Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিয়ানমারের রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন গড়ার পরিকল্পনা রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মিয়ানমার থেকে দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদীদের দ্বারা বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়ার বিষয়টি যে ‘আইওয়াশ’ ও ‘মকারি’ বা উপহাসে পরিণত হয়েছে, তা এখন স্পষ্ট। একদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি করেও তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করছে, অন্যদিকে রাখাইনকে মুসলিম-মুক্ত করার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের কাউক গ্রামে এক সময় ছিল রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিবাস। এখন সেই গ্রামের প্রবেশপথে বাঁশের খুঁটিতে শোভা পাচ্ছে বৌদ্ধদের পতাকা। সেখানে হেলিপ্যাড, নিরাপত্তা স্থাপনা ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। রাখাইনের যেসব এলাকা থেকে মুসলমান রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে সেখানে বসতি গড়ে তুলছে বৌদ্ধ রাখাইনরা। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা বিন্যাস উল্টে দিয়ে ‘রাখাইনিকরণ’ করার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার অংশ হতে পেরে আগত বৌদ্ধরা খুব খুশি। বৌদ্ধ রাখাইনদের নিয়ে মিয়ানমার সরকারের এই ‘রাখাইনিকরণ’ পরিকল্পনা এবং তা কার্যকর করার তৎপরতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশটি রাখাইনে যে এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়িত করেছে, তাদের আর ফেরত নিতে চাচ্ছে না।
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ উগ্রবাদী বৌদ্ধরা যেভাবে নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করেছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই বর্বরতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। নিপীড়ন ও নির্যাতনে টিকতে না পেরে স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু ফেলে শুধু জীবন নিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের এই মহানুভবতা প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ পশ্চিমা দেশ ও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে ছুটে এসেছেন। তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তীব্র নিন্দা এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বস্তুত এই চাপে পড়েই মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছে। প্রাথমিকভাবে ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার নাম দেয়া হয়েছিল। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার এক দিন আগে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ তালিকা থেকে সে মাত্র ৩৭৪ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। তারপর থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি স্থগিত হয়ে আছে। মিয়ানমারের এ আচরণ যে টালবাহানা ছাড়া কিছু নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না। এর অর্থ সে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, জাতিসংঘসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে কেবল বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন চলাকালে তা বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে কেবল ‘লিপ সার্ভিস’ হিসেবে আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন, রিলিফ বিতরণ ও আর্থিক সহায়তা এবং মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আহ্বান জানিয়েই দায়িত্ব সেরেছে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় যখন একই কায়দায় মুসলমানদের উপর নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া চালানো হয়, তখন পশ্চিমা দেশগুলো একেবারে শেষ দিকে হস্তক্ষেপ করেছিল। এর ফলে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। তারা যে মুসলমানদের রক্ষার জন্য এ হস্তক্ষেপ করেছিল, তা নয়। বরং সার্বিয়াকে শিক্ষা দেয়ার জন্য বসনিয়া-হার্জেগোভিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। বলা বাহুল্য, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বা মিয়ানমারে যদি মুসলমানের পরিবর্তে অন্য কোনো ধর্মের মানুষের ওপর নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া চলত, তখন দেখা যেত জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের রক্ষায় যা যা করণীয় তাই করত। একসাথে নিপীড়নকারীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ত। পূর্ব তিমুরের ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা গেছে। মুসলমানরা খুন, ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার হলে তারা শুধু মুখে মুখে কিছু কথা বলে সহানুভূতি প্রকাশ করে। এছাড়া কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। এটা তাদের দ্বিমুখী আচরণ ছাড়া কিছুই নয়। মিয়ানমার সরকার যে আলোচনার অন্তরালে রাখাইনকে মুসলমান-মুক্তকরণের সব প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুই জানে না, এমন মনে করার কারণ নেই। অথচ এই অন্যায় তৎপরতা মোকবেলায় তাদের কোনো ভূমিকাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি, চীন ঘটনার শুরু থেকে নীরবতা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশটির ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্তেও সে নিশ্চল অবস্থানে রয়েছে। অথচ তার অনুরোধেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিকতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তি করে। এখন দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন গড়ার পরিকল্পনা দ্রুত এগিয়ে নিলেও চীন কোনো কথা বলছে না। যেহেতু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে তার ভূমিকা রয়েছে, তাই এর দায় দেশটি এড়িয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কার্যক্রমে চীনকে অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসনের কাজ যত ত্বরিৎসম্ভব সম্পন্ন করার জন্য তাকে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বকে লিপ সার্ভিস দেয়ার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সবাই মিলে এমন একটা পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে, নিজেদের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে পারে। নাগরিকত্বসহ সকল অধিকার নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন