Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ প্রকৃত স্বরূপ

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত ২৪ মার্চ শনিবারের পত্রপত্রিকায় তিনটি খবর ছিল যে কোন পাঠকের চোখে পড়ার মত। এর প্রথমটির শিরোনাম ছিল ‘বিশ্বের নতুন পাঁচ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ’। এটির তাৎপর্য এখানে যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের লক্ষ্যে জনগণের সুদীর্ঘ সংগ্রামে গণতন্ত্র সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। পাকিস্তান আমলে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা-ক্ষুধার কারণে গণতন্ত্র কখনোই বাস্তবে স্থিতিশীল হতে পারেনি। এ কারণে জনগণের মধ্যে একটা স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিশেষ গুরুত্ব লাভ করবে।
জনগণের সেই স্বপ্নের আলোকে বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়, তাতে নতুন রাষ্ট্রের যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি স্থান লাভ করে তার মধ্যে গণতন্ত্র ছিল সব চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের অন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় সরকার ভেদে মাঝে মধ্যে বড় বা ছোট ধরনের পরিবর্তন সাধিত হলেও গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে সাহস পায়নি কোন সরকারই। দু:খের ব্যাপার, জনগণের মধ্যে বিপুল সমর্থনের কারণে যে গণতন্ত্রের গায়ে কাগজে কলমে পরিবর্তন আনতে সাহস পায়নি কোন সরকারই, সেই গণতন্ত্রই সর্বাধিক অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও এবং সে অবমূল্যায়নের শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই, যখন গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরবর্তীকালে কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এটা সম্ভব হয় হয়তো এই বিবেচনায় যে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ রাজনৈতিক দলটি ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। এতে প্রমাণিত হয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাইতে আওয়ামী লীগ নেত্রীর কাছে অধিক সমর্থনযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন।
সংবাদপত্র পাঠকদের মনে থাকার কথা, এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসন। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ দিন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে নীরব থাকেন। পরে অবশ্য এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাও এ আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু ততদিন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া একটানা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে বিপুল খ্যাতিলাভ করে ফেলেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় এরশাদের শাসন আমলের শেষ দিকে গণতান্ত্রিক শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।
এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান দলই সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হন। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা খেয়াল রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার ‘কারচুপি’ আবিষ্কার না করে।
শেখ হাসিনার বিশ্বাস ছিল দেশের প্রাচীনতম ও সবচাইতে সুসংগঠিত দল হিসাবে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হবে। কিন্তু ভোট গণনার শেষে দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিএনপিশেখ হাসিনা নিজের ভবিষৎ বাণী ভঙ্গ করে বলে বসলেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। যা হোক শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল মোতাবেক বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন সরকার গঠন করলেন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা হলেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলের মেয়াদ শেষে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসহ সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা করা হল। এভাবে বেশ কয়েকটি নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা হওয়ায় এবং তাতে দেশের দুই প্রধান দল পর পর নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করায় এটা প্রমাণিত হল যে, বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব চাইতে উপযুক্ত ব্যবস্থা।
কিন্তু এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধা এক পর্যায়ে এমন সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও পচিয়ে দেয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধার দ্ব›েদ্বর সুযোগে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে পড়ে এবং সেনা সমর্থিত সরকারের নামে সেনা নিয়ন্ত্রিত এক অদ্ভুত সরকার গঠন করে বসে। শুধু তাই নয়। তারা দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে জাতীয় সংসদ ময়দানে দুটি ভবনে গৃহবন্দি করে রেখে দুই প্রধান দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। উপরের পর্যায়ের কিছু নেতা তাদের এ কাজে সহযোগিতা করলেও দুই দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে তাদের এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে তিনি যদি ক্ষমতায় যেতে পারেন, তা হলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণজনিত সকল কাজের বৈধতা দান করবেন। এর পর দেশে যে নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং শেখ হাসিনা দেশের প্রধান মন্ত্রী হন। তিনি ৫ জানুয়ারী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বিএনপি অতীতের সমঝোতা লংঘনের অভিযোগে সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।
দেশের দুই প্রধান দলের একটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় বাস্তবে সে নির্বাচন হয়ে পড়ে নির্বাচনী প্রহসন। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সরকারী দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীও সে নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে যাবার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন তারা না গেলেও তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকে ঠিকই করা হবে। বাস্তবে হয়ও তাই। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে অল্পসংখ্যক সরকারী দলের নেতাকর্মী ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সরকারী দলের প্রার্থীদের ব্যালট পত্রে ইচ্ছামত সীল মেরে তাদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট মাত্রাতিরিক্তভাবে দেখানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই সরকারী দলের প্রার্থীরা কাগজে কলমে “বিপুল ভোটে জয়ী” হন যদিও ভোট দানের নির্দিষ্ট সময়ে সমস্ত ভোটকেন্দ্র প্রায় ফাঁকা ছিল। পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কিত সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জনগণ প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। এ কারণে জনগণ এ নির্বাচনকে নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন তারা এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল।
\ দুই \
দেশে যদি সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যম অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তার ফলাফল কী হতে পারত, তার নমুনা আমরা বুঝতে পারবো সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রীম কোর্টের বার নির্বাচনের ফলাফল থেকে। সেখানে বিএনপি, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থিত প্রার্থীরা প্রতিদ্বিিদ্বতা করেন। ১০ পদে জাতীয়তাবাদী প্রার্থীরা এবং ৪ পদে আওয়ামী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে কোন রূপ কারচুপির অভিযোগ আওয়ামী প্রার্থীরাও করেননি। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের মত উচ্চ মর্যাদার সংস্থার নির্বাচনে সেটা হওয়ার কথাও নয়।
\ তিন \
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং গণস্বাস্থ্যের কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাষ্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন বাংলাদেশের সকল সমস্যার জন্য দায়ী হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ভারতকে চিনতে ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। গত শুক্রবার ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের হলে এক আলোচনা সভায় ‘মহান স্বাধীনতার ৪৭ বৎসর ও জনগণের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায়, তিনি একথা বলেন।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের গঙ্গার উজানে ফারাক্কা ও অন্যান্য নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার চক্রান্ত ছাড়াও আরও বন্ধু বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তে ভারত জড়িত। সম্প্রতি ভারতের শাসক দল বিজেপির কতিপয় নেতা বলেছেন ১৯৭১ সালেই ভারতের উচিৎ ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করে নেয়া। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে দেয়া উচিৎ হয়নি। ভারতকে যারা নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে মনে করে, তাদের সে ভুলের যত শীঘ্র অবসান হয়, দেশের জন্য ততই মঙ্গল।



 

Show all comments
  • Rajib Biswas ২৯ মার্চ, ২০১৮, ৭:৩৯ এএম says : 0
    very nice article
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ২৯ মার্চ, ২০১৮, ৭:১৬ পিএম says : 0
    Honourable additor,I am very much appreciating your addition it’s very true patriotic but those you are suggesting I hope really understand your suggestions,thanks
    Total Reply(0) Reply
  • AI ২৯ মার্চ, ২০১৮, ১১:১৭ পিএম says : 0
    Thinking against India will never help. Now India is a strong country. Bangladesh is India's market for all low grade products. This friendship is for ever. Now India is working to create weapons market in Bangladesh. It will be a smart business.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন