পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যৌতুক নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মীয় এবং আইনগত দিক থেকে অবৈধ এই কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকা সত্তে¡ও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুকের শিকার হয়ে দেশে প্রতি বছর অনেক নারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যৌতুকের কারণে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার এক ক্ষুদ্র অংশ আইন-আদালতে যায় কিংবা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
যৌতুকবিরোধী আইনের প্রয়োগ যেমন সীমিত তেমন এই আইনের অপব্যবহারও কম নয়। পারিবারিক বিরোধে কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্যও যৌতুক আইনের অপব্যবহার করা হয়। যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টিতে এ ধরনের অপপ্রয়োগ অন্তরায় সৃষ্টি করে। যৌতুকবিরোধী আইনে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকা সত্তে¡ও তা যৌতুকলোভীদের সামাল দিতে পারছে না সামাজিক সচেতনতার অভাবে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। যৌতুকের অভিশাপ কেবল গরিবের ঘরে নয় মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, ধনী সব ধরনের পরিবারেই ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জন নারীকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৯৫ জন নারী। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ১৬ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আরো ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ১৯২টি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ২(ঞ) ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, (অ) কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা পুর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে কনেপক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ; অথবা (আ) কোন বিবাহের কনে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বর পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদসমূহকে যৌতুক বলা হবে।
যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, এর ৩ ধারায় যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, এই আইন বলবৎ হওয়ার পর, কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে অথবা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করলে, সে অনধিক পাঁচ বছর পর্যন্ত এবং এক বছরের কম নয় মেয়াদের কারাদন্ডে বা জরিমানায় কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে।
যৌতুক দাবি করার দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকরি হওয়ার পর কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবি করলে, সে অনধিক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এবং এক বৎসরের কম নয় মেয়াদের কারাদন্ডে বা জরিমানায় কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে।
দেশ ও জাতির স্বার্থে যৌতুকের কারণে নারীনির্যাতনের এই চিত্রের অবসান জরুরি। যৌতুকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন। ইসলামে যেহেতু যৌতুককে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই ইসলামের অনুসারি, সেহেতু মসজিদের ইমাম এবং আলেম-উলামার মাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলোও যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে পারে ধর্মীয় ব্যক্তিগণ। পাঠ্যপুস্তকে যৌতুকবিরোধী বিষয় এবং যৌতুক সংক্রান্ত আইনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আমরা মনে করি যৌতুক বন্ধে আইনগত প্রতিরোধের চেয়েও সামাজিক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা বেশি। সমাজদেহ থেকে এই আপদ তাড়াতে পারিবারিকভাবেও সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। যৌতুকজনিত নির্যাতনের ক্ষেত্রে মাদক ও জুয়ার ভ‚মিকা ব্যাপক। মাদকাসক্ত ও জুয়াড়িদের মধ্যে স্ত্রী নির্যাতনের প্রবণতা বেশি। যে কারণে এ দুটি অবৈধ অভ্যাস বন্ধেও নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। যৌতুকরোধে যে আইন রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যৌতুক সমাজে যেন নারীর প্রতি একটি অভিশাপ। যৌতুকের জন্য যেমন বহু নারীর বিয়ে হয় না, তেমনি বিয়ে হলেও এই যৌতুকের কারণেই সংসার সুখের হয় না। বহু নারীকে এজন্য স্বামীর ঘরে অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। বহু নারীকে জীবনও দিতে হয়।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মৌলিক নির্দেশনার আলোকে যৌতুক নিষিদ্ধ বিষয়। ইসলাম নারীকে আর্থিক সামর্থ্য দানের লক্ষ্যে এবং তার সম্ভ্রমকে সম্মান জানানোর জন্য ‘মাহর’ নির্ধারিত করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, নারীদেরকে তাদের মোহরানা সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দাও। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মোহরানা নির্ধারণ করল পরিমাণে যাই হোক, কিন্তু মনে মনে তা পরিশোধের ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে কিয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে উঠবে।’ প্রচলিত যৌতুক প্রথার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাহর-এর স্থলে উল্টা কন্যাপক্ষকে স্বামীর অবৈধ আবদারের অর্থ ও সম্পদ দিতে হয়। ইসলাম এ অন্যায়কে অনুমোদন করে না। যৌতুক একটি জুলুম। নারীর অভিভাবকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার প্রতি যৌতুকের মাধ্যমে অন্যায় করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সব জুলুমই হারাম’। সে হিসেবে যৌতুকও ধর্মীয় দৃষ্টিতে অবশ্যই হারাম। যৌতুক নারী নির্যাতনের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচিত। অথচ আল্লাহর নির্দেশ, ‘স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে’।
লেখক: গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।