেখে জায়নবাদিদের আরো বৃহত্তর পরিসরে মুসলমান গণহত্যা ও ভ’মি দখলের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
চুয়াল্লিশতম মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভ’ষিত হন। তাঁর শাসনামল শুরুর আগেই ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে সামনে রেখে ফিলিস্তিনীদের উপর নতুন ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন শুরু করে জায়নবাদিরা। সে সময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বারাক ওবামার ভ’মিকা বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। তবে ক্ষমতার শেষবছরে ওবামার কয়েকটি সাহসী সিদ্ধান্ত বিশ্বে ফিলিস্তিনীদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান মজুবত করে দেয়। আরব-ইসরাইল বিরোধ নিরসনে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় গত ৭০ বছরে জাতিসংঘ যত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার প্রায় সবগুলো উদ্যোগই মার্কিন ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওবামার শেষ সময়ে এসে বিশ্ব অবাক বিষ্ময়ের দেখল জাতিসংঘের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন ভেটো প্রয়োগ থেকে বিরত থাকল। এর ফলে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলিত হল এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গত এক দশকে ইসরাইলের শুরু করা অন্তত দু’টি যুদ্ধে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দি বলে পরিচিত আইডিএফ হেজুবল্লাহ ও হামাসের মত গেরিলা বাহিনীর কাছে মার খেয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এহেন বাস্তবতায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইসরাইলের ভবিষ্যত ও সম্প্রসারণবাদী নীতির জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মনে করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ মিত্ররা। মার্কিন ও ইসরাইলের সাথে সাথে এমনকি সউদি আরবের শাসকরাও হামাস ও হেজবুল্লাহর মত ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক-সামরিক প্রতিরোধ সংগঠন ও বাহিনীকে সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে ঘোষনা করেছে। এভাবেই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া, বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন এখন জটিল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কবলে বন্দি হয়ে পড়ছে। পুঁজিবাদি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের চালক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদি অবস্থান ধরে রাখার প্রশ্ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের লাঠিয়াল, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রশ্ন যেন একই সুত্রে গ্রন্থিত হয়ে পড়েছে। ইসরাইল রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আগেই বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বঅর্থনীতির অনুঘটক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছিল ইহুদিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট বৃটেনের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় পুঁজিপতি ব্যাংকার, কর্পোরেট মিডিয়া ও মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর উপর নির্ভর করে। এসব নিয়ামক প্রতিষ্ঠানের উপর ইহুদিদের আধিপত্য সুবিদিত। কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জায়নবাদ প্রভাবিত থিঙ্কট্যাঙ্ক ও লবিস্টদের প্রভাব এড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকা সম্ভব নয়। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে বারাক ওবামা সেই ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার নেপথ্যে মূল রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে কাজ করেছে মুসলিম বিদ্বেষ এবং ইসরাইলের অনৈতিক স্বার্থের প্রতি শর্তহীন অন্ধসমর্থন। একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শেষে সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের অংশগ্রহণ ও কৌশলগত ঐক্যের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। গত দেড় দশকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক সংঘাত ও আগ্রাসনে মার্কিনীরা তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাদী সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা ৬ পরাশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি ইসরাইল ও মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হোঁতাদের জন্য একটি বড় ধরনের স্বপ্নভঙ্গ। সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যেন হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য করে দিয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধে পরাজয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। পরাজয় ঠেকানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা এখন একটি ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে। এ যুদ্ধ ইতিমধ্যেই আরেক রুশ-মার্কিন পারমানবিক স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি বড় যুদ্ধের আগেই মার্কিনীরা মিথ্যা অভিযোগ, অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। সাদ্দাম হোসেনের ওয়েপনস অব মাস ডেসট্রাকশনের মত এখন বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ রাখার অভিযোগ তুলে সিরিয়ায় নতুন করে সামরিক আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে ইসরাইল সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করেছে। রাশিয়া, ইরান,তুরস্ক, সিরিয়াসহ তাদের কৌশলগত মিত্ররা ইসরাইলী ও মার্কিন আগ্রাসনের পাল্টা জবাব দেয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রুশ-মার্কিন দুই পক্ষই তাদের পারমানবিক সমরাস্ত্র ব্যবহারের হুঁশিয়ারী দিয়েছে। একজন রুশ জেনারেল সিরিয়া এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিনীদের চলমান যুদ্ধ পরিকল্পনা মানব সভ্যতার জন্য শেষযুদ্ধে পরিনত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন।
[email protected]



 

Show all comments
  • সোহেল ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:৪৯ এএম says : 0
    এটাই ওদের ধ্বংস ডেকে আনবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নাহিদ ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:৫০ এএম says : 0
    লেখাটি খুব ভালো লেগেছে। লেখককে ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • Shahid ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:০৪ পিএম says : 0
    This is true. But few Muslim nations are senseless. But i am fear at the End Russia will not involve this war, lastly Iran and Syria will be destroyed by joined forces to extend the Jews territory Because During gulf war we hv seen Russia drawback at the final stage & Saddam has killed by West. But Muslims are not understand their machination. But 3rd WW is crying need among of west.
    Total Reply(0) Reply
  • Muhib Bullah ১৩ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:৩৬ পিএম says : 0
    এটাই আসল কথা যারা বুঝবার বুঝবে
    Total Reply(0) Reply
  • saiful islam ১৪ এপ্রিল, ২০১৮, ২:৩৩ এএম says : 0
    allah tader rokha korun
    Total Reply(1) Reply
    • Kamrul Hassan ১৮ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:১০ পিএম says : 4
      Ameen !
  • হাসান ১৪ এপ্রিল, ২০১৮, ৬:০৩ এএম says : 0
    ইনকিলাব একটি ভাল গঠন মুলক জাতীয় দৈনিক.
    Total Reply(0) Reply
  • rakib ১৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:২৭ পিএম says : 0
    maybe u right !!Russia not that good in international politics !! also big prob some muslim country leaders !!!I think army of islam is very good idea !!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসরাইল


আরও
আরও পড়ুন