শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সকল পেশার মানুষের সঙ্গে কবি সাহিত্যিকরাও অংশ নিয়েছেন। এ সংখ্যায় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা কবিকে উত্থাপন করা হলো। পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে মুক্তিযোদ্ধা কবি-লেখকদের নিয়ে আরোও লেখা থাকবে। -বি.স
আল মাহমুদ একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। মুক্ত করেছেন সোনার বাংলাকে। তিনি গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।
আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। পিতা আব্দুর রব মীরের ছিল কাপড়ের ব্যবসা। পরবর্তীতে বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসের অফিসার। মা রৌশন আরা বেগম ছিলেন গৃহিনী।কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাই স্কুলের পড়াশোনা করেন।
১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে।তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের মাঝে লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, পাখির কাছে ফুলের কাছে, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩ উল্লেখযোগ্য।
লেখালেখির মূল্যায়ন স্বরুপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭),নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক- ২০০৪ প্রভৃতি।
রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম রফিকুল ইসলাম খান। পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রফিক ভাষা শহিদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে, আদর্শ মানুষ হিসেবে। রফিক আজাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি। রফিক আজাদ ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার এর সম্পাদক ছিলেন। রোববার পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের মাঝে অসম্ভবের পায়ে, সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি, প্রেমের কবিতাসমগ্র, বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে, বিরিশিরি পর্ব, রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা, রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র, হৃদয়ের কী বা দোষ, কোনো খেদ নেই, প্রিয় শাড়িগুলো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯), ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১), কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬), বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭), একুশে পদক (২০১৩) ইত্যাদি পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ রফিক আজাদ মৃত্যুবরণ করেন।
খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ভাস্কর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুরের ভবানীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় এলাকা ছিল তার ঘাঁটি।
ভাস্কর চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ বিসয়ক স্মৃতিচারনে লিখেছেন- “বাংলাদেশে একতরফা গনহত্যা করেছিলো পাকিস্তান বাহিনী ।আমি রকেট শেল পড়া মৃতদের লাশ টেনে গর্তে ফেলেছি । ক্লান্ত হয়ে দুরাত আমার বড়দাদাকে নিয়ে আমি ডিসেম্বরের শীতে লাশের পাশে শুয়ে থেকেছি একটা সময়ে একাত্তরে লাশ ও কুকুর টানাটানি করেছে দেখেছি।”
ছাত্রজীবন থেকেই তার লেখালেখি শুরু। রক্তপাতের ব্যাকরণ (১৯৮৪-গল্পগ্রন্থ), বাষট্টি বিঘা নদী (১৯৮৭-গল্পগ্রন্থ), কোথায় নিবাস (১৯৮৭-গল্পগ্রন্থ), পতনের সময় (১৯৮৮-গল্পগ্রন্থ), শনিবারে বৃষ্টি (১৯৯৯-গল্পগ্রন্থ), লালমাটি কালো মানুষ (১৯৯৮-উপন্যাস), স্বপ্নপুরুষ (১৯৯৮-উপন্যাস). মীমাংসা পর্ব (১৯৯৮-উপন্যাস) আষাড়ের জীবনদর্শণ (১৯৯৯-উপন্যাস) ভূমি (২০১১- উপন্যাস), কৃষ্ণপুরাণ (২০১১-উপন্যাস), কখনও কখনও এরকম ঘটে (২০১২-উপন্যাস)। আমার কেবলই সমর্পণ (১৯৮৬-কবিতা), নিরঞ্জন আমার বন্ধুর নাম (২০১২-কবিতা), আমার ভেতরে আঁধার (২০১২-কবিতা), পরাণের গহীন (২০১২-কবিতা), তোর বড় কষ্টরে (২০১২-কবিতা) গেরিলার মুখ (২০১৪-কবিতা)প্রভৃতি তাঁর প্রকাশিত উল্ল্যেখযোগ্য মৌলিক সৃষ্টিশীল গ্রন্থ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।